মেট্রোর সুড়ঙ্গের জন্যই কি ভেঙে পড়ছে বাড়ি?
১৬ মে ২০২২৭৪ বছরের রাজলক্ষ্মী সেন কার্যত স্থির হয়ে বসেছিলেন একটি চেয়ারে। স্বামী মারা গেছেন। বৌবাজারের শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িতে পা রেখেছিলেন বিয়ের পরে। পুরসভা সেই বাড়ি তাকে ছাড়তে বলেছে। বাড়ির একাংশ ভেঙে ফেলা হতে পারে। রাজলক্ষ্মীকে বলা হয়েছে, আপাতত পুরসভাই একটি হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে তাকে। বাড়ির সমস্ত জিনিসপত্র বাগবাজারের একটি ওয়্যারহাউসে আপাতত রাখা হবে।
কেন বাড়ি ছাড়তে হবে রাজলক্ষ্মীকে? মেট্রোর সুড়ঙ্গ তৈরি করতে গিয়ে ফাটল ধরেছে তার বাড়িতে। রাজলক্ষ্মী একা নন, বৌবাজারের বহু বাড়িতেই ফাটল ধরেছে। বাড়িগুলি ভেঙে পড়তে পারে যে কোনো সময়। তাই প্রশাসন বাড়িগুলি ফাঁকা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
২০১৯ সালেও একই ঘটনা ঘটেছিল। মেট্রোর সুড়ঙ্গ তৈরি করতে গিয়ে ধস নেমেছিল মাটিতে। ভেঙে গিয়েছিল বাড়ি। তিন বছর পর আবার সেই ঘটনা ঘটছে। কেন ঘটছে?
কলকাতার পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো করিডোর। এর খানিকটা পথ মাটির উপর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, কিছুটা পথ মাটির নীচ দিয়ে। শিয়ালদহ থেকে বৌবাজার হয়ে কার্জনপার্ক পর্যন্ত যে রাস্তা তৈরি হচ্ছে, তা মাটির নীচে সুড়ঙ্গ কেটে তৈরি হচ্ছে। বাকি জায়গায় সমস্যা না হলেও বৌবাজার অঞ্চলে বার বার সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারদের। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক এবং মেট্রো প্রকল্পের অন্যতম পরামর্শদাতা সোমনাথ ঘোষ ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''২০১৯ সালে বৌবাজার অঞ্চলে মাটির প্রায় ২৫ মিটার নীচে যখন টানেল তৈরি হচ্ছিল, তখন আটমকা টানেলে জল ঢুকতে শুরু করে। কলকাতায় মাটির নীচে জলস্তর তিন থেকে পাঁচ মিটার গভীরে। টানেলে আটমকা জল ঢুকতে শুরু করায় মাটির উপরের অংশে ধস নামে। যার জেরে বাড়িগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।'' সোমনাথের দাবি, এরপর ওই জল আটকানোর জন্য তারা নির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা করেছিলেন। কার্জনপার্কের দিক থেকে কাজ বন্ধ করে শিয়ালদহের দিক থেকে নতুন করে কাজ আরম্ভ করেন। জল যাতে না ঢোকে, তার জন্য একটি নতুন দেওয়াল তৈরি করা হয়। একইসঙ্গে চেম্বার তৈরি করে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। গত তিন বছরে সুড়ঙ্গের কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। কার্জনপার্কের দিকের সুড়ঙ্গের সঙ্গে বৌবাজারের সুড়ঙ্গ জুড়তে গিয়ে ফের সমস্যা হয়। দিনকয়েক আগে সে ঘটনা ঘটেছে। ফের সুড়ঙ্গে জল ঢুকতে শুরু করে। ফলে ফের সুড়ঙ্গের উপরের মাটি আলগা হয়ে যায় এবং পুরনো বাড়িগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিকল্পনার ঠিকমতো প্রয়োগ না হওয়াতেই ফের এই সমস্যা হয়েছে বলে মনে করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
তার বক্তব্য, জল ঢোকা বন্ধ করে সুড়ঙ্গ তৈরি করলেই চলবে না, ওই সুড়ঙ্গ যখন ব্যবহার করা হবে, অর্থাৎ, যখন এরপর মেট্রো যখন চলবে সেখান দিয়ে, তখন মাটির ভিতর যে ভাইব্রেশন হবে, তা থেকেও উপরের বাড়িগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে মাটির সঙ্গে রাসায়নিক মিশিয়ে সুড়ঙ্গ এবং সারফেসের মধ্যবর্তী অংশ ভালো করে পাইলিং করা প্রয়োজন। এখনই সেই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা উচিত।
বস্তুত, বৌবাজার অঞ্চলের সুড়ঙ্গ নিয়ে চিন্তিত কলকাতা মেট্রো রেল কর্পোরেশনও (কেএমআরসিএল)। এর জন্য আইআইটি রুরকিকে তারা ডেকেছে। রুরকির ইঞ্জিনিয়াররা পরীক্ষা করে দেখবেন কীভাবে সমস্যার মোকাবিলা করা যায়। আগামী পরিকল্পনার খসড়াও তাদের তৈরি করার কথা। অন্যদিকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারদের ফের আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা পুরনো বাড়িগুলির অবস্থা পরীক্ষা করে দেখবেন।
কেএমআরসিএল-এর এমডি চন্দ্রশেখর ঝা জানিয়েছিলেন, কিছু বাড়ি ভেঙে ফের নতুন করে তৈরি করে দেওয়া হবে। বিপজ্জনক বাড়িগুলি ভাঙার কাজ সোমবারেই শুরু হয়েছে। পুজোর আগে ফের নতুন বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম অবশ্য জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞরা রিপোর্ট দেওয়ার পরে সবিস্তারে পুরো পরিকল্পনার কথা জানানো হবে। তবে যাদের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের নতুন বাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
এই প্রতিবেদনে যে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে, তার দিকে যদি ভালোভাবে দৃষ্টি দেওয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে কীভাবে গত কয়েকদিনে বাড়ির গায়ে ফাটল ধরেছে। ছবির ডানদিকে হলুদ দেওয়ালে ফাটল স্পষ্ট। ছবির বাঁদিকে ইটের দেওয়াল কার্যত ভেঙে পড়েছে।
এমনই অবস্থা ওই অঞ্চলের একাধিক বাড়ির। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, রাতারাতি সমস্যার মোকাবিলা করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। সময় নিয়ে ওই অংশের মেট্রোর সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে একাধিক বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে নতুন করে তৈরি করে দিতে হবে। আর সুড়ঙ্গ এবং সারফেসের মধ্যবর্তী অঞ্চল প্রযুক্তির সাহায্যে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। এখন যা অবস্থা হয়ে আছে, তাতে ফের বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে।