ভারতে রিলায়েন্স ও ডিজনির হাত মেলানোর ফল কী হবে?
২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের(আইপিএল) সম্প্রচার ঘিরে যুদ্ধ তুঙ্গে উঠেছিল। সেই লড়াইয়ে ইতি পড়ে গেল। আন্তর্জাতিক বিনোদন সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বাধল ভারতের অন্যতম বড় বিনোদন ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান।
রিলায়েন্স ও ডিজনি
ভারতীয় শিল্পপতি মুকেশ আম্বানির সংস্থা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলো ওয়াল্ট ডিজনি। রিলায়েন্সের অধীনস্থ সংস্থা ভায়াকম ১৮ মিডিয়া এবং ওয়াল্ট ডিজনির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই বোঝাপড়া অনুযায়ী, ভায়াকম এবং স্টার ইন্ডিয়া মিশে গিয়ে একটি যৌথ সংস্থা তৈরি হচ্ছে।
এই যৌথ সংস্থার মাধ্যমে ৭০ হাজার কোটির বেশি টাকার সাম্রাজ্য তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে রিলায়েন্স এবং ওয়াল্ট ডিজনি। নতুন সংস্থায় ৬৩.১৬ শতাংশ অংশীদারিত্ব রয়েছে রিলায়েন্সের, বাকি ৩৬.৮৪ শতাংশের অংশীদারিত্ব ডিজনির। এই চুক্তির পর রিলায়েন্সের ঘোষণা, তারা মিডিয়া ও ওটিটি মিলিয়ে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চলেছে আগামী পর্যায়ে।
সংস্থার বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভায়াকম ১৮ এবং স্টার ইন্ডিয়া মিলে যে সংস্থা জন্ম নিল, তার শীর্ষে থাকবেন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানির স্ত্রী নীতা আম্বানি। ভাইস-চেয়ারম্যান উদয় শংকর।
ক্রিকেট নিয়ে লড়াই
বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে রিলায়েন্স এবং ডিজনির মধ্যে তুমুল রেষারেষি ছিল। আইপিএলের সম্প্রচার স্বত্ব নিয়ে তা চরমে পৌঁছয়। দীর্ঘদিন আইপিএলের সম্পূর্ণ সম্প্রচার স্বত্ব ছিল স্টার ইন্ডিয়ার দখলে। টেলিভিশনে আইপিএল ক্রিকেট দেখানোর পাশাপাশি ডিজনি প্লাস হটস্টার প্ল্যাটফর্মে লাইভ স্ট্রিমিং করা হত ম্যাচের।
২০২৩ সালে ছবিটা বদলে যায়। সেই বছর থেকে আইপিএলের টিভি এবং লাইভ স্ট্রিমিং সম্প্রচারের স্বত্ব পৃথকভাবে নিলামে তুলেছিল ভারতীয় ক্রিকেট পরিচালন সংস্থা বিসিসিআই। টিভিতে সম্প্রচারের স্বত্ব স্টার স্পোর্টস পেলেও অনলাইনে লাইভ স্ট্রিমিং করার অধিকার পেয়ে যায় রিলায়েন্স।
ডিজনি কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, যখন রিলায়েন্স সাবস্ক্রিপশন ছাড়াই সকলের দেখার জন্য বিনামূল্যে আইপিএলের লাইভ স্ট্রিমিং করেছিল। এতে সাড়াও মিলেছিল বিপুল। এর পাল্টা ডিজনি প্লাস হটস্টারে নিখরচায় ২০২৩ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ দেখানো হয়।
এই প্রতিযোগিতায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে ডিজনি। মোবাইলে জিও সিনেমা বড় সংখ্যক ক্রিকেট দর্শককে আকৃষ্ট করায় টিভি বিজ্ঞাপন থেকে ডিজনির আশানুরূপ আয় হয়নি।
তাই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে রিলায়েন্সের সঙ্গে হাত মেলাতে কার্যত বাধ্যই হয়েছে তারা। একটি আন্তর্জাতিক সম্প্রচার সংস্থা কোনো ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের করায়ত্ত হওয়া গণমাধ্যমের দুনিয়ার একটি বড় ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম স্টাডিজের অধ্যাপক মানস ঘোষ বলেন, "এর ফলে ছবির পরিবেশনায় বড় পরিবর্তন দেখা যাবে। দেশীয় পরিবেশকদের হাতে আর সবটা থাকবে না। সেটা আন্তর্জাতিক চেহারা নেবে। সাধারণ দর্শকদের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, তাদের কোনো সুবিধা বা অসুবিধার বিষয় এতে নেই।"
সত্যজিৎ রায় ফিল্ম এন্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক অশোক বিশ্বনাথনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, "রিলায়েন্সের শাখা সংস্থা এর আগে বাংলা ছবি করেছে। কিন্তু তা খুব উচ্চ মানসম্পন্ন হয়েছে, বলা যাবে না। তাছাড়া ডিজনি যে ধরনের বিনোদন উপকরণ তৈরি করে, তার সঙ্গে আমাদের জনরুচি ততটা খাপ খায় না। ফলে আমি এই বোঝাপড়া নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নই।"
একচেটিয়া ব্যবসা?
দেশ ও বিদেশের দুই বড় সংস্থা হাত মেলানোয় ভারতে বিনোদন জগতে একচেটিয়া ব্যবসা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যৌথ সংস্থার হাতে ১২০টি টিভি চ্যানেল থাকবে। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে দুটি অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, ডিজনি প্লাস হটস্টার এবং জিও সিনেমা।
অতীতে টেলিকম ক্ষেত্রে একচেটিয়া ব্যবসার প্রভাব দেখা গিয়েছে। রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিস জিও ব্র্যান্ডের অধীনে এই ক্ষেত্রে প্রবেশ করার পর ভারতের টেলিকম পরিষেবায় বিপুল পরিবর্তন এসেছে। প্রতিযোগিতার চাপে বন্ধ হয়ে গিয়েছে একের পর এক মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা।
বিনোদনের ক্ষেত্রে ভারতে আর যেসব সংস্থা ব্যবসা করে, তাদের ভবিষ্যতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। সোনি, আমাজন প্রাইম, জি এন্টারটেইনমেন্ট, নেটফ্লিক্স ছাড়াও প্রাদেশিক স্তরে ছোটখাটো অনেক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে উঠেছে। তারা কি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে?
সত্যজিৎ রায় ফিল্ম এন্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রনিক এবং ডিজিটাল মিডিয়া শাখার ডিন অভিজিৎ দাশগুপ্ত বলেন, "এক কথায় বলা যায়, ছোট-বড়র যুদ্ধ হবে না। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হবে। ভায়াকম বা স্টার বড় আকার ধারণ করবে। তাই সোনি বা জি নেটওয়ার্কের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হবে।"
সিনেমাটোগ্রাফার প্রেমেন্দুবিকাশ চাকী বলেন, "সর্বভারতীয় মিডিয়ার অধিকাংশ জায়গাটাই দুই তিনজন ব্যবসায়ীর হাতে কুক্ষিগত হচ্ছে। তারাই যদি বিনোদন নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের মতামতের বাইরে বিনোদন জগৎ যেতে পারবে না। সেটা নিউজ হোক বা সিনেমা। এটা কাম্য নয়।"
তবে তার মতে, "যারা হলিউডে এতদিন উচ্চমানের কাজ করেছেন, তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সুযোগ পাবে ভারতীয় চলচ্চিত্র। ভারতে থেকে আন্তর্জাতিক মানের কাজের সুযোগ বাড়বে।"