ভারতে পুত্র সন্তানই কাম্য কেন?
২২ মে ২০১৬কারণ সামাজিক ও ধর্মীয়৷ হিন্দু শাস্ত্রের বিধান পুত্রং দেহি৷ গর্ভ থেকে নিয়ে গোটা জীবন – কন্যা সন্তান যেন সবসময়েই অন্যের সম্পত্তি৷ তাই পরিবারের বোঝা৷ মেয়েরা আজ নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছে, করে চলেছে সর্বস্তরে৷ তারপরও মানসিকতাটা যায়নি৷
হিন্দুরা মন্দিরে যায় প্রার্থনা করতে, বলে ‘পুত্রং দেহি'৷ কারণ হিন্দু শাস্ত্রের বিধান পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা৷ পুরুষ বিয়ে করে পুত্র সন্তান লাভের জন্য৷ পুরাণকাররা যে বলে গেছেন, বংশ রক্ষা হবে পুত্র সন্তানের মাধ্যমে! আর সেই মানসিকতা প্রাচীনকাল থেকেই গেঁথে আছে সমাজের গভীরে৷ কন্যা সন্তান তাই বোধহয় তাঁর যোগ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত৷ মেয়েদের ওপর অপরাধের সংখ্যাও তাই দিনকে দিন বেড়েই চলেছে৷ প্রতি পদে মেয়ে সন্তানের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পরিবারের ঘুম চলে যায়৷ ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির ঘটনার ক্ষেত্রেও মেয়েদের দিকেই আঙুল তোলা হয় প্রথমে৷
২০১১ সালের জনসমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি হাজার পুত্র সন্তানের মধ্যে ছয়বছর বয়সের কন্যা সন্তানের হার ধারাবাহিকভামে কমে দাঁড়িয়েছে ৯১৮তে৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কন্যা সন্তানকে বোঝা মনে করা হয়৷ মাতৃগর্ভ থেকেই শুরু হয় তার প্রতি অবিচার৷
কন্যাভ্রুণ হত্যার বলি হয় তারা৷ ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণে সরকার থেকে ‘আল্ট্রাসাউন্ড' পদ্ধতি নিষিদ্ধ করা সত্ত্বেও৷ কন্যা সন্তান ভূমিষ্ট হবার পরও সে অযত্নের শিকার হয়৷ অপুষ্টিতে ভোগে, চিকিত্সা সেবাযত্ন ঠিকমত পায় না৷ স্কুলে যাবার বয়স হলে নামিদামি স্কুলে পাঠানো হয় না৷ মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন, যেন কন্যা মানেই তো পরের সম্পত্তি৷ তাই প্রথম থেকেই খরচের খাতায় নাম লেখা হয়৷
এই প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক দেবদাস ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলে বলেন, ‘‘পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুধু ভারতেই নয়, গোটা দুনিয়াতেই আছে৷ ভারতে কন্যা সন্তানের প্রতি বৈষম্যের বড় কারণ পণপ্রথা৷ মেয়ের জন্মলগ্নেই বাবা-মায়ের মাথায় হাত এখন থেকেই মেয়ের বিয়ের জন্য প্রচুর টাকার ব্যবস্থা করতে হবে৷ শহরাঞ্চলে পণপ্রথার প্রকৃতি কিছুটা বদলালেও, সর্বত্র তা বদলাচ্ছে না৷ পণপ্রথা বেআইনি হলেও তা কার্যকর করতে সরকারও তেমন গা করেনি বা করছে না৷''
সমাজবিজ্ঞানী দেবদাস ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘অদ্ভুত লাগে যখন দেখি, মেয়েরা লেখাপড়া শিখে যথেষ্ট ভালো রোজগার করছে, বাড়ির লোকেরা তার রোজগার করা টাকার দিকে হাত বাড়াচ্ছে, অথচ তাকে উপযুক্ত মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত তারা৷ এমনকি শিক্ষিত মহিলাদের মধ্যেও মরচে পড়া পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাটা রয়ে গেছে৷ অর্থাৎ মেয়েরা বাড়ির কাজ করবে আবার রোজগারও করবে৷ মনে হয়েছিল শিক্ষার প্রসারে পুত্র-কন্যার আনুপাতিক ব্যবধান কমবে, মেয়েরা তার যোগ্য সম্মান পাবে৷ কিন্তু তা হচ্ছে কৈ? আপাত উন্নত রাজ্য গুজরাট, মহারাষ্ট্র, দিল্লি বা পাঞ্জাবে ঐতিহাসিকভাবে পুত্র-কন্যার ব্যবধানটা স্পষ্ট৷ অথচ এই নিয়ে বড় কোনো সামাজিক আন্দোলনই বা হচ্ছে না কেন? রাজনৈতিক দলগুলিও এইসব সামাজিক ইস্যু ঘাঁটাতে চায় না, পাছে তাদের ভোটব্যাংকে টান পড়ে৷''
উল্লেখ্য, পরিসংখ্যান বলছে, লিঙ্গ ব্যবধান প্রতি হাজারে দিল্লিতে ৮৭১, মহারাষ্ট্রে ৮৯৪, পাঞ্জাবে ৮৪৬, গুজরাটে ৮৯০৷ এই প্রবণতা বিপরীতমুখী করতে এবং সমাজের বিবেকবোধ জাগাতে প্রধানমন্ত্রী মোদী শুরু করেছেন বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও প্রকল্প৷
কিন্তু সমস্যার ব্যাপ্তি যতটা, তার সমাধানও তত কঠিন৷ ধন্দ লাগে মুসলিম সমাজে কোরান অনুসারে মেয়ের বাড়িকে পণ দিতে হয় না, দিতে হয় ছেলের বাড়িকে যাকে বলে মেহের৷ কোরান মতে ভ্রুণ হত্যা নিষিদ্ধ৷ তাতেও তো উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে ছেলের তুলনায় মেয়ের আনুপাতিক হার কমের দিকে যাচ্ছে কেন? তবে তুলনামূলকভাবে হিন্দু সমাজ থেকে ভালো৷ হাজার প্রতি ৯৫১৷ তবে নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনের মতে, প্রতি বছর হাজার হাজার মেয়ে সন্তান পাচার হয়ে যায় বা নিখোঁজ হয়ে যায়৷ সংখ্যার দিক থেকে ছেলে ও মেয়ে সন্তানের ব্যবধান বেড়ে চলার এটাও একটা বড় কারণ৷
আপনার স্ত্রী, কন্যা বা পুত্রবধু গর্ভবতী হলে আপনি কি অনাগত সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করতে চাইবেন? লিখুন নীচের ঘরে৷