ভারতীয় ইউটিউবাররা এখন শক্তিশালী গোষ্ঠী
৩ মার্চ ২০২৩পাড়ার চায়ের দোকান থেকে দর্শনীয় স্থান-- ভারতের যে কোনো প্রান্তে পৌঁছালেই দেখা যাবে হাতে ক্যামেরা অথবা হাইএন্ড মোবাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষ৷ হয় তারা জনগণকে প্রশ্ন করছেন, অথবা হাঁটতে হাঁটতে নিজের মনেই বলে যাচ্ছেন অনেক কথা৷ কিছুদিন আগেও ভারতের রাস্তায় এমন দৃশ্য কল্পনা করা যেতো না৷ একমাত্র সাংবাদিকেরাই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে খবর সংগ্রহ করতেন৷ হাতে বুম দেখলেই সকলে সাংবাদিকের পরিচয় বুঝে নিতেন৷ কিন্তু এখন সেই সাংবাদিকদের টপকে বাজারে চলে এসেছেন ইউটিউবাররা৷ সমাজ মাধ্যমে তাদের কেউ খবরের চ্যানেল চালান, কেউ চালান ভ্রমণের চ্যানেল, কেউ খাবারের রিভিউ করেন তো কেউ নিছক নাচ-গান৷ কীভাবে জন্ম হলো এই গোষ্ঠীর?সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম আছে, যেখানে নিজের চ্যানেল তৈরি করে নিজের কথা বলা যায়৷ তবে ভারতে চ্যানেল তৈরির ক্ষেত্রে এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় ইউটিউব৷ গত ১০ বছরে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়েছে ইউটিউব চ্যানেল৷ দেশে যখন চাকরির বাজারে আকাল, কোভিডের সময় ১২ কোটি মানুষের চাকরি গেছে, তখন বেকার যুবক-যুবতীরা নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছেন নিজেদের রোজগারের ব্যবস্থা৷ ইউটিউব চ্যানেল যদি জনপ্রিয় হয়, মাসে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত রোজগার করা সম্ভব৷
একটা হিসেব দেওয়া যাক৷ একবছর চলার পর একটি ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার যদি এক হাজার হয় এবং বছরে চ্যানেলের ওয়াচিং আওয়ার হয় চার হাজার ঘণ্টা, তাহলে ইউটিউব সেই চ্যানেলকে অর্থ দিতে শুরু করবে৷ কীভাবে দেবে? ইউটিউব তখন ওই চ্যানেলের ভিডিওতে বিজ্ঞাপন বসাতে শুরু করবে, যার শেয়ার পাবেন ইউটিউবার৷ যার চ্যানেল যত বেশি জনপ্রিয়, তার টাকার শেয়ারও তত বেশি৷ লাখ লাখ ভিউ যে চ্যানেলে, সেখানে একেকটি ভিডিও থেকে ৬০০ থেকে ১০০০ ডলার সপ্তাহে রোজগার হয়৷ ফলে মাসের রোজগার পৌঁছে যায় পাঁচ লাখের উপর৷
এখানেই শেষ নয়, বড় বড় চ্যানেল নিজেরাও বিজ্ঞাপন দিতে পারে ইউটিউব ভিডিওতে৷ সেক্ষেত্রে লাভের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়৷ আর এই কারণেই ভারতে ইউটিউব এখন এতটা জনপ্রিয়৷
শুধু রোজগার নয়, স্বাধীনতাও
সম্প্রতি ভারতের প্রথম সারির অন্তত পাঁচজন সাংবাদিক চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করেছেন৷ বরখা দত্ত, রবিশ কুমাররাও এই রাস্তায় হাঁটছেন৷ কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে তারা দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন তুলছিলেন৷ সব ছেড়ে তারা এখন নিজেদের ইউটিউব চ্যানেল চালাচ্ছেন৷ নিজেদের চ্যানেলে তরুণ সাংবাদিকদের চাকরি দিচ্ছেন৷ ফলে ভারতীয় সংবাদজগতে ইউটিউব কার্যত একটি সমান্তরাল প্রতিষ্ঠানের জায়গা নিয়ে ফেলেছে৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়৷
ইউটিউব যেমন সমাজকে বদলেছে, তেমনি নিজেও বদলেছে৷ ভাইরাল ভিডিওর নামে এমন বহু জিনিস ইউটিউবে গেছে, যার মান এবং অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়৷ কপিরাইটেড গান, ছবি নাগাড়ে ব্যবহার করেছেন ইউটিউবাররা৷ ইউটিউব কর্তৃপক্ষ কিছু বলেননি৷ গত কয়েক বছরে এই বিষয়গুলির দিকে নজর দিয়েছে ইউটিউব৷ এক ইউটিউব বিশেষজ্ঞের হিসেব, গত এক বছরে অন্তত এক তৃতীয়াংশ ভারতীয় ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ হয়েছে৷ কারণ, ইউটিউব বিভিন্ন কারণে তাদের স্ট্রাইক করেছে৷ এখন ঘরের ভিতরের কোনো ভিডিও যদি আবহে কোনো পরিচিত গান চলে- ইউটিউব স্ট্রাইক দেয়৷ ফলে ইউটিউবারদেরও বেগ পেতে হচ্ছে৷ সমস্ত কনটেন্ট অরিজিনাল তৈরি করতে হচ্ছে৷ যারা পারছেন, তারা টিকে থাকছেন৷ যারা পারছেন না, রোজগারের এই নতুন মাধ্যম থেকে তারা বিদায় নিতে বাধ্য হচ্ছেন৷
সরকারের অবস্থান
ইউটিউব চ্যানেল নিয়ে খানিকটা সন্দিহান দেশের সরকারও৷ মূল স্রোতের সংবাদমাধ্যমকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, ইউটিউবারদের সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না৷ রোজগারের ক্ষেত্রে তারা সরকারের মুখাপেক্ষীও নয়৷ ফলে ইউটিউব চ্যানেল থেকে বিস্ফোরক সব খবর প্রকাশ পাচ্ছে৷ কখনো তা গুরুত্বপূর্ণ, কখনো তা স্পর্শকাতরও বটে৷ কীভাবে এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা নিয়ে নানা ভাবনা আছে সরকারের৷ আইন তৈরির চেষ্টাও চলছে৷ কিন্তু আইন দিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে আদৌ বেঁধে রাখা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়৷