ব্রিটেনে উপনির্বাচনে ইউকিপ-এর জয়
২১ নভেম্বর ২০১৪ইউকিপ-এর জয় ব্রিটেন ও ইউরোপের ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ রচনা করেছে৷ এ নিয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই বললে চলে৷ কারণ এর ফলে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল৷ বিদেশি ও ইইউ-বিরোধী এই দলটির প্রতি ভোটারদের সমর্থনের পেছনে দু'টি কারণ রয়েছে বলে মনে হচ্ছে৷ প্রথমত, পূর্ব ইউরোপ থেকে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করার জোরালো ডাক দিচ্ছে ইউকিপ৷ ইইউ-র অভ্যন্তরীণ বাজারের মধ্যে অবাধ বিচরণের অধিকার নিয়েই তারা প্রশ্ন তুলছে৷ দ্বিতীয়ত, ব্রিটেনের কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রতিষ্ঠিত দলগুলি সম্পর্কেও অনীহা দেখা যাচ্ছে৷ রচেস্টার উপনির্বাচনে যা ঘটেছে, আগামী বছরের মে মাসে জাতীয় নির্বাচনে তার পুনরাবৃত্তি হলে দেশের দুটি প্রধান দলের কোনোটি সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না৷ এ নিয়ে তেমন সন্দেহ থাকতে পারে না৷ ইউকিপ-এর ইউরোপ-বিরোধিতার ঢেউয়ে রক্ষণশীল দল জিম্মি হয়ে পড়েছে৷ ইউকিপ-কে নকল করতে ও দলের মধ্যে দক্ষিণপন্থিদের সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ২০১৭ সালে ইইউ-তে থাকার বিষয়ে একটি গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷ তার উপর রক্ষণশীল দলে ক্যামেরন-এর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী বরিস জনসন আরও দক্ষিণপন্থি অবস্থান নিয়েছেন৷ আগামী মে মাসে রক্ষণশীল দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে তিনি নেতৃত্বের দাবি করতে পারেন৷
লেবার পার্টির অবস্থাও ভালো নয়৷ গত এক দশকে ইউরোপ সম্পর্কে তাদের অবস্থান অস্পষ্ট থেকেছে৷ জনমত সমীক্ষা অনুযায়ী তাদের ক্ষমতায় আসতে হলে বামপন্থি ও ইউরোপপন্থি স্কটিশ ন্যাশানাল পার্টি-র সমর্থন লাগবে৷ এসএনপি অবশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছে, যে তারা স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে আবার গণভোট আয়োজন করতে চায়৷ লেবার পার্টিকে ইউরোপপন্থি লিবারাল ডেমোক্র্যাট দলেরও সাহায্য লাগবে৷ রচেস্টারের উপনির্বাচনে তাদের অবশ্য ভরাডুবি হয়েছে৷
এই প্রেক্ষাপটে দুটি সম্ভাব্য চিত্র উঠে আসছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে এক গ্রেট ব্রিটেন অথবা ‘লিটল ইংল্যান্ড'৷ কারণ ততদিনে ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যও ভেঙে পড়বে৷ দুটি মধ্যে একটি সম্ভাবনাও যদি বাস্তব রূপ নেয়, তাতে ইউরোপেরই বড় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে৷ তবে এটা মনে রাখতে হবে, এমন পরিস্থিতি এড়ানো এখনো সম্ভব৷ চরম দক্ষিণপন্থিদের সামলাতে ক্যামেরন বার বার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তিগুলি নিয়ে নতুন করে দরাদরি করতে চান৷ জার্মানির আঙ্গেলা ম্যার্কেল সহ ইউরোপের অনেক নেতা তাঁর এই জ্বালাময়ী কথাবার্তা ও হাবভাবের কারণে বিরক্ত হয়ে উঠছেন৷ ব্রিটেন বরং ইইউ ছেড়ে চলে যাক – এমন হতাশ মনোভাবই বেড়ে চলেছে৷ এটা বোঝা তেমন কঠিন নয়৷ তবে তা সত্ত্বেও সেটা হবে মস্ত এক ভুল৷
ইউরোপীয় নেতাদের উচিত, ব্রিটেনের আগামী সরকারের সঙ্গে ইউরোপে সংস্কারের বিষয়ে কথা বলা৷ কারণ ব্রিটেনের কিছু সমালোচনা সত্যি ন্যায্য৷ সেই বিষয়গুলির নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন৷ তাছাড়া সাম্প্রতিক ইউরোপীয় নির্বাচনে দেখা গেছে, যে শুধুমাত্র উত্তর পশ্চিম উপকূলের তর্কবাগীশ ব্রিটিশরাই অসন্তুষ্ট নন৷ ইউরোপের অনেক মানুষ মনে করেন, ইউরোপীয় স্তরে গণতান্ত্রিক কাঠামোর অভাব রয়েছে এবং ধীরে ধীরে অনেক ক্ষমতা ব্রাসেলস-এর হাতে চলে যাচ্ছে৷ তাছাড়া বেশ কিছু নীতির ক্ষেত্রে ইউরোপে ঐকমত্যের প্রয়োজন রয়েছে – যেমন অভিবাসন বা সামাজিক ভাতার লোভে পর্যটনের প্রবণতা৷ তা না করলে সামাজিক ভাতার কাঠামো এই চাপ সহ্য করতে পারবে না৷ অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রতিযোগিতার পথের বাধাগুলিও দূর করতে হবে৷ তার চেয়েও বড় কাজ হবে ইইউ-র ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা৷
রচেস্টারের ঘটনা সম্ভব হয়েছে, কারণ আরও বেশি মানুষ মনে করছেন যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংস্কার একেবারেই সম্ভব নয়৷ ২০০৮ সাল থেকে ব্রিটেনের অর্থনীতির উন্নতির ফলে তারা মনে করছেন, যে ব্রিটেন একা থাকলে আরও ভালো ফল করবে৷ সেটাও একটা বড় ভুল৷ ‘ডেয়ার স্পিগেল' পত্রিকায় হিলারি মান্টেল সম্প্রতি লিখেছেন, ব্রিটিশরা তাদের দ্বীপের মানসিকতা, তীব্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে৷ জার্মানির ম্যার্কেল সহ ইউরোপীয় নেতাদের উচিত ইইউ-র সমালোচকদের উত্থাপিত বিষয়গুলি নিয়ে খোলামেলা কথা বলা, বিতর্ক চালানো এবং এমন উত্তর বার করা, যা ইউরোপের সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে৷ ব্রিটিশরাও যেন বুঝতে পারে, যে সফল ইউরোপীয় ইউনিয়ন আসলে তাদেরও স্বার্থে প্রয়োজনীয়৷