নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা
৫ জানুয়ারি ২০১৪রবিবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ করা হয়৷ নির্বাচন প্রতিহতে হরতাল, অবরোধ দিয়ে সক্রিয় ছিল বিরোধী ১৮ দল৷
রবিবার সকালে নির্বাচন শুরুর আগে থেকেই শুরু হয় সহিংসতা৷ আর এই সহিংসতা চলে ভোট গ্রহণের পুরো সময় ধরে৷ নির্বাচন বিরোধীরা ভোটকেন্দ্রে হামলা চালায়৷ আর তা প্রতিহতে সহিংসতা আরো বিস্তৃত হয়৷ এই সহিংসতায় একজন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারসহ সারা দেশে ১২ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷
রংপুর, বগুড়া, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, পাবনা, গাইবান্ধা, নীলফামারী, পিরোজপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়, ভোটকেন্দ্রে হামলা, ব্যালট পেপার ও বাক্স ছিনতাই, নির্বাচনি কর্মকর্তাদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা, ভোটকেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণের সহিংস ঘটনা ঘটেছে৷ আর আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের লোকজনের বিরুদ্ধে কোথাও কোথাও ভোট ছিনতাইয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে৷
ভোটের আগের দিন থেকে ভোট গ্রহণের দিন রবিবার পর্যন্ত ঢাকার বাইরে কমপক্ষে দেড়শ ভোটকেন্দ্রে হামলা হয়েছে৷ আর ভোটকেন্দ্র হওয়ায় পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ১১১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ সেসব প্রতিষ্ঠানের নতুন বইও পুড়ে গেছে৷
ঢাকায়ও কয়েকটি কেন্দ্রে সহিংসতা এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে৷ আর ঢাকাসহ সারা দেশেই ভোটার উপস্থিতি ছিল কম৷ কোনো কোনো কেন্দ্র দুপুর পর্যন্ত বলতে গেলে ফাঁকাই ছিল৷ তবে ভোটার উপস্থিতি ছিল অনেক কম৷ ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ২৬ শতাংশ৷ এবার তার চেয়ে পরিস্থিতি ভাল নয়, বলে জানান নির্বাচনি কর্মকর্তারা৷
নির্বাচন কমিশন সহিংসতা এবং ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়ার কারণে ১৩৯টি ভোটকেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত করেছে৷
বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান ব্রতী-র পরিচালক রঘুনাথ রাহা ডয়চে ভেলেকে জানান, সকালের দিকে ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম৷ তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে কিছু ভোটার উপস্থিতি বেড়েছে৷ কিন্তু তা খুব বেশি নয়৷ তিনি জানান সহিংসতার কারণে যারা আগ্রহী তাঁরাও ভোটকেন্দ্রে যাননি ভয়ে৷ নির্বাচন প্রতিহত করতে বিরোধী দল তৎপর থাকায় তার প্রভাব পড়েছে৷ আর একতরফা নির্বাচন হওয়ায় ভোটাররাও ভোট দিতে তেমন আগ্রহী হয়নি৷
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ, জানিপপ-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে জানান, ভোটার উপস্থিতি কম হবে এটাই স্বাভাবিক৷ কারণ এটি একটি ভিন্ন ধরণের নির্বাচন৷ একতরফার সঙ্গে আছে ব্যাপক সহিংসতা এবং বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধ৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, এই নির্বাচন নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই৷ কারণ এরইমধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন৷ প্রায় ৫২ ভাগ ভোটারের তাই ভোট নেই৷ আর এই নির্বাচন শুধু বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী ১৮ দলীয় জোটই বর্জন করছে না৷ সিপিবি, গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং বিকল্পধারার মতো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে৷ ভারত ছাড়া আর কোনো দেশের সমর্থন নেই৷ মানুষ এই নির্বাচনকে গ্রহণ করেনি৷ তাই তারা ভোটকেন্দ্রে যায়নি বলে মনে করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ৷ আর সরকারপক্ষ ভোটের পরিমাণ বেশি দেখাতে ভোটকেন্দ্র দখল করা হয়েছে৷ বিরোধী দল ভোট ঠেকাতে সহিংসতা করেছে৷ সব মিলিয়ে এটি একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনে পরিণত হয়েছে৷
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘একটি অর্থহীন, সবার কাছে অগ্রহণযোগ্য ও হাস্যকর নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার দেশবাসীর কাছে গণধিকৃত হয়েছে৷'' তিনি বলেন দেশবাসী প্রহসনের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করায় এই সরকার সম্পূর্ণরূপে অবৈধ হয়ে গেছে৷ এই ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচন জাতির কলঙ্ক হয়ে থাকবে৷
তবে নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ বলেছে আওয়ামী লীগ৷ যোগাযোগমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ এবং নিরপেক্ষ হয়েছে৷ তবে কিছু এলাকায় সহিংসতার কথা স্বীকার করেন তিনি৷ তিনি বলেন ভোটার উপস্থিতি নয়, নির্বাচন নিয়মকানুন মেনে হয়েছে কিনা, তাই দেখার বিষয়৷
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু দাবি করে বলেছেন, বিরোধী দল এই নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে৷ তিনি বলেন যেসব এলাকায় সহিংসতার কারণে ভোট নেয়া যায়নি সেসব এলাকায় ২৪ জানুয়ারির মধ্যে ভোট নেয়া হবে৷
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৭টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ১২টি দল এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে৷ আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ২৫টি দল এই নির্বাচন বর্জনের পর প্রতিহতে একই সঙ্গে হরতাল আর অবরোধ পালন করছে৷
রোববারের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনের প্রার্থীরা আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন৷ তাই নির্বাচন হয়েছে বাকি ১৪৭ আসনে৷ এতে মোট ভোটার ৪,৩৯,৩৭,৯৩৭ জন৷ প্রার্থী ৩৯০ জন৷ অর্ধেকেরও বেশি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় মোট ভোটারের ৫২ ভাগের ভোট দেয়ার সুযোগ ছিল না৷ এমনকি এই কারণে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীও ভোট দিতে পারেননি৷
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক ছিলেন ৫৮৫ জন৷ আর এবার ভারত ও ভুটান থেকে দু'জন করে মোট ৪ জন পর্যবেক্ষক এসেছেন৷