ব্যাংক হিসাব তলব: কারা করে, কেন করে?
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১তাছাড়া অন্য পেশাজীবীদের ক্ষেত্রেও কি একইভাবে ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়?
বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) প্রতিষ্ঠা হয় ২০০২ সালে, অ্যান্টি মানি লন্ডারিং ডিপার্টমেন্ট নামে৷ ২০১২ সালে এটা বিএফআইইউ নামে কাজ শুরু করে৷ তাদের ১৪ ধরনের কাজের ম্যান্ডেট থাকলেও তারা মূলত সন্দেহজনক লেনদেন, জঙ্গি অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং নিয়ে কাজ করে৷ তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তথ্য আদান-প্রদানও তাদের কাজ৷ তারা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের ম্যান্ডেট প্রাপ্ত৷ তাদের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আরো ১৫ ধরনের প্রতিষ্ঠান তথ্য দিতে আইনত বাধ্য৷
তারা নিজেদের উদ্যোগে সন্দেহজনক ব্যাংক হিসেবের তথ্য যেমন নেয়, তেমনি সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের অনুরোধের ভিত্তিতেও তথ্য সংগ্রহ করে দেয়৷ তবে আইন অনুযায়ী তারা জনসমক্ষে এই তথ্য প্রকাশ করে না৷ আর আইনগত ব্যবস্থাও নেয় না৷ আইনগত ব্যবস্থা নেয়, যাদের নেয়ার আইনগত ম্যান্ডেট আছে, তারা৷
বিএফআইইউ -এর এক সাবেক নির্বাহী পরিচালক জানান, দুদক, সিআইডি, পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুরোধে তারা ব্যাংক হিসাবের তথ্য সংগ্রহ করেন৷ এই তথ্য ওই সংস্থাগুলো কাজে লাগায়৷ আবার নিজেরাও সন্দেহজনক মনে হলে তথ্য সংগ্রহ করে ব্যবস্থা নিতে ওই সংস্থাগুলোকে দেন৷ আর বিএফআইইউ কাজ করে ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন এবং ২০০৯ সালের অ্যান্টি টেররিজম আইনের অধীনে৷ আইনটি ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়েছে৷
১১ সাংবাদিকের আগেও পেশাজীবীদের ব্যাংক হিসাব তলবের নজির আছে৷ ২০২০ সালে দুদকের অনুরোধে ৪০০ ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছিল৷ ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি এবং টেন্ডার ও চাঁদাবাজির ঘটনায় ওই হিসাবগুলো তলব করা হয়৷ ওই ৪০০ জনের মধ্যে রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা, ঠিকাদার ও ব্যবসায়ী আছেন৷ তবে তখন তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি৷ দুদকের বাইরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও তথ্য দেয়া হয় তখন৷ ২০১৪ সালে দুই শতাধিক চিকিৎসকের একযোগে ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছিল৷ প্রকৃত আয় গোপন করে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার অভিযোগে তাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছিল৷
গত ১২ আগস্ট অভিনেত্রী পরীমনি, মডেল পিয়াসা ও হেলেনা জাহাঙ্গীরসহ আট জনের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়৷ সম্প্রতি ইভ্যালি ও আলেশা মার্টসহ ১০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান ও এমডির ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে৷
১১ জন সাংবাদিক নেতার যে ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে তাতে হিসাব খোলার তথ্য, শুরু থেকে হালনাগাদ লেনদেনের বিবরণী, স্থিতি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র- সবকিছু চাওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোর কাছে৷ এই তলবের চিঠিটি ডয়চে ভেলের হাতে রয়েছে৷ তাতে দেখা যায়, একটি নির্ধারিত ছকে একসঙ্গে ১১ জনের ব্যাপারেই তথ্য চাওয়া হয়েছে৷ তাতে প্রত্যেকের সাংগঠনিক পরিচয় এবং দলীয় পরিচয়ও উল্লেখ করা হয়েছে৷ তাদের পাসপোর্ট এবং জাতীয় পরিচয় পত্রের নাম্বারও উল্লেখ করা হয়েছে৷
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান বলেন, ‘‘আমরা এই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করছি৷ কারণ, আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আমার ব্যক্তিগত৷ সংগঠনের নামে নয়৷ কিন্তু সংগঠনের পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে৷ এটা করে সাংবাদিকদের ভয় দেখানো ও চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে৷ এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে৷ আমরা তাই চিঠি প্রত্যাহার এবং আমাদের ব্যাংক হিসাবে কী পাওয়া গেল তা প্রকাশের দাবি জানিয়েছি৷ ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমার সম্পদের হিসাব দিতে কোনো আপত্তি নেই৷’’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা অ্যাকাউন্টগুলো নজরদারিতে রাখি৷ কোনো অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক লেনদেন হলে বা সন্দেহজনক লেনদেন হলে তা আমরা চেক করি৷ আমরা আদালতের নির্দেশ ছাড়া কারো অ্যাকাউন্ট জব্দ বা ফ্রিজ করতে পারি না৷ তবে দুদক, সিআইডি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা গোয়েন্দ সংস্থা এটা পারে৷ আমরা নিজেরাও সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করি৷ আবার দুদক, সিআইডি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থা চাইলেও আমরা হিসাব তলব করে তাদের তথ্য দিই৷ এটা তারাও সরসরি করতে পারে৷ সেই ম্যান্ডেট তাদের আছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কাছে যারা তথ্য চান, তারা যদি দেখেন আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার উপাদান আছে, তারা তা নেন৷ আবার আমরাও প্রয়োজন হলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সহায়তা নিই৷’’
১১ সাংবাদিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট কেন একসঙ্গে তলব করা হলো জানতে চাইলে বিএফআইইউ ভারপ্রাপ্ত প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘‘এখন এটা নিয়ে কথা বলার সময় নয়৷’’
জানা গেছে, ১১ জন সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা৷ তাদের চাহিদার ভিত্তিতেই হিসাব তলব করা হয়েছে৷ একজন সাবেক নির্বাহী পরিচালক জানান, বিএফআইইউ তথ্য সংগ্রহ করে গোয়ন্দো সংস্থাকে দেবে৷ গোয়েন্দা সংস্থা আবার এটা তদন্ত করবে৷ যদি কোনো অভিযোগ সঠিক প্রমাণিত হয় তাহলে তারা মামলা করবে৷
তবে ১১ জন সাংবাদিকের একযোগে ব্যাংক হিসাব তলবকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মনে করেন না টিআইবির নির্বাহী পরিচালব ড. ইফতেখারুজ্জামান৷ তিনি বলেন, ‘‘সরকার চাইলে অবশ্যই আইনের মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পদের হিসাব বা ব্যাংক হিসাব তলব করতে পারে৷ কিন্তু একটি পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের হিসাব যেভাবে তলব করা হয়েছে, তার মধ্যে তাদের হেয় করার উদ্দেশ্য থাকতে পারে৷ এটা আমার কাছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মনে হয়নি৷ তাছাড়া এটা শুরু করার কথা ছিল এনবিআরের৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করতে আমা দেখেছি৷ এটা কখনো নিরপেক্ষভাবে করা হয়েছে, আবার কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষকে হয়ারানি করতে করা হয়েছে৷’’
আর তদন্ত শেষ হওয়া এবং অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগে তাদের নাম প্রকাশ কাম্য নয় নয় বলেও মনে করেন তিনি৷
প্রসঙ্গত, বিএফআইইউ পরিচালিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নরের নেতৃত্বে৷ ডেপুটি হেডের দায়িত্ব পালন করেন একজন নির্বাহী পরিচালক৷ তবে অপারেশনাল হেড হলেন একজন জিএম৷ এই টিমে মোট সদস্য ৬৯ জন৷
বিএফআইইউ আন্তর্জাতিক ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স সংস্থা এগমন্ট গ্রুপের সদস্য৷