বেআইনি নির্মাণ নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেই ক্ষোভ
২১ মার্চ ২০২৪দক্ষিণ কলকাতার গার্ডেনরিচে নির্মীয়মাণ ভবন ভেঙে পড়ার পর বিরোধীরা নিশানা করেছে তৃণমূল কংগ্রেসকে। শুধু বিরোধী শিবির নয়, নিজেদের ঘরেই ক্ষোভের আঁচ টের পাচ্ছে শাসক শিবির।
ডেপুটি মেয়রের তীর
কলকাতা পুরসভার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর তিনি স্বাস্থ্য বিভাগের মেয়র পারিষদ পদে রয়েছেন। সাধারণভাবে সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খোলেন না তিনি। সেই অতীন গার্ডেনরিচ বিপর্যয়ের পর কার্যত নিশানা করেছেন তার দলের মেয়রকে।
কলকাতা পুরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিম এই ঘটনার জন্য তার কিংবা স্থানীয় কাউন্সিলর শামস ইকবালের দায়িত্ব স্বীকার করেননি। পুর আধিকারিকদের শোকজ করেছেন তিনি। গতকাল পুরসভার বৈঠকে আধিকারিকদের কড়া সমালোচনাও করেছেন ফিরহাদ।
বিরোধীরা এজন্য মেয়রকেনিশানা করেছেন কার্যত একই সুরে কথা বলেছেন অতীন ঘোষ। ডেপুটি মেয়রের বক্তব্য, "যে চেয়ারে বসে, নিয়ন্ত্রণের দায় তার। প্রোমোটারের সঙ্গে কাউন্সিলর সব সময় থাকলে দায় এড়ানো যায় না।"
কাউন্সিলর শামস দাবি করেছেন এই অবৈধ নির্মাণ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। তার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়র বলেছেন, বেআইনি নির্মাণের কথা কাউন্সিলরের জানার কথা নয়। এটা জানবে পুরসভার বিল্ডিং বিভাগ।
এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নন ডেপুটি মেয়র তিনি বলেন, "আমি মিডিয়ায় শুনেছি, কাউন্সিলার বলছেন, জানেন না। আমার ওয়ার্ড হলে আমাকেও ব্যাখ্যা দিতে হতো। গার্ডেনরিচের বেআইনি নির্মাণে শৃঙ্খলা আনতে কড়া আইন অত্যন্ত জরুরি।"
বরো চেয়ারম্যানের স্বীকারোক্তি
কলকাতা পুরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড একটি বরোর অধীনে থাকে। গার্ডেনরিচ এলাকা পড়ে ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ড ১৫ নম্বর বরোর অন্তর্গত।
এই বরোর চেয়ারম্যান, প্রবীণ তৃণমূল নেতা রঞ্জিত শীল বিস্ফোরক দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, "১০ শতাংশ ভবন সঠিক প্ল্যান মেনে হয়। বাকি ৯০ শতাংশ নির্মাণের বিল্ডিং প্ল্যান থাকে না। যে ১০ শতাংশের বৈধ প্ল্যান থাকে, সেখানেও পড়ে অবৈধ নির্মাণ করা হয়।"
তৃণমূল নেতার দাবি, "যে ভবন চারতলা নির্মাণের অনুমোদন পুরসভা থেকে নেয়া হয়, সেখানে পাঁচতলা তৈরি করা হয়। ওই বাড়তি তলের কোন অনুমোদন থাকে না, অর্থাৎ সেটা বেআইনি।"
রঞ্জিত শীলের বক্তব্যকে হাতিয়ার করে বিরোধীরা বলছে, গার্ডেনরিচে যে বেআইনি নির্মাণের ব্যবসা চলছে, তা তৃণমূল নেতার বক্তব্যই স্পষ্ট।
মেয়রের মন্তব্য, "এই পুর বোর্ডের আমলে ৮০০ র বেশি বেআইনি ভবন ভাঙা হয়েছে। এর মধ্যে গার্ডেনরিচ এলাকাতেই রয়েছে ২০টির বেশি বাড়ি। কিন্তু বেআইনি নির্মাণ একটা সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না।"
নির্মাণ নয় 'শিল্প'
গার্ডেনরিচ এলাকায় একের পর এক অবৈধ নির্মাণের ছবি সামনে এসেছে। একাধিক বহুতল পাশের ভবনের উপর হেলে পড়েছে। কিন্তু চমক জাগিয়েছে একটি সরু পাঁচতলা ভবন।
যেখানে বহুতল ভেঙে পড়েছে, তার কাছেই রয়েছে একটি অদ্ভুত দর্শন বাড়ি। নিয়মানুযায়ী দুটি বহুতলের মধ্যে কমপক্ষে চার ফুট জায়গা ফাঁকা রাখা উচিত। কিন্তু, একফালি জায়গার মধ্যেই গজিয়ে উঠেছে একটি বহুতল যা কার্যত শিল্পের মর্যাদা পাচ্ছে!
চার ফুট জায়গায় উপর তৈরি ভবনের প্ল্যান কারা অনুমোদন করল? স্থানীয় কাউন্সিলর কি এই বাড়িটি দেখতে পাননি? এ ধরনের প্রশ্ন উঠছে।
চেয়ারম্যানের ক্ষোভ
কলকাতা ঘটনা খুলে দিয়েছে প্যান্ডোরার বাক্স। বিভিন্ন পুরসভা এলাকা থেকে বেআইনি নির্মাণের খবর সামনে আসছে। এর মধ্যে কলকাতার পার্শ্ববর্তী বিধাননগর পুরসভা রয়েছে। তৃণমূল পুর বোর্ডের চেয়ারম্যানই এখানে অভিযোগ তুলেছেন। তার বক্তব্যের বিরোধিতা করেছেন মেয়র।
চেয়ারম্যান সব্যসাচী দত্তের দাবি, "দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ নির্মাণ চলে আসছে। বিধাননগর পুর এলাকার সঙ্গে নতুন যে সব অঞ্চল যুক্ত হয়েছে, সেখানে বেআইনি নির্মাণের সংখ্যা অনেক বেশি। আদালতে রাজ্য সরকারের হলফনামা অনুযায়ী, মাত্র দুটি ওয়ার্ডে ৩৩৩টি অবৈধ নির্মাণ রয়েছে। এ নিয়ে আমি অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি। তাই আমাকে মামলা করতে হয়েছে।"
সব্যসাচী এর আগে বিধাননগরের মেয়র পদে ছিলেন। বিধাননগরের বর্তমান মেয়র কৃষ্ণা চক্রবর্তী তার জবাবে বলেন, "এটা শুধু আমার নয়, একইসঙ্গে ৪১ জন কাউন্সিলর ও চেয়ারম্যানেরও দায়িত্ব। কোনো অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা সংশ্লিষ্ট বিভাগে সেটি পাঠাই। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হয়।"
প্রশ্নে পরিবেশ
অবৈধ নির্মাণের রমরমার কাহিনি যত সামনে আসছে, ততই বাড়ছে পারস্পরিক দোষারোপ। তৃণমূল দুষছে সাবেক বাম আমলকে। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে তৃণমূলের এক দশকের শাসনে কী ব্যবস্থা নেয়া হলো?
এসবের মধ্যে চাপা পড়ে যাচ্ছে পরিবেশ সংক্রান্ত প্রশ্নটি। ভবিষ্যতে এর ফল ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা পরিবেশবিদদের।
তাদের মতে, নির্মাণের পুর অনুমতি মানে শুধু পরিকাঠামো তৈরিতে অনুমোদন দেয়া নয়। আবর্জনা ব্যবস্থাপনা, নিকাশি, ভূগর্ভস্থ জলের স্তর, গাছ কাটা, জলাশয় ভরাট, এমন একগুচ্ছ বিষয় বিবেচনায় রাখার কথা, যা আদৌ ভাবা হয় না।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জলসম্পদ বিভাগ ও রাজ্য সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি দপ্তরের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গার্ডেনরিচ সহ কলকাতা বন্দর এলাকার পাঁচটি ওয়ার্ডে ২৭০টি পুকুর ভরাট করা রয়েছে। ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৪০টি পুকুর বর্তমানে দুটিতে এসে ঠেকেছে।
পরিবেশকর্মী নব দত্ত বলেন, "শহর বাড়ছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে। শহর কোনদিকে বাড়বে, সেটা আউটলাইন ডেভলপমেন্ট প্ল্যানে বলা আছে। কিন্তু সেটা এরা মানছে না। বিশ্বে যে সমস্ত মেগাসিটি আছে, তার মধ্যে আমাদের এখানে গরম ও আর্দ্রতা সবচেয়ে বেশি বাড়ছে। বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা বাড়ছে। "
এর ফলে ক্রমশ কমছে কলকাতার সবুজ অংশ, বাড়ছে কংক্রিটের জঙ্গল। তিনি বলেন, "দেশের শহরগুলির মধ্যে কলকাতায় মুক্ত এলাকার পরিমাণ অনেকটাই কম, মাত্র সাত শতাংশ। দিল্লিতে ২৮, মুম্বইয়ে ৩২ শতাংশ মুক্ত এলাকা। এর ফলে বেহিসেবি নির্মাণে কলকাতার ক্ষতির আশঙ্কা বেশি।"