1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিরোধীদের আত্মঘাতী রাজনীতি ও গণতন্ত্রের বিপদ

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
১২ জানুয়ারি ২০২৪

ভারতে ক্রমশ জমি হারাচ্ছে বিরোধীরা, শক্তিশালী হচ্ছে বিজেপি। এর কী প্রভাব পড়তে পারে ভারতের রাজনীতিতে?

https://p.dw.com/p/4bAv3
ভারতে সরকার বিরোধিতার ক্ষেত্রটা অনেকটা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।
ভারতে সরকার বিরোধিতার ক্ষেত্রটা অনেকটা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।ছবি: Indian National Congress

ভারতে এখন মোট ১৩টি রাজ্যে বিরোধী দলগুলি ক্ষমতায় আছে। আর বিজেপি ক্ষমতায় আছে ১৭টি রাজ্যে। তার মধ্যে উত্তরপূর্ব ভারত ও পুদুচেরি (সাবেক পন্ডিচেড়ি) বাদ দিলে বাকি সব রাজ্যই উত্তর ভারতে। দক্ষিণ ভারতের বড় কোনো রাজ্যে বিজেপি নেই। পূর্ব ভারতও তাদের হাতছাড়া।

আর বিরোধীদের মধ্যে ইন্ডিয়া জোটের বাইরে থাকা তিনটি দল তিনটি বড় রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে। এই দলগুলি হলো ওড়িশায় বিজেডি, অন্ধ্রপ্রদেশে ওয়াইএসআর কংগ্রেস এবং মিজোরামে জেডপিএম।

এর মধ্যে বিজেডি ও ওয়াইএসআর কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে, তারা কেন্দ্রে প্রায় সবসময় নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি-কে সমর্থন করে। আর উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির ঐতিহ্যই হলো, যারা কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকে, তারা তাদের সঙ্গে থাকে। কারণ, এই রাজ্যগুলি কেন্দ্রীয় অর্থসাহায্যের উপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল। এই তিনটি রাজ্যকে বাদ দিলে বিরোধীদের হাতে দশটি রাজ্য থাকে। অর্থাৎ, মাত্র এক তৃতীয়াংশ রাজ্যে বিরোধীরা ক্ষমতায় আছে।

আর লোকসভার দিকে তাকালে বিরোধীদের আরো করণ দশাটা সামনে আসবে। ৫৪৩ সদস্যের লোকসভায় বিজেপি-র সদস্যসংখ্যা হলো ২৯০। আর এনডিএ-কে ধরলে ৩২৩। ইন্ডিয়া জোটের দলগুলির সম্মিলিত শক্তি ১৪২। এর মধ্যে কংগ্রেসের সাংসদসংখ্যা হলো ৪৮ জন। দশ শতাংশ আসনে জিততে পারেনি বলে তাদের দলনেতাকে লোকসভায় বিরোধী নেতার মর্যাদা দেয়া হয়নি। যে কংগ্রেস ৫০ বছর ধরে দেশ চালিয়েছে, তাদের আসনসংখ্যা এখন  ৫০-এও পৌঁছায় না। পরপর দুইটি লোকসভা নির্বাচনে তাদের এই হাল।  নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে পরপর দুইটি নির্বাচনে একেবারেই এঁটে উঠতে পারেনি কংগ্রেস। আগামী নির্বাচনে পারবে কিনা, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

এর প্রতিক্রিয়া ভারতীয় রাজনীতিতে কী হচ্ছে, কী হতে পারে সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি, তার আগে বলে নেয়া দরকার, এমন ছবি এই প্রথম দেখছে না ভারত। এর আগে অনেকবার দেখেছে। স্বাধীনতার পর থেকে কংগ্রেসের প্রবল দাপট ছিল। বিরোধী দলের সাংসদদের সংখ্যা ছিল কম। জরুরি অবস্থার পর ইন্দিরাকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল জনতা পার্টি। তিন বছর পরেই কংগ্রেস ৩৫৩টি আসনে জিতে ক্ষমতায় আসে।

ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর যে নির্বাচন হয়েছিল, সেখানে ৫১৬ সদস্যের লোকসভায় কংগ্রেস পেয়েছিল রেকর্ড ৪০৪টি আসন। বিজেপি সেই সময় পেয়েছিল মাত্র দুইটি আসন। এনটি রাম রাওয়ের তেলুগু দেশম ৩০টি আসনে জিতে সবচেয়ে বড় বিরোধী দলের মর্যাদা পায়। ১৯৮৯ সালে অবশ্য বিজেপি-র সাংসদসংখ্যা দুই থেকে ৮৯ হয়। আবার অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে ২০০৪-এর নির্বাচনে যখন বিজেপি নিশ্চিত ছিল, তারা আবার ক্ষমতায় আসতে চলেছে, তখন ক্ষমতায় আসে ইউপিএ।

ফলে বিরোধীদের এই উত্থান-পতন ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেকবার হয়েছে। একসময় নেহরুর সামনে, পরবর্তীকালে ইন্দিরার সামনে বিরোধীদের খুবই অসহায় লেগেছে। যেমন এখন লাগছে নরেন্দ্র মোদীর সামনে। কিন্তু রাজনীতি এমনই অনিশ্চয়তার খেলা, যেখানে অনেক সময়ই হিসাব মেলে না।

বিরোধীরাও হারের নানারকম অজুহাত দেন। কখনো তারা বলেন, ভোটযন্ত্র বা ইভিএমে কারচুপি করা হয়েছে। কখনো বলেন, ক্ষমতাসীন দল জোর করে ভোটদাতাদের ভোট দিতে দেয়নি ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু তারা ভোটে লড়েন।

ক্ষমতায় আসার পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়মিত রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। কখনো মিছিল করেছেন। কখনো গান্ধী মূর্তির সামনে অবস্থান বিক্ষোভ, কখনো দলকে বিক্ষোভ করতে বলেছেন। উদ্দেশ্য ছিল, ক্ষমতায় থাকার পাশাপাশি বিরোধীদের জায়গাটুকুও দখল করে রাখা। তার আগে বামফ্রন্ট সরকারের নেতারাও এই একই কাজ করার চেষ্টা করতেন।

কেন্দ্রেও আমরা একই প্রবণতা দেখেছি। সংসদে বিরোধীরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, তো বিজেপি সাংসদরাও বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলেন। কখনো কখনো মন্ত্রীরা পর্যন্ত সেই বিক্ষোভে যোগ দিলেন। এমনকী হইহল্লা করে লোকসভার অধিবেশন পর্যন্ত অচল করে দিয়েছেন তারা। তবে যে কারণ নিয়ে তারা এই বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, সেটা হয় বিরোধীশাসিত রাজ্যের বিষয় বা বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নিয়ে। কারণ যাই হোক, তারা বিরোধীদের স্পেস নিতে চেয়েছেন।

সংসদে বিরোধীদের সংখ্যা যে এত কমে গেছে, তার একটা বড় প্রভাব লোকসভা ও রাজ্যসভার কাজের মধ্যেও পড়ছে। বিরোধীদের দাবি সরকার সহজেই অগাহ্য করছে। বিরোধীরা কোনো বিল স্ট্যান্ডিং বা সিলেক্ট কমিটিতে পাঠাতে বললে সরকার তা শুনছে না। হইহট্টগোলের মধ্যে বিল পাস করা সহজ হচ্ছে। এককথায় সরকারের উপর চাপ দেয়ার জায়গায় বিরোধীরা থাকতে পারছেন না। নেহরু, ইন্দিরা, মনমোহনের সময় বিরোধীরা এই চাপ বজায় রাখতেন সংসদে আলোচনা করে। তখন হীরেন মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, জর্জ ফার্নান্ডেজের মতো এমন বক্তা ছিলেন, যাঁদের কথা সকলে মন দিয়ে শুনতেন। ছিলেন জ্যোতির্ময় বসুর মতো সাংসদ যারা একের পর এক নথিপত্র ফাঁস করতেন সংসদে। পরের দিকে গুরুদাশ দাসগুপ্তকে এই কাজ করতে দেখা গেছে। কিন্তু এখন তো বিরোধী দলগুলি আলোচনা  না করে, বিতর্কের পথে না গিয়ে, শুধু সংসদ অচল করে সংবাদমাধ্যমের হেডলাইনে থাকতে চায়। দিনের পর দিন সংসদে কোনো কাজ হয় না।

হতে পারে, এখন তাদের থেকে নরেন্দ্র মোদাী অনেক ভালো বক্তা, হতে পারে, মিডিয়া এখন মোদীকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়, হতে পারে, বিজেপি-র খবর করতে তাদের উৎসাহ অনেক বেশি, কিন্তু বিরোধীদের এই কৌশল আত্মঘাতী হয়ে যাচ্ছে। সরকার খুব সহজে যে কোনো বিল পাস করিয়ে নিচ্ছে। অধিকাংশ সময়ে সেই বিল পাস হচ্ছে বিরোধীদের হইচইয়ের মধ্যে বা বিরোধীশূন্য লোকসভা বা রাজ্যসভায়।

এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সংসদের অধিবেশন নিয়ে আগ্রহ কমছে। আগে বিল নিয়ে, বিতর্ক নিয়ে, লোকসভার প্রশ্নোত্তর নিয়ে একের পর এক খবর হতো। মানুষ জানতেন। এখন তো সংসদের অধিবেশন থাকলেও তা থেকে খবর কম হয়। এরকম চললে স্বাভাবিকভাবেই সংসদের অধিবেশন নিয়ে উৎসাহ কমে যায়।

এই যে কিছুদিন আগে লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে রেকর্ড সংখ্যক বিরোধী সাংসদকে সাসপেন্ড করা হলো অসদাচরণের জন্য, তার কোনো প্রভাব জনমানসে পড়েছে কি? মনে হয় না। কারণ, মানুষ তো এতদিনে জেনে গেছেন, বিরোধীরা লোকসভা ও রাজ্যসভার ওয়েলে নেমে সমানে বিক্ষোভ দেখায়, দেখাতেই থাকে।

এর ফল কি খুব ভালো হচ্ছে?একেবারেই না। ভারতে প্রকৃত জাতীয় দল বা সর্বভারতীয় দল হলো দুইটি। বিজেপি ও কংগ্রেস। কিন্তু বিজেপি পরপর দুই বার কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে। পরপর তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসে জওহরলাল নেহরুর রেকর্ড ছুঁতে পারেন নরেন্দ্র মোদী। এখন তারা নিজেদের আরো বেশি করে শক্তিশালী করছেন। আর কংগ্রেস ততই শক্তি হারাচ্ছে। লোকসভায় তারা সাংসদসংখ্যা সেভাবে বাড়াতে পারছে না। রাজ্যে ক্ষমতা হারাচ্ছে। তারা দক্ষিণ ভারতে ভালো ফল করলেও উত্তর ভারতের একের পর এক রাজ্য তাদের হাতছাড়া হয়েছে।

বাকি কয়েকটি দলের জাতীয় দল হিসাবে স্বীকৃতি থাকলেও তারা কার্যত আঞ্চলিক দলে পরিণত হয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা সামনে আসছে, তা হলো, সরকার বিরোধিতার ক্ষেত্রটা অনেকটা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রে যা একেবারেই কাম্য নয়। বিরোধী যত শক্তিশালী হবে, ততই সরকার সীমার মধ্যে থাকবে, ততই সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের ভালো-মন্দ দুটি দিকই মানুষের কাছে পৌঁছাবে। বিরোধী দলগুলি যত দুর্বল হবে, ততই তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কমবে। ভারতে এখন রাজনীতিকদের নিয়ে দুইটি ন্যারেটিভ চলে। প্রথমত, বিরোধী রাজনীতিকদের সিংহভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত। দ্বিতীয়টা, ইডি, সিবিআই-কে বিরোধী নেতাদের পিছনে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা বিরোধীদের ভয় দেখাচ্ছে। মুশকিল হলো যত দিন যাচ্ছে, ততই প্রথম ন্যারেটিভ বেশি করে মানুষের মনে ঢুকে যাচ্ছে। কেন? একের পর এক বিরোধী সাংসদ, মন্ত্রী, নেতার বাড়ি থেকে টাকার পাহাড় উদ্ধার হচ্ছে। একের পর এক কেলেঙ্কারি সামনে আসছে। কোথাও শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে, কোথাও রেশন দুর্নীতি নিয়ে, কোথাও বেটিং কোম্পানিকে সাহায্য করা নিয়ে। বিরোধীরা বিশ্বাসযোগ্যতা হারালে সেটা পুনরুদ্ধার করা খুব কঠিন। বিজেপি বা তার নেতাদের নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগে মানুষ সেভাবে প্রভাবিত হচ্ছে না।

এরপরেও মানুষ দেখছে, বিরোধী দলগুলি একে অন্যকে কয়েকটি আসন ছাড়া নিয়েও ঝগড়া করছে। এক-দুইটি আসন ছাড়া নিয়ে তাদের আলোচনা ভেঙে যাচ্ছে। এই নমনীয়তা পর্যন্ত তারা দেখাতে পারছে না। আসন সমঝোতা না করে ছত্তিশগড় ও রাজস্থান হারাতে হয়েছে কংগ্রেসকে। গণতন্ত্রের পক্ষে এ খুব শুভসংকেত নয়। বিরোধীদের বামন করে কোনো একটি দল যদি দৈত্যের আকার নেয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। যেমন একসময় কংগ্রেসের ছিল, যেমন এখন বিজেপি-র আছে। তাই লোকসভা ও বিধানসভায় বিরোধী দল শক্তিশালী থাকাটা গণতন্ত্রের জন্যই জরুরি।

সেই ছবিটা কি আগামী লোকসভায় দেখা যাবে?

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷