‘বিদেশিরা কখনোই আমাদের সমস্যার সমাধান দিতে পারেনি’
৩০ জুন ২০২৩ডয়চে ভেলে : আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিদেশিদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। এই তৎপরতাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন : আমার ব্যক্তিগত মত হল, এটা নিদারুন অপছন্দ৷ এটা যে নতুন কিছু তা না৷ এটা হচ্ছে, মাঝখানে ছিল না, আবার শুরু হয়েছে৷ এটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়৷
আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল তো ইতিমধ্যে বিদেশিদের কাছে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছে৷ অনেকগুলো বৈঠকও হয়েছে৷ তাহলে আমরাই কী তাদের হস্তক্ষেপের জন্য ডেকে আনছি না?
এ কথার মধ্যে অনেকটা সত্যতা আছে৷ এক সময় বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলই কখনও না কখনও বিদেশি দূতাবাসে গেছে। বিদেশিরা তাদের পক্ষে কিছু বললে খুশি হয়েছে৷ এটা আমি ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে অস্বীকার করতে পারব না৷ কিন্তু কখনই আমাদের কাছে, ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এটা গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি৷ কারণ আমরা বঙ্গবন্ধুর সময়ের জেনারেশন৷ আমরা ওই সময় তো এতো নিদারুন কষ্ট দেখিনি যে, বিদেশিরা কখনও কোন কথা বলার সাহস পেয়েছে৷
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ বা অংশগ্রহণ কোন সময় থেকে শুরু হয়েছে?
এটা সঠিকভাবে আমি বলতে পারব না৷ তবে একটা কথা বলতে পারি, বঙ্গবন্ধুর অনেক সমালোচনা আমরা করতে পারি, তার আত্মমর্যাদা জ্ঞান এখন প্রখর ছিল যে, কোন বিদেশি এখানে কিছু বলবে সেই সাহস কারও ছিল না৷ এখানে ব্যক্তিত্বের ব্যাপারও আসে। আমার মনে হয়, খুব সম্ভবত জিয়াউর রহমানের আমলের শেষের দিকে বা এরশাদ সরকারের সময়। আমরা তখন স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পেতে বিদেশিদের কাছে ধরণা দেওয়া শুরু করেছিলাম৷ সেই ধারা এখনও চলছে৷ এটার অবসান হওয়া বাঞ্ছনীয়৷
বাংলাদেশের জন্মের পর সামরিক শাসন, স্বৈরশাসনসহ নানা ধরনের সংকট হয়েছে। কিন্তু বিদেশিদের হস্তক্ষেপে কী আমরা কখনও সমাধান পেয়েছি?
কখনই পাইনি৷ কোন সময় ঠিক খেয়াল নেই, বিএনপির সময় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জাতিসংঘ থেকেও দূত প্রেরণ করা হয়েছিল, তখনও কোন কাজ হয়নি৷ আমার মনে হয়, মূল সমস্যাটা অন্যখানে৷ সারাবিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে স্বাধীনতার পক্ষের এবং স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি আছে৷ পৃথিবীর কোন দেশে তা নেই৷ ভারতেও নেই৷ সব যদি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হয় তাহলে একটা মীমাংসায় পৌঁছানো যায়৷ কিন্তু বিপরীত দিকে যদি একটা অবস্থান থাকে তাহলে তো মিলতে পারে না৷ সংকটটা এখানেই তৈরি হয়েছে৷
আমরা সর্বশেষ যেটা দেখলাম বিএনপি ৩৩ জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৪৩ জনের একটি তালিকা বিভিন্ন দূতাবাসে জমা দিয়েছে৷ অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ এ আরাফাত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেনকে বিএনপির নির্বাচন বিরোধী বক্তব্য সম্বলিত অডিও ভিডিও দিয়ে চিঠি লিখেছেন৷ তাহলে তারা হস্তক্ষেপ কেন করবে না?
আমরা তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছি৷ দুই নম্বর হচ্ছে, মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে, কিন্তু এর কারণটা আমি বুঝে উঠতে পারছি না৷ বাংলাদেশের সবাই কী যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য ভিসার আবেদন করেছে? তা তো করেনি৷ এলিট শ্রেনীর জন্য এটা একটা বিপদ হতে পারে৷ কিন্তু অন্য শ্রেনীর যারা আছেন তাদের জন্য এই ভিসানীতি কী সমস্যার সৃষ্টি করবে সেটা আমি বুঝতে অক্ষম৷ মার্কিন ভিসানীতি যে শুধু আওয়ামী লীগের জন্য তা তো নয়৷ এখানে বলা হয়েছে, যে কেউ৷ এটা বিএনপি হতে পারে, জাতীয় পার্টি হতে পারে, আওয়ামী লীগও হতে পারে৷ আমি মনে করি, এগুলো রাজনৈতিক ইস্যু হওয়া উচিৎ নয়৷ তবে বিএনপি কিছু একটা করলে, আওয়ামী লীগকে পাল্টা কিছু একটা করতে হবে, আবার আওয়ামী লীগ কিছু একটা করলে বিএনপিকে পাল্টা কিছু একটা করতে হবে, সেই সংস্কৃতি থেকে আমরা তো এখনও মুক্ত হইনি৷ সুতারাং আমরা কী চাচ্ছি বা না চাচ্ছি তাতে কিছু যায় আসে না৷ তারা তাদের মতো করবে৷ আরাফাতের চিঠির বিষয়টি আমি শুনিনি৷
আগামী মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জিয়াসহ আরও কয়েকজনের সফরের কথা রয়েছে৷ আমাদের যে সংকট সেটা নিরসনে তারা কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেন?
তারা কোন ভূমিকাই রাখতে পারেন না৷ তারা পক্ষ নিয়ে বলতে পারেন, আকার ইঙ্গিতে বলতে পারেন, চাপ সৃষ্টি করতে পারেন এবং অনেক কিছু দাবি করতে পারেন৷ একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, রাশিয়াকে কী আমেরিকা এই কথা বলবে? বলবে না৷ ইংল্যান্ডকে কী বলবে, জার্মানিকে কী বলবে? বলবে না৷ কিন্তু গরীব দেশগুলোর উপর আমেরিকা সব সময় প্রভুত্বকারী এসব কথা বলে যাবে৷ আমাদের যেহেতু বাজার দরকার, আমাদের অর্থনীতি যেহেতু আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত ফলে এটা আমাকে সহ্য করে যেতে হবে৷ যে যত সমালোচনাই করুক না কেন, আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখনও আত্মমর্যাদার সঙ্গে এগুলো সামলাচ্ছেন৷ এক্ষেত্রে তাকে সমর্থন দেওয়া আমি মনে করি কর্তব্য৷ এখানে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি প্রশ্ন না, তিনি এখনও আত্মমর্যাদার সঙ্গে কথা বলছেন৷ যেদিন আমরা এসব কথা বলতে ব্যর্থ হবো সেদিন আমাদের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে৷
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ঢাকা সফরে এসেছিলেন ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং৷ তিনি হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করেছিলেন, তখন এরশাদ সেটা সাংবাদিকদের বলেও দিয়েছিলেন৷ এই ধরনের হস্তক্ষেপ সার্বভৌমত্বে আঘাত করে কিনা?
অবশ্যই করে৷ কিন্তু আমি যেটা বুঝতে অক্ষম, আমাদের দেশে নির্বাচন কী ভারত করে দেবে? আমেরিকা করে দেবে? তারা কি প্রার্থী ঠিক করে দেবে? তারা কি এসে ভোট দেবে? নাকি তারা এসে ধানমন্ডিতে বসে প্রচার করবে ওমুককে ভোট দিন? তা তো না৷ তাহলে কেন বিষয়টি বারবার আসছে৷ আমাদের নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা নানা কথা বলতে পারে৷ আমরাও আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে নানা কথা বলতে পারি৷ কিন্তু আমরা সেটা বলতে পারব না৷ যেহেতু আমরা আমেরিকার উপর অনেক ক্ষেত্রে নির্ভরশীল৷ যদি নির্ভরশীল না হতাম তাহলে আমাদের জনগন বলত, আমেরিকার নির্বাচন কতটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে? যেটা প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে৷ এখানে গরীব ধনীর সম্পর্ক৷ আমাদের বাজার দরকার, ডলারে আমরা ব্যবসা করি, এসব মাথায় রেখেই সরকার হয়ত অনেকটা সংযত৷ বিএনপি যেটা বুঝতে পারছে না, ভবিষ্যতে তাকেও এই ধরনের অবস্থায় পরতে হতে পারে৷ আপনি বলছেন, বিএনপি বলছে তারা অনেকের তালিকা তৈরি করেছে৷ কিন্তু আমি গয়েশ্বরের বক্তব্য দেখলাম, সেখানে বলা হচ্ছে এই ধরনের কোনো তালিকাই তৈরি হয়নি৷ তাহলে কোথায় আমরা যাব সেটা আমি ঠিক জানি না৷
যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। কানাডাসহ আরও অনেক দেশই একই পথে হাঁটছে৷ এসব পদক্ষেপ কী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব ফেলতে পারে?
আমি তো আসলে বিষয়টি বুঝতে পারছি না৷ কানাডা তো ভিসা দিচ্ছে প্রচুর৷ তারা যাকে অবাঞ্ছিত মনে করবে ভিসা দেবে না৷ ভারতও অনেক ক্ষেত্রে দিচ্ছে না৷ বাংলাদেশও তো অনেককে দিচ্ছে না৷ আমি ভারতের ভিসার জন্য আবেদন করেছিলাম, আমাকে জিজ্ঞাসা করা হল ২০ বছর আগে আমি পাকিস্তান গেছি, কেন গেছি? আমি বলেছি, আমি তো কয়েকদিন আগেও ভারতে গেছি, এইভাবে প্রশ্ন তো হয় না৷ আমি পাকিস্তান যাওয়ার কারণে যদি ভিসা দিতে না চান তাহলে ভিসা দেবেন না৷ কিন্তু এই ধরনের প্রশ্ন করবেন না৷ আপনাদের দেশেরও তো অনেকে পাকিস্তান যাচ্ছে, তাদের এই প্রশ্ন করা হয়? আমি যদি কোন দেশে যেতে ইচ্ছুক হই সে দেশের জনগন আমাকে যেতে দিতেও পারে, নাও পারে৷ কিন্তু আমি যদি না যেতে চাই তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল তো পরষ্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে৷ এখন যদি আমরা বিদেশিদের হস্তক্ষেপ না চাই তাহলে সমাধান কীভাবে মিলতে পারে?
আমার মনে হয়, এটার কোন সমাধান হবে না৷ দু'টি দল ইতিহাস, ঐতিহ্যগতভাবে অনেক বেশি পরষ্পরবিরোধী৷ এর মধ্যে আবেগ আছে, প্রতিহিংসা আছে, অনেক কিছু আছে৷ সুতারাং আমি মনে করি, কোনোভাবেই সমাধান সম্ভব নয়৷ এইভাবেই হবে, নির্বাচনও হবে৷ নির্বাচন আমাদের মতোই হবে, বাকিটা আমি বলতে পারব না৷