1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

দেশের রাজনীতিতে বিদেশ

৩০ জুন ২০২৩

শুধু এবারই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিদেশিদের আগ্রহ বরাবরই ছিলো৷ আগামী নির্বাচন নিয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীনের তৎপরতা প্রকাশ্যেই দেখা যাচ্ছে৷ কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে৷

https://p.dw.com/p/4TH6o
Bangladesch Parlament
ফাইল ফটো৷ছবি: bdnews24.com

বাংলাদেশে সুষ্ঠু এবং অংশহণমূলক নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে৷ সর্বশেষ বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য নতুন মার্কিন ভিসানীতি নির্বাচনকে টার্গেট করেই করা হয়েছে৷ বলা হয়েছে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়াকে যারা বাধাগ্রস্ত করবে তাদের মার্কিন ভিসা দেয়া হবে না৷ এর আগে র‌্যাবের ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র৷

মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন প্রতিনিধি ঢাকা সফর করেছেন৷ এসেছেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে দক্ষিণ এশিয়ার সিনিয়র ডিরেক্টর রিয়ার অ্যাডমিরাল আইলিন লাউবাচার৷

জুলাই মাসে ঢাকায় আবারো ডোনাল্ড লু আসবেন বলে জানা গেছে৷ আরো আসবেন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারসংক্রান্ত আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া, অর্থনৈতিকবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জোসে ডব্লিউ ফার্নান্দেজ৷ তারা একসঙ্গে একটি উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধি দল হিসেবে ঢাকায় আসছেন৷ তারা বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠানের জন্য চেষ্টা করবেন বলে জানা গেছে৷

এর বাইরে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে নানা পর্যায়ে কথা বলছেন৷

কেন তারা আসছেন?

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘‘অ্যামেরিকার মতো কেউ তৎপর না৷ তারাই সবচেয়ে তৎপর৷ ভারত নিজেদের মতো তৎপর৷  ভারতের তৎপরতা যতটা কাজে লাগে তার চেয়ে সে বেশি তারা তৎপরতা দেখাতে চায়৷ এবার মোদীর যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে সেটা আমরা দেখেছি৷ বলা হলো মোদী বাংলাদেশ নিয়ে বাইডেনের সঙ্গে কথা বলবেন৷ পরে দেখা গেল আসলে কিছুই না৷’’

ভারত নিজেদের মতো তৎপর: ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘‘কেউ পছন্দ করুক আর না করুক যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বের এক নাম্বার রাজনৈতিক শক্তি৷ আর জো বাইডেনের ঘোষিত পররাষ্ট্র নীতিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা আছে৷ ভারত আমাদের প্রতিবেশি৷ তার রাজনৈতিক প্রভাব আমাদের ওপর পড়ে৷ আমাদের প্রভাবও তাদের ওপর পড়ে৷ সামনের দিনগুলোতে আরো নতুন নতুন দেশ বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবে৷  চীন, জাপান, ইউরোপ কথা বলছে৷ রাশিয়াও আরো কথা বলতে পারে সামনের দিনগুলোতে৷ পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখনো কেউ আসতে পারবে না, কথা বলতে পারবে না৷ এটা আমি ঠিক মনে করি না৷ তবে দরবারে গিয়ে হাজিরা দেয়া, পরস্পরের বিরুদ্ধে পরস্পরের তালিকা দেয়া এটা ঠিক মনে করি না৷’’

সাবেক পররাষ্ট্র সাচিব মো. তৌহিদ হোসেনের মতে, ‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু নীতিগত অবস্থান আছে৷  গণতন্ত্র, মানবাধিকার- এসব নিয়ে তারা সব সময়ই তৎপর থাকে৷  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসব নিয়ে বার্ষিক রিপোর্টও দেয়৷ এবারে যে তাদের আগ্রহ বা উৎসাহ সেটা অন্যান্য বারের চেয়ে একটু বেশি৷ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সেটা তারা আসলে চায় বা না চায় সেটা পরের ব্যাপার, তারা ঘোষিত কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে৷  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা গ্রেটার গেম আছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে৷ এইখানে চীন এখন আগের চেয়ে আরো বেশি শক্তিশালী৷ মানবাধিকার, গণতন্ত্র বাদ দিলেও চীনের এই অবস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যথেষ্ট উদ্বিগ্ন৷ বাংলাদেশ চীনের বলয়ভুক্ত হয়ে যায় কী না এটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবনা আছে৷ যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারসাম্য বজায় রাখছে৷’’

তার মতে,‘‘ভারতের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম৷ ভারত দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছে যে, ভারতের জন্য বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা সুবিধাজনক৷ সে তার সিকিউরিটির দিক দিয়ে ভাবে৷ আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের দীর্ঘদিনের একটা সখ্য আছে, যা এখানকার অন্য কোনো রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে নেই৷ কাজেই ভারত চাইবে যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই৷’’

এইসব তৎপরতা নতুন কিছু নয়

রাজনৈতিক সংকট নিরসনে নির্বাচনের আগে এই ধরনের তৎপরতা বেশ পুরানো৷ ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে৷ তার চার বছরের মাথায়ই দেশে রাজনৈতিক অচলবস্থার সৃষ্টি হয়৷ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ আরো অনেক রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে৷ রাজপথেই ফয়সালা হয়৷ তবে তার আগে ঢাকায় আসেন কমনওয়েলথ মহাসচিব এনিয়াওকুর এমেকা৷ রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ১৯৯৪ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকায় এসে দুই নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি৷ কমনওয়েলথ মহাসচিবের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সংলাপে দুই নেত্রী আনুষ্ঠানিক সম্মতিও দিয়েছিলেন৷ পরে সেটিও সফল হয়নি৷ এমেকা খুব একটা আশার আলো দেখতে না পেয়ে পরে তারই বিশেষ দূত অষ্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টিফেনকে পাঠিয়েছিলেন৷ যিনি বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সংলাপ তত্ত্বাবধান ও পরিচালনায় অভিজ্ঞ৷ নিনিয়ান একটি রাজনৈতিক ফর্মুলাও দিয়েছিলেন৷ কিন্তু সেই ফর্মুলা তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ মেনে না নেওয়ায় সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল৷

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে কেউ কথা বলতে পারবে না এটা ঠিক মনে করি না: ড. শান্তনু মজুমদার

২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের সেটি প্রত্যাখ্যানের কারণে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়৷ তখন সেই সংকট নিরসনে বাংলাদেশে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার৷ তিনিও দুই পক্ষের সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন৷ কিন্তু তার চেষ্টাও সফল হয়নি৷

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের শেষ দিকে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে সংকট নিরসনে জাতিসংঘের রাজনীতিবিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো তিনবার ঢাকায় আসেন৷ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি ছয়দিন ঢাকায় অবস্থান করে দু'পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন৷

২০১৩ সালের ডিসেম্বরের ঢাকায় আরো এসেছিলেন  ভারতের তখনকার পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং৷ তিনি তখন বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করে আলোচনার জন্ম দেন৷ তিনি তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে সবাইকে নির্বাচেনে অংশ নেয়ার জন্য বলেন৷ তিনি তখন বলেন, বাংলাদেশে যথাসময়ে  নির্বাচন না হলে মৌলবাদের উত্থান ঘটবে৷ ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিলো বিএনপি৷

২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি৷ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে আওয়ামী লীগ সরকার৷ তখনো নেপথ্যে কম-বেশি বিদেশিরা তৎপর থাকলেও এবারের মতো নয়৷

২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডনাল্ড ট্রাম্প৷ আর এবার জো বাইডেন৷ জো বাইডেন সরকার গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে প্রকাশ্য নীতি হিসেবে প্রাধ্যান্য দিচ্ছে৷

ফল কী হয়?

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ‘‘বিদেশিরা আমাদের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আসে এর কারণ আমরা আমাদের ঘর সামলাতে পারি না৷ আমাদের এখানে পরস্পরের প্রতি যে বিদ্বেষ তা মাত্রা ছাড়া৷ এখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে প্রতিপক্ষ নয়, শত্রু মনে করা হয়৷ আমরা বিদেশিদের ওয়েলকাম করি৷ আমরা যদি না চাই তাহলে তো তারা আসতে পারে না৷ তারানকো বলেন আর জিমি কার্টার বলেন আমরা চেয়েছি বলেই তারা এসেছেন৷ কিন্তু তারা আসার কারণে যে আমাদের রাজনৈতিক সমস্যার সামধান হয়েছে, শান্তিপূর্ণ অবস্থান ফিরে এসেছে তা কিন্তু নয়৷’’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে সময়ই তৎপর থাকে: মো. তৌহিদ হোসেন

আর শান্তনু মজুমদার মনে করেন, "নিজেদের সমস্যা সমাধান না করতে পেরে তাদের কাছে নালিশ করলে আমরাই আমাদের অবস্থান ছোট করি৷ নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া যে দরকার এবং এটা নিয়ে বাংলাদেশে যে ঝামেলা চলছে এটা কে না বোঝে?’’

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘‘আসলে শেষ পর্যন্ত বিদেশিদের এই তৎপরতা কাজে আসে না৷ কোনো কাজে আসার নজির নেই৷ লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এলে এর ফয়সালা হয়৷ আমরা বাংলাদেশে সেটা দেখেছি৷ তা ছাড়া হয় না৷’’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু  মনে করেন,‘‘নির্বাচনের আগে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিদেশি চাপ আরো বাড়বে৷ আমাদের আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সরকার আরো বেকায়দায় পড়বে৷’’ আর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘‘বিদেশিরা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারে৷ বন্ধু হিসেবে পরামর্শ দিতে পারে৷ তবে তাদের হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না৷’’

 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য