বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিদের বিজেপি বর্জনের ডাক
৯ এপ্রিল ২০১৯তবে সাংস্কৃতিক সমাজের অপরপক্ষ মনে করেন, অন্য রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে সেটা যে হবে না, তার কী গ্যারান্টি?
ভারতে সাধারণ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হবার মুখে গোটা দেশের বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী এবং সংস্কৃতিমনস্ক প্রায় ৬০০ ব্যক্তিত্ব তোপ দেগেছেন বিজেপির বিরুদ্ধে৷ তাঁরা মনে করেন, বিজেপির মতো এক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে দেশের সার্বিক অবস্থা চূড়ান্ত অবক্ষয়ের মুখে পড়বে৷ ঘৃণা, বিদ্বেষ, ধর্মীয় ভেদাভেদ বাড়বে৷ তাই বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক শক্তি যাতে মাথা তুলতে না পারে, ক্ষমতায় আসতে না পারে তারজন্য ভেবেচিন্তে ভোট দেবার আবেদন জানিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে৷ বিজেপি এবং তার শরিক দলগুলিকে ভোট না দেবার কথা বলেছেন৷
কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা যেভাবে আহ্বান জানিয়েছেন সাম্প্রতিক ইতিহাসে তা নজীরবিহীন৷ এঁদের মধ্যে আছেন, কবি শঙ্খ ঘোষ, নবনীতা দেবসেন, বলিউড অভিনেতা নাসিরুদ্দীন শাহ, রত্না পাঠক শাহ, কঙ্কনা সেনশর্মা, অমল পালেকার, বলিউড ফিল্ম পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ প্রমুখ৷
গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে অন্যান্যদের সঙ্গে কবি শঙ্খ ঘোষ মনে করেন, বিজেপির মতো এক সাম্প্রদায়িক দল ক্ষমতাসীন হলে দেশের পরিস্থিতি এক সার্বিক সংকটের মুখে পড়বে৷ ধর্মীয় হানাহানি, জাতিগত বিদ্বেষ বাড়বে৷ বাড়বে বেরোজগারি, কৃষক মৃত্যু৷ মাথা চাড়া দেবে এক ফ্যাসিস্ট শক্তি৷ তাই ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে পরাজিত করতে এগিয়ে আসার ডাক দেওয়া হয়েছে সর্বস্তরের মানুষের কাছে৷ ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনেরা ১২ই এপ্রিল কোলকাতায় যে পদযাত্রার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে যোগ দিচ্ছেন না কবি শঙ্খ ঘোষ৷ যে সংগঠন এই পদযাত্রার ডাক দিয়েছে তাদের তরফে বলা হয়, শঙ্খবাবু পদযাত্রায় অংশ নিতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন৷ তবে বিবৃতির বয়ানের সঙ্গে তিনি একমত৷
এই প্রসঙ্গে জনপ্রিয় সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্ত্তীর অভিমত জানতে চাইলে ডয়চে ভেলেকে তিনি বললেন, ‘‘আমরা তো চিরদিনই দেখে আসছি ইলেকশনের আগে এমনটা হয়৷ তবে একসঙ্গে ৬০০ সাংস্কৃতিক ব্যক্তি আগে কখনো এই ধরণের বিবৃতি দিয়েছেন কিনা, আমার জানা নেই৷ তবে এরা সবাই ওয়ার্কশপ করে বা কনভেনশন করে কিংবা কনফারেন্স করে এটা করেননি৷ মাঝখানে দু-একজন যোগাযোগ করে এদের প্রত্যেকের সম্মতি নিয়েছেন৷ তবে আমার সমর্থন এতে আছে কিনা, মানে আমি সমর্থন করি কিনা, জানতে চাইলে আমি বলতাম আমি ঠিক এইসব অ্যাজেন্ডার মধ্যে পড়িনা৷ আমাকে বলা হলে আরো কিছু পরিবর্তনের কথা আমার বলার ছিল৷ এইভাবে তো শুধু হয়না৷ তবে এইসব যাঁরা করেছেন তাঁদের সমর্থন যেমন করছি না, আবার প্রতিবাদও করছি না৷ সামনে লোকসভা নির্বাচন৷ সবাই যাঁরা বিজেপিকে দোষ দিচ্ছে, সমালোচনা করছে, আমার মতে শুধু বিজেপিকে কেন? বিজেপির থেকেও তো খারাপ দল আছে৷ কিংবা একই রকম খারাপও তো আছে৷ তাদের সম্পর্কে তো বিবৃতিতে কিছু বলা নেই৷ এরমধ্যে শুধু সাম্প্রদায়িকতার কথাই বলা হয়েছে৷ কিন্তু যারা দুর্নীতিগ্রস্ত বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের কথা বলা নেই৷ একটা ইস্যুর কথা বলা হয়েছে মাত্র৷ অন্য আরো ইস্যুও আছে যার কথা বলা নেই৷''
অন্যদিকে, দেড়শ বিজ্ঞানীও একই সুরে ভোটারদের কাছে আবেদন রেখেছেন, তাঁরা যেন বিজেপিকে ভোট দেবার আগে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখেন৷ যে রাজনৈতিক দল গো-রক্ষার নামে গণপিটুনি, ভীতিপ্রদর্শন, জাতপাত এবং বিভেদমূলক নীতিতে বিশ্বাস করে, সেই দল ক্ষমতায় আসলে দেশের ভবিষ্যতের হাল কী হবে৷ বিজেপি কোনোমতেই যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে, তারজন্য ভোটদাতাদের উচিত বিজেপিকে বর্জন করা৷ এরমধ্যে আছেন ভারতীয় বিজ্ঞান শিক্ষা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান, জীববিজ্ঞানের জাতীয় কেন্দ্র, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা৷ তাঁরা মনে করেন, সব ভোটারদের উচিত সংবিধানসম্মত যুক্তি মাথায় রাখা৷
এর প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা সংগঠনের সেক্রেটারি ধীরাজ সেনগুপ্ত ডয়েচে ভেলেকে বললেন, শুধু নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার পরিবর্তন করলেই কি বাস্তব অবস্থা শুধরে যাবে? ‘‘এবিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার সন্দেহ আছে৷ যেসব অভিযোগ তুলে বিজেপিকে হারানোর ডাক দেওয়া হয়, বিজেপি ক্ষমতা হারালে সেইসব অভিযোগ আর উঠবে না, তা কি বলা যায়? দরকার একটি নিরপেক্ষ নীতি৷ এখন একটা নীতি যার পক্ষে যাবে সে বলবে এককথা৷ যারপক্ষে যাবে না সে বলবে অন্যকথা৷ পক্ষে গেলে সমর্থন করবে৷ বিপক্ষে গেলে প্রতিবাদ করবে৷ যেমন মানবাধিকার৷ যেটা রক্ষা করলে সরকারের মান মর্যাদা বজায় থাকে৷ কিন্তু তা হচ্ছে কৈ? শুধু ভারতেই নয়, কার্যত গোটা দুনিয়াতেই তা চলছে৷ উগ্র দক্ষিণপন্থিরা রয়েছে অনেক দেশে৷ যেমন, জার্মানিতে নব্য নাৎসিরা বেশ শক্তিশালী৷ এখন উগ্রপন্থা মাথা চাড়া দিচ্ছে, আর উদারপন্থিরা পিছু হটছে৷ সাধারণ মানুষের যেসব চাহিদা পূরণের কথা ছিল তা দিতে তারা ব্যর্থ৷ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যেসব আঞ্চলিক দল ক্ষমতাসীন ছিল, তারাও জনগণের আশা আকাঙ্খা পূরণ করতে পারেনি৷''
ডয়চে ভেলে জানতে চায় তাহলে বিজেপিকেই শুধু টার্গেট করা কেন? উত্তরে ধীরাজ সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘বিজেপি সরে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয়না৷ অতীতে কংগ্রেস জমানায় ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে ভোটে হারানো হয়েছিল, একই কারণে৷ মোটকথা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মানুষের হাতছাড়া৷ সরকার, সাংসদ, মন্ত্রী, প্রশাসন সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন৷ তারই রাজনৈতিক প্রতিফলন আজ বিজেপি হটাও৷ কংগ্রেস যদি ক্ষমতায় আসে দুদিন পরে দেখবো কংগ্রেস হটাও৷ একটা অশুভ চক্র যেন৷ কাজেই দুশো বা চারশো বিজ্ঞানী বা সংস্কৃতিবান লোক কী বললেন তাতে কিচ্ছু এসে যায় না৷ সমাজ তাঁদের হাতে নেই৷ তাঁরা নিজেরাই আক্রান্ত৷ দ্বিতীয় কথা, টাকা লুটছে বলে যে আম্বানিকে কংগ্রেস আজ দুষছে, ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে আম্বানির প্রাণ পুরুষ ধীরুভাই আম্বানি ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতায় আনার জন্য কাজ করেছিলেন৷ এখন তাঁরা অন্যদিকে, সেটা আলাদা কথা৷''