বিএনপির ১০ দফা, এমপিদের পদত্যাগের ঘোষণা
১০ ডিসেম্বর ২০২২অন্যদিকেবিএনপির এই সমাবেশের বিপরীতেঢাকায় সক্রিয় ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। পুরো ঢাকা শহরে মোতায়েন ছিলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ৩০ হাজারেরও বেশি সদস্য। একই দিনে ঢাকার উপকণ্ঠ সাভারে সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ।
যেমন ছিল ঢাকা:
এবার অন্য বিভাগীয় সমাবেশের সময়ের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পরিবহণ ধর্মঘট না ডাকা হলেও বাস্তবে গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ ছিল সকাল থেকেই। সিটি সার্ভিস বন্ধ ছিল। বন্ধ ছিল দূরপাল্লার যানবাহন। ফলে নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যারা ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে যান তাদের যানবাহন না পেয়ে ঠায় বসে থাকতে হয়। সমাবেশ শেষে সন্ধ্যায় আবার গণবপরিবহণ চলাচল স্বাভাবিক হয়।
গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির সমাবেশ এবং আশপাশের এলাকা ছাড়া পুরো ঢাকা শহরে বাইরে মানুষের উপস্থিতি ছিলো খুবই কম। প্রাইভেট কার, অটোরিকশাসহ মোটর সাইকেলও তেমন দেখা যায়নি। তবে কোনো কোনো সড়কে আওয়ামী লীগের কর্মী- সমর্থকদের মোটরসাইকেল মহড়া ছিলো। ঢাকার পরিস্থিতি ছিলো হরতালের মতো।
বিএনপির নয়া পল্টনের অফিস এখনো পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আছে। সামনের আধা কিলোমিটার সড়ক পুলিশ আটকে রেখেছে। যানবাহন ও জনচলাচল বন্ধ আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ছিলো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সেখানে নেতা-কর্মীদের খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ানো হয়। আওয়ামী লীগের এই খিচুড়ি আয়োজন আরো অনেক এলাকায় দেখা গেছে।
বিএনপির ১০ দফা:
ঢাকার দক্ষিণ সিটিতে গোলাপবাগ মাঠে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। সভাপত্বি করেন বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য ও গণসমাবেশ কমিটির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস কারাগারে থাকায় ওই দুইজন তাদের দায়িত্ব পালন করেন।
সকাল ১১ টায় সমাবেশ শুরু হয়, দুপুরের পর প্রধান অতিথির বক্তব্যে "গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার” ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন ড. খন্দকার মোশরারফ হোসেন। দফাগুলো হলো:
১. জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে সরকাররের পদত্যাগ।
২. দল নিরপেক্ষ একটি অন্তবর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন।
৩. বর্তমান নির্বাচন কমিশন বাতিল করে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন।
৪. খালেদা জিয়াসহ সকল বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক এবং আলেমদের সাজা বাতিল, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও রাজনৈতিক কারাবন্দিদের মুক্তি।
সভা-সমাবেশ ও মত প্রকাশে কোনো বাধা সৃষ্টি না করা।
৫. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন,সন্ত্রাস দমন আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ সকল কালাকানুন বাতিল।
৬. বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, সার ও পানিসহ জনসেবা খাতসমূহে মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল।
৭. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনা।
৮. গত ১৫ বছর বিদেশে অর্থ-পাচার, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত ও শেয়ার বাজারসহ রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি চিহ্নিত করতে একটি কমিশন গঠন।
৯. গত ১৫ বছরে গুমের শিকার সকল নাগরিকদের উদ্ধার এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার আইনানুগ বিচারের ব্যবস্থা ও শাস্তি নিশ্চিত করা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, উপসানালয় ভাঙচুর ও সম্পত্তি দখলের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করা।
১০. আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের উপযোগী করতে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ করে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া।
বিএনপি এইসব দাবি আদায়ে ২৪ ডিসেম্বর থেকে আন্দোলন শুরু করবে। ওই দিন তারা সারাদেশে গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে। পরে আরো কর্মসূচি দেয়া হবে বলে সমাবেশে জানিয়েছেন ড. খন্দকার মোশাররফ। তবে এর আগে তারা ১৩ ডিসেম্বর নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবীতে ঢাকা মহানগরীতে গণবিক্ষোভ করবে।
বিএনপির সাত এমপির পদত্যাগ:
ঢাকার গণসমাবেশ থেকে বিএনপির সংরক্ষিত আসনের এমপিসহ সাত জন সংসদ সদস্যই পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।
সমাবেশে বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপির সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ প্রথম পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এরপর অন্য সংসদ সদস্যরা একে একে পদত্যাগের কথা জানান। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের মো. হারুনুর রশীদ দেশের বাইরে থাকায় তার তরফে গোলাম মোহাম্মদ পদত্যাগের কথা জানান।
একাদশ জাতীয় সংসদে বিএনপির সংসদ সদস্যরা হলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের মো. আমিনুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের মো. হারুনুর রশীদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের আবদুস সাত্তার, বগুড়া-৪ আসনের মো. মোশাররফ হোসেন, বগুড়া-৬ আসনের গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমান এবং বিএনপির সংরক্ষিত সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা।
তারা জানান, তারা ই-মেইলে পদত্যাগ পাঠিয়ে দিয়েছেন। রবিবার তারা সশরীরে স্পিকারের কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দেবেন। সমাবেশে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যদেরও পদত্যাগের আহ্বান জানানো হয়।
এমপিদের পদত্যাগ ও ১০ দফায় কী হবে?
সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেয়া বিএনপির এমপি রুমিন ফারহানা তাদের পদত্যাগে কী প্রতিক্রিয়া হবে জানতে চাইলে বলেন," এই পদত্যাগ দেশের মানুষের দাবি। আমাদের প্রথম দাবি হলো সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে। তাই আমরাই শুরু করলাম। আমরা দেখিয়ে দিলাম এই সরকারের কোনো গণভিত্তি নেই, কোনো বৈধতা নেই, জনগণ তাদের লাল কার্ড দেখিয়ে দিয়েছে। আমাদের পদত্যাগ তাই নতুন আন্দোলন সূচনা করল।”
সরকার পতনের আন্দোলন শুরুর ঘোষণা না দিয়ে পদত্যাগের দাবিসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলনে কী ধরনের প্রকৃতি স্পষ্ট হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন," আমাদের এক দফা এক দাবি, এই সরকারের পদত্যাগ। বাকি যে দফাগুলো এই এক দফারই অংশ। এত দফা হলো সরকারের পদত্যাগ।”
বিএনপির আহ্বানে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা কি পদত্যাগ করবে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন," আমরা জানিনা তারা পদত্যাগ করবেন কি না। তবে তারা যদি তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারা যদি কলঙ্কিত হয়ে থাকতে না চান তাহলে এই সরকারের সঙ্গে তাদের আর থাকা সমীচীন হবেনা।”
জাতীয় পার্টি কী করবে?
জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবং সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নু বলেন," বিএনপি আমাদের সংসদ থেকে পদত্যাগের আহ্বান জানালো, না কি জানালো সেটা তাদের বিষয়। আমাদের কিছু তাতে এসে যায়না। আমরা সরকারবিরোধী আন্দোলন করছি আমাদের মতো, আমাদের পদ্ধতিতে। তারা যে ১০ দফা দিয়েছে সেটাও তাদের বিষয়। ওই কর্মসূচি নিয়ে আমরা কিছু ভাবছিনা। ওটা আমাদের বিষয় নয়। তাদের সঙ্গে মিলে আমরা কিছু করছি না।”
গুরুত্ব দিচ্ছে না শাসক দল:
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এবং দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন," পদত্যাগ করা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে তাদের এলাকার মানুষ নির্বাচিত করেছেন তাদের কল্যাণে কাজ করার জন্য। এখন তারা সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। তবে উপ-নির্বাচনের সুযোগ আছে। ওইসব এলাকার মানুষ নতুন সংসদ সদস্য পাবেন।”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন," তাদের যে আন্দোলন, তা দিয়ে সরকারের পদত্যাগ হয়না। তারা তো তাদের লোকজনকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঢাকায় এনেছে, প্রলোভন দিয়েছে। তারা বলেছে ঢাকায় এলে সরকার পদত্যাগ করবে। এই সমাবেশ করে কি সরকারের পদত্যাগ সম্ভব!”
তার কথায়," যুদ্ধক্ষেত্রে কমান্ডার একটি বড় ব্যাপার। তাদের যে কমান্ডার তিনি একজন পলাতক সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ ও চোর হিসেবে আখ্যায়িত। তার ওপর কি জনগণের আস্থা থাকে?”
এদিকে সাভারে আওয়ামী লীগের সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, "জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। বিএনপির সাতজন চলে গেলে সংসদ অচল হয়ে পড়বে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।”