বিপন্ন বাঘেরা
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২কমে আসছে বাঘ
বাঘ কমে আসছে এই বিশ্বে৷ দ্রুত বেগে৷ হিংস্র কিন্তু রাজকীয়, শক্তিশালী কিন্তু সুন্দর, বন্য এই প্রাণীটিকে নির্বিচারে শিকার করে একসময় শেষ করেছে মানুষ৷ বিশেষ করে গত শতাব্দের গোড়ায় বাঘ শিকারের ওপর কোনরকম নিষেধাজ্ঞা ছিলনা৷ সে সময়ে শিকারির সংখ্যা কম আর বাঘের সংখ্যা বেশি ছিল৷ কিন্তু গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে বাঘ রক্ষার উদ্দেশে আন্তর্জাতিক পশুকল্যাণ সংস্থাগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে৷ উদ্যোগ নিতে থাকে জাতিসংঘও৷ তারপর থেকে শিকার করে বাঘ হত্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়৷ কিন্তু মানুষের লোভ তার পথ ঠিকই খুঁজে নিয়েছে৷ বাঘের চামড়া, দাঁত, লোম ইত্যাদি সবকিছুর জন্য চোরাশিকারিদের অভিযান হাজার চেষ্টাতেও বন্ধ করা যায়নি৷ তাদের উৎপাতে বাঘেদের ধ্বংস করার বর্বরতা বাড়তে বাড়তে ক্রমশ তাদের সংখ্যা কমিয়ে চলেছে সর্বত্র৷ ফলে এই চোরা শিকারিদের রুখতে এবার ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে৷
কাজের কাজ হয়নি
সময় এলেও তাকে কাজে লাগানোটার মধ্যেই রয়ে গেছে নানারকমের বিভ্রান্তি৷ যেমন বাঘেদের বিচরণভূমি মূলত এশিয়ার কয়েকটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ৷ তারপরেও এই দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার জায়গায় সমস্যা থেকে যাওয়ার ফলে চোরাশিকারিদের রীতিমত বাড়বাড়ন্ত হয়ে উঠছিল৷ তারা এক দেশ থেকে অন্য দেশের সীমানা পেরিয়ে গিয়ে তারা বাঘ শিকারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে নিয়মিত৷ সে কারণেই দেখা যাচ্ছে, বন্য বাঘদের মোট ছয়টি বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে প্রতিটি প্রজাতিতে হাজারেরও কম সংখ্যায় নেমে গেছে বাঘেদের সংখ্যা৷ যাকিনা অত্যন্ত চিন্তার আর উদ্বেগের বিষয়৷ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বিশ্বের এই অন্যতম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণীগুলি এখন রীতিমত হুমকির মুখে পড়েছে৷
ব্যাংককে বাঘেদের নিয়ে বৈঠক
বিশ্বের মোট তেরোটি বাঘ আছে এমন দেশের তরফে তাই ব্যাংককে সম্প্রতি হয়ে গেল এক বড়মাপের বৈঠক৷ যে বৈঠকে বাঘেদের বাঁচাতে আর চোরাশিকারিদের রুখতে এই তেরোটি দেশের পুলিশ তথা নিররাপত্তা বাহিনী একজোটে কাজ করবে বলে জানিয়েছে৷ সম্মেলনের আয়োজন করেছিল ইন্টারপোল এবং ইন্টারন্যাশনাল কনসর্টিয়ম অন কমব্যাটিং ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম৷ বা আইসিসিডব্লিউসি৷ সম্মেলনে এই তেরোটি বাঘা দেশের, মানে যেসব দেশে বাঘ রয়েছে সেসব দেশের মোট ২৬ জন বিশেষজ্ঞ অংশ নিয়েছিলেন৷ যে বিশেষজ্ঞদের সকলেরই এই চোরাশিকারিদের রোখার অভিজ্ঞতা রয়েছে৷ সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক জন স্ক্যানিয়ন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, চোরা শিকারিদের রুখেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাচ্ছেনা৷ আমাদের লক্ষ্য হল, এই চোরা শিকারিদের পাকড়িয়ে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া এবং এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা, যাতে বাঘ মারার আগে এইসব শিকারিদের অনেকবার ভাবতে হয়৷ কারণ ধরা পড়লে মারাত্মক সাজার ভয় যাতে তাদের মধ্যে কাজ করে৷
সিদ্ধান্তের তিন দফা
বস্তুত, বাঘ আছে এমন দেশগুলির পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকলে এই চোরাশিকারিদের ধরতে এবং শাস্তি দেওয়ার কাজটা সহজতর হয়ে যাবে৷ জানিয়েছে এই সম্মেলন৷ ব্যাংককের সম্মেলনে তাই বেশ কয়েকটি বিষয়ে সর্বজনস্বীকৃত সিদ্ধান্তে আসা গেছে৷ সেগুলি হল -
১. বাঘের চামডা, হাড়, দাঁত ইত্যাদি দেহাংশ অবৈধভাবে বিক্রি করা বন্ধ করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা গঠন করা৷ যাতে উচ্চপর্যায়ের বোঝাপড়া থাকবে এই দেশগুলির মধ্যে৷
২. বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং উদ্যোগ বাড়ানো৷ যাতে আইনের ফাঁক দিয়ে এই চোরাশিকারিরা কোনভাবেই পার না পেয়ে যায়৷
৩. চোরাশিকারিদের তৎপরতা বন্ধ করতে, ধরপাকড় এবং সাজা দেওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন দেশের জঙ্গলরক্ষী বাহিনীকে আরও বেশি প্রশিক্ষণ দেওয়া৷ যাতে তারা দ্রুত এই কাজে সাফল্য পেতে পারে৷
বিপন্ন রয়্যাল বেঙ্গলও
ব্যাংককের বৈঠকে চোরাশিকারি নিয়ন্ত্রণে আর যে বিষয়টিতে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে, তাহল, বাঘ সংরক্ষণে বিশেষ একটি টাস্ক ফোর্স তৈরি করা৷ এবং তাদের হাতে কিছু বিশেষ ক্ষমতা তুলে দেওয়া৷ বস্তুত, বাঘ সংরক্ষণে এক্ষুনি যদি কার্যকর কোন ব্যবস্থা না নেওয়া যায় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাঘশূন্য হতে চলেছে এই বিশ্ব৷ বলা বাহুল্য, এই বাঘেদের মধ্যে আমাদের সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের নাম তো অবশ্যই রয়েছে৷ সুন্দরবনের আসল সৌন্দর্যই হল এই রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার৷ পশুপ্রেমীরাই শুধু নন, কেউই চাইবেন না মানুষের তুচ্ছ লোভের জন্য সেই সুন্দর প্রাণীগুলি শেষ হয়ে যাক৷ তাই বাঘেরা বেঁচে থাকুক৷ ভয়ংকর সুন্দর হলেও, তারা তো সুন্দরই৷
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক