বাংলাদেশের পাটশিল্প : ঘুরে দাঁড়ানোর হাতছানি
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ওদিকে সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ বেড়ে যাবে৷
চলতি শতকে আমরা যে পরিমাণ প্লাস্টিক উত্পাদন ও ভোগের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, তা পৃথিবীর ইতিহাসে রেকর্ড! আপনার, আমার এই রেকর্ডের জন্য প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়ে মরতে হচ্ছে অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণীর৷ মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে আমাদের জীববৈচিত্র্য৷
অন্যদিকে, বিশ্ববাসী এখন টেকসই উন্নয়ন ও ভোগের কথা বলছে৷ সব চেটেপুটে না খেয়ে, পৃথিবীকে নিঃশেষ না করে দিয়ে টেকসই ভোগের মাধ্যমে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশকে সংরক্ষণ করার কথা হচ্ছে৷ আর ঠিক এই রকম বৈশ্বিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমরা বাংলাদেশের পাটশিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনা খুঁজতে চাই৷ পরিবেশবান্ধব পাটকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার কৌশল হাজির করতে চাই৷
আমাদের পাটশিল্প সময়ে সময়ে কত উত্থান-পতন দেখেছে! আদমজীসহ অনেক পাটকলকে খুন করা হয়েছে৷ খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে অনেক পাটকল৷ শ্রমিকেরা বেকার হয়ে কেউ চায়ের দোকানে কাজ নিয়েছেন, কেউ বহুতল ভবনের দারোয়ান হয়েছেন৷ আর কেউ এখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে মজুরির জন্য প্রতিবাদ করছেন৷ কিন্তু আমাদের কৃষকেরা যুগের পর যুগ ধরে পাটের সঙ্গে রয়ে গেছেন৷ এক বছর হয়তো পাটের দাম কম পেয়েছেন, কিন্তু পরের বছর ঠিকই নানান সংশয় আর দ্বিধা মাথায় নিয়ে আবার পাট চাষে মজেছেন৷ পাটের জন্য কৃষকের এই দরদ, ভালোবাসা পাটশিল্পের সম্ভাবনাকে প্রতিনিয়ত বাঁচিয়ে রাখছে, এগিয়ে নিচ্ছে৷ আমরা জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের যে কঠিন সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি, সেখানেও আমাদের পাটচাষিরা, আমাদের কৃষকের বরাবরের মতো অবতার হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন৷ গবেষণায় দেখা গেছে, একজন কৃষক এক হেক্টর জমিতে পাট চাষ করলে তা মোট ১০০ দিনে ১৫ টন কার্বন ডাই অক্সাইড প্রকৃতি থেকে শোষণ করে, আর ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতিকে দেয়৷ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৮ লাখ ১৭ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে, যাকে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাটের ফলনে স্মরণকালের রেকর্ড বলে মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদরা৷ এই চাষকৃত পাট প্রকৃতিকে কী পরিমাণ অক্সিজেন দিয়েছে আর প্রকৃতি থেকে কী পরিমাণ কার্বন বিষ শোষণ করেছে, সে হিসাব কষতে ক্যালকুলেটর নিয়ে বসতে হবে!
কিন্তু এসবের পরও কৃষকদের জন্য আমরা তেমন কিছু করে উঠতে পারছি না৷ এখনো ভরা হাটে কাঁচাপাট পুড়িয়ে কৃষককে প্রতিবাদ করতে হয়৷ ঠিকমতো দাম না পাওয়ার বিষয় তো আছেই, পাশাপাশি দেশের বেশিরভাগ জেলায় ফড়িয়া পাট ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট আছে৷ ওনারা সিন্ডিকেট করে পাটচাষীদের কম মূল্য দেন৷ আবার অনেক সময় দেখা যায় মণপ্রতি পাটে কৃষকদের থেকে বাধ্যতামূলকভাবে দুই কেজি পাট বেশি নেন, যেটার দাম ব্যবসায়ীরা পরিশোধ করে না৷ কৃষকরা যে প্রতিবাদ করেন না, তা নয়৷ কিন্তু প্রতিবাদ করলে ব্যবসায়ীরা পাট কেনা বন্ধ করে কৃষকদের হয়রানি করেন৷
এরপর আসি পাটবীজের প্রসঙ্গে৷ বাংলাদেশে কৃষকের জন্য মানসম্পন্ন পাটবীজ পাওয়াটাও একটা মস্ত চ্যালেঞ্জ৷ এছাড়া পাট বীজের আমাদানিনির্ভরতা খুব ভোগাচ্ছে কৃষকদের৷ বর্তমানে চাহিদার বেশিরভাগ পাটবীজ আসে বাইরে থেকে৷ অথচ পাকিস্তান আমলে এমনকি বাংলাদেশ হওয়ার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এদেশের বীজ দিয়েই এখানকার পাটের সব জমিতে পাট চাষ সম্ভব হতো৷ বর্তমানে দেশে পাটবীজ উত্পাদন করে সরকারের ৪টি বিভাগ৷ গত অর্থবছর এসব প্রতিষ্ঠান ৫ হাজার মেট্রিক টন প্রয়োজনের বিপরীতে উত্পাদন করে ২ হাজার ৪শ' মেট্রিক টন৷ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চলতি অর্থবছর অভ্যন্তরীন উত্পাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ঘাটতি থাকবে আরো ৩০০০ মেট্রিক টনের মতো বীজের৷ এই ঘাটতি মোকাবেলায় আমরা বেশি দাম দিয়ে অনেকক্ষেত্রে মানহীন পাটবীজ কিনে আনি৷ ফলে চড়া দামে খারাপ মানের পাট বীজ কৃষককে কিনতে হয়, যা পাটের ভালো ফলনের জন্য বিশাল এক হুমকি৷
পাটবীজের ক্ষেত্রে এই পরনির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে হবে যে কোনো মূল্যে৷ সরকার কৃষককে পাটবীজ উত্পাদনের যে প্রশিক্ষণ দেয়, সেটাকে আরো টেকসই ও কার্যকর কিভাবে করা যায়, সেটা ভাবতে হবে৷ উন্নত মানের পাটবীজ উত্পাদন, বিক্রয় বা বাজারজাতকরণে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে৷ এছাড়া পাট জাঁগ দেয়া, খড়ি থেকে খুলে আঁটিবাঁধাসহ বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশে যে দেশজ এবং পুরনো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তাতে পাটের রং ভালো থাকে না৷ অনেক জায়গায় এখনও দেখা যায়, পাট জাঁক দেয়ার পর, সেটার ওপর ভর দেয়ার জন্য শক্ত মাটির দলা ব্যবহার করা হয়, যা পাটের আঁশকে কালো করে দেয়৷ সামান্য এই না জানাটুকু কৃষককে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়৷ তাই কৃষককে নিত্য-নতুন লাগসই প্রযুক্তি সরবরাহের পাশাপাশি ছোট ছোট সাধারণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান পৌছে দিতে হবে৷ একই সাথে কৃষকের সঠিক সময়ে সার ও পাটবীজ প্রাপ্তি এবং কৃষি জ্ঞান সরবরাহের জন্য অ্যাপ তৈরির ব্যবস্থাও করা যেতে পারে৷
সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে বিশ্বময় পাটের বাজার সম্প্রসারণের নতুন সম্ভাবনার আলো ছড়িয়ে পড়ছে৷ যাঁরা পাটের সুদিন হারিয়ে গিয়েছে, ফুরিয়ে গেছে বলে হাহাকার করেন, তাঁদের জন্য কিছু তথ্য দেই৷ ১৮৫০ সালে বাংলায় মাত্র ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে হতো পাট চাষ৷ আর এর ঠিক ৫০ বছর পরে ১৯০০ সালে বাংলায় পাট চাষের জমির পরিমাণ ৫০ হাজার হেক্টর হয়ে যায়৷ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে ২০১৬ সালে দেশে পাটচাষ হয় ৮ লাখ ১৭ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমিতে৷ সব সীমাবদ্ধতার পরেও প্রতিনিয়ত পাটচাষের পরিমাণ বাড়ার এ চিত্র আমাদেরকে সামনের দিকে তাকাতে উত্সাহিত করে৷ কাঁচা পাটের পাশাপাশি বাংলাদেশের বহুমুখী পাটপণ্য পৃথিবীর অসংখ্য দেশে রপ্তানি হয়৷ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের শ্রমে-ঘামে পাটশিল্প নতুন পথের দিশা খুঁজে পাচ্ছে৷ সরকার বিভিন্ন পণ্যে পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে৷ 'পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০-এর ধারা ২২ এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার বিধিমালা, ২০১৩-এর অধিকতর সংশোধন করে 'পোল্ট্রি' ও 'ফিস ফিড' সংরক্ষণ ও পরিবহনে পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামুলক করে৷ আইন অনুযায়ী, ছয়টি পণ্য –ধান, চাল, গম, ভূট্টা, সার ও চিনি পাটজাত মোড়কে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়৷ পরে ২০১৭ সালের ২১ জানুয়ারি মরিচ, হলুদ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, ধনিয়া, আলু, আটা, ময়দা, তুষ-খুদ-কুড়াসহ মোট ১৭টি পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়৷ ওই আইন অনুযায়ী, পাটের মোড়ক ব্যবহার না করলে অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে৷ অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের চাহিদা ও ব্যবহার দুটোই বৃদ্ধি পেতে পারে এই আইনের কার্যকর প্রয়োগের ফলে৷ সরকারি হিসেবে, এ আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে পারলে বছরে অভ্যন্তরীণ বাজারে ১০০ কোটি টাকার পাটের বস্তার ব্যবহার বাড়বে৷
সম্প্রতি পাট নিয়ে অনেক অনেক গল্প হাজির হচ্ছে আমাদের সামনে৷ নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের গোলাহাট চিনি মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় পাটপণ্য উত্পাদনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন সমাজের অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া নারীরা৷ সৈয়দপুর এন্টারপ্রাইজ নামের এ প্রতিষ্ঠানে তৈরি চটের রকমারি ব্যাগ ও হাতে বানানো কার্ড রপ্তানি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ক্যানাডা, নিউজিল্যান্ড, নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে৷ পাঠক হয়তো বিশ্বাস করবেন না, গ্রামীন নারীদের এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি বছরের রপ্তানি আয় দুই কোটি টাকা! ঢাকার মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে আবু নোমান নামের এই সাইকেলের মিস্ত্রি পাট দিয়ে সাইকেল তৈরি করেছেন৷ আবু নোমানের এই পাট দিয়ে বানানো সাইকেলের ফ্রেম আর দশটা স্টিলের ফ্রেমের মতোই মজবুত৷ এই তরুণ ভবিষ্যতে পাট দিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলবার, সিট পোস্ট, রিম, ফর্ক বানানোর কথা ভাবছেন৷ তাহমিদুল ইসলাম নামের এক উদ্যোক্তা পাট দিয়ে বাহারি ডিজাইনের ভীষণ নান্দনিক জুতো তৈরি করছেন দীর্ঘদিন ধরে৷ তিনি পাট দিয়ে বিশ্বমানের জুতার ব্র্যান্ড তৈরি করতে চান৷ এক উদ্যোক্তা পাট দিয়ে ঢেউটিন থেকে চেয়ার, সবকিছু বানানোর কাজ করছেন৷ পাট গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা পাটের পাতা থেকে চা উদ্ভাবনের কথা শুনিয়েছেন সম্প্রতি৷ পাট শাকের যে ভেষজ গুণ, তার সবটুকুই এই পাটের চায়ে পাবেন চা-প্রেমীরা ৷ আর সে কারণেই এই চা খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পাবে বলে বিজ্ঞানী ও উদ্যোক্তাদের আশা৷ সম্প্রতি জার্মানিতে এই চা রপ্তানি করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে৷ হ্যাঁ, এই গল্পগুলো আমাদেরকে সামনের দিকে চোখ মেলে তাকাতে বলে৷ পাটকে নিয়ে নতুন করে ভাবার, কাজ করার কথা সামনে নিয়ে আসে৷
বাংলাদেশ পাট কল কর্পোরেশন (বিজেএমসি)-র আওতাধীন পাটকলগুলোর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৩টি পাটকলের আধুনিকায়নে (ঢাকার করিম জুট মিলস, চট্টগ্রামের আমিন জুট মিলস ও খুলনার প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলস) চীনের সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই করেছে সরকার৷ আর মাত্র তিনটি পাটকল আধুনিকায়নে খরচ ধরা হয়েছে ৩৪০ মিলিয়ন ডলার৷ এই এত এত টাকা খরচ করে পাটকল আধুনিকায়নের যে স্বপ্ন, সেটা একদিকে যেমন আমাদের সক্ষমতা ও সাহসিকতার বার্তা জানান দেয়, তেমনি পাটের সোনালি সুদিনের ইঙ্গিতও আমরা পাই৷ বর্তমানে আমরা প্রতি টন কাঁচা পাট রপ্তানি করে ৫/৬শ' ডলার পাই৷ কিন্তু মিলগুলো আধুনিকায়ন করার পর সেখানে পাটের শাড়ি, সোফা, কভার ইত্যাদি পণ্য তৈরি করা সম্ভব হবে৷ এর মাধ্যমে প্রতি টন পাট থেকে ১০ হাজার ডলারের পণ্য উত্পাদন করা যাবে৷ এছাড়া আধুনিকায়নের ফলে তিনটি পাটকলে ৫৩ দশমিক ৩৫ একর জমিতে বছরে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৫শ' মেট্রিক টন পাট পণ্য উত্পাদন সম্ভব হবে৷
সোনালি আঁশ পাটের হারানো দিন ফেরাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার৷ মানসম্মত পাট উত্পাদন, পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, পাটপণ্যের বহুমুখিকরণ, পাটকলের আধুনিকায়ন, পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ– এই পাঁচটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘জাতীয় পাটনীতি-২০১৮' এর খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা৷ পাটশিল্প উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অসংখ্য পরিকল্পনার অবতারনা করা হয়েছে এ পাটনীতিতে৷ এতে পাট শিল্পের উন্নয়নে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ ও নতুন ডিজাইন উদ্ভাবনে গবেষণা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অর্জনে জোর দেয়া হয়েছে৷ পাটপণ্য উত্পাদন ও প্রযুক্তির উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য গবেষণার পাশাপাশি একটি পাটপণ্য ও পাট প্রযুক্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথা বলা হয়েছে৷ একটি পরিপূর্ণ ডিজাইন ও উন্নয়ন ইনস্টিটিউট স্থাপনের মাধ্যমে পাট খাতে নতুন নতুন ধারণার উদ্ভাবনকে উত্সাহিত করার কথা বলা হয়েছে৷ এছাড়া পাটপণ্য ও বহুমুখি পাটপণ্যের উত্পাদন ও উন্নয়নের গবেষণা কার্যক্রমে সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার পাশাপাশি গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি প্রদানের কথা বলা হয়েছে৷ গোটা বাংলাদেশ এই পাটনীতির সফল বাস্তবায়নের অপেক্ষায় বসে আছে৷ পাটনীতির বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের পাটশিল্প যে নতুন একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াবে, সেখান থেকে সামনে এগিয়ে যাওয়া আরো সহজ হবে৷
এছাড়া পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ২০১৭ সালের ৬ মার্চ প্রথমবারের মতো জাতীয় পাট দিবস পালন করে বাংলাদেশ৷ পাটশিল্পের জন্য, বাংলাদেশের জন্য এটি নিশ্চিতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়৷ দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে পাট নিয়ে আমাদের উত্সাহ ও জনসচেতনতা যেমন বাড়ছে, তেমনি স্বপ্ন দেখার পরিসরটাও বড় হচ্ছে৷
সরকারের এসব উদ্যোগ, পাটশিল্পকে এগিয়ে নেয়ার এসব প্রচেষ্টার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে৷ ঘরের দরকারি সব পণ্যের মধ্যে অন্তত একটি করে পণ্যও যদি আমরা পাটের ব্যবহার করতে পারি, দেশে পাটের একটা বড় বাজার তৈরি হবে৷ অনেক পাটপণ্য তৈরি ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কেবলমাত্র রপ্তানির জন্যই পণ্য তৈরি করেন৷ পাটপণ্য উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশি বাজারের পাশাপাশি দেশি বাজারের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে৷ দেশে কিভাবে পাটপণ্যকে জনপ্রিয় করা যায়, সাধারণ মানুষের মধ্যে পাটপণ্যের প্রতি ভালোবাসা ও ক্রয় চাহিদা বাড়ানো যায়, সেই কাজটাও এগিয়ে নিতে হবে৷ পরিবেশবান্ধব শৈশব তৈরির জন্য আমরা শিশুদের হাতে পাটের স্কুলব্যাগ, পেনসিল বক্স তুলে দিতে পারি৷ এতে শৈশবে আমাদের শিশুরা যেমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পাটকে চিনবে, তেমনি ওদের মধ্যে পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় ইতিবাচক মানসিকতাও তৈরি হবে৷ শিশুদের পাঠ্য বইয়ে ‘পাট আমাদের সোনালি আঁশ'সুলভ মুখস্থ কথাবার্তা না লিখে বইয়ের পাতায় বাহারি পাটপণ্যের ছবি দিয়ে আলাদা পরিচ্ছদের সংযোজন করতে পারি, যা আমাদের শিশুদেরকে পাটের প্রতি ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে৷ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে গিয়ে পাটপণ্যের প্রদর্শনী করতে পারি৷ তরুণদেরকে ডেকে ডেকে বলতে পারি, চলো; পাটকে ভালোবাসি৷ দেশি বিদেশি কত প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন কত সেমিনার, সভা, কর্মশালা করছে৷ আমরা এসব আয়োজনে পাটের পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে পারি৷ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ বাস করেন৷ তাঁদের প্রত্যেকেই একজন করে ‘জুট অ্যাম্বাসেডর' হয়ে উঠতে পারেন৷ আমাদের পাটপণ্যকে গ্লোবালি কানেক্ট করতে হলে প্রবাসী বাঙালিরদের এগিয়ে আসার আহবান জানাতে পারি৷ তাঁরা যাতে বিদেশে পাটের রপ্তানি বাজারকে বিকশিত করতে পারেন, সেজন্য তাঁদের তথ্যসহ অন্যান্য সহায়তা দেয়ার জায়গা গড়ে তুলতে হবে৷
পাটপণ্য তৈরিতে নতুন উদ্যোক্তাদের নানা ঝক্কি পোহাতে হয় নানা সময়৷ সময়মতো ফেব্রিকস পান না, ফেব্রিকস পেলেও সেগুলো মানোত্তীর্ণ না, দামেও পাশের দেশ ভারতের চেয়ে বেশি৷ তাই বিশ্ববাজারে মান ও দাম নিয়ে অন্যান্য দেশের সাথে নিয়মিত লড়াই করতে হয় উদ্যোক্তাদের৷ এই সমস্যাগুলো থেকে তাঁদের রেহাই দিতে হবে, যাতে একজন উদ্যোক্তাকে কাঁচামাল প্রাপ্তি ও ক্রয়ে কোনো ধরনের সমস্যায় ভুগতে না হয়৷ বিষয়টা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে রাষ্ট্রকে৷ আর এজন্য যা যা করতে হয়, তা-ই করা কর্তব্য৷ নতুন উদ্যোক্তার বিকাশে মনোযোগী হতে হবে৷ যত্ন না করে রত্নের আশা করা বোকামি৷ পাটশিল্পের প্রতি যত্ন, দরদ ও মনোযোগ বাড়াতে হবে৷ সম্প্রতি পাটচাষি, পাটপণ্য উদ্যোক্তা, পাটপণ্য বিপণন ও রপ্তানিকারকদের জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার একটি জুট ফান্ড তৈরির খসড়া তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে কৃষক থেকে শুরু করে পাটপণ্য উদ্যোক্তারা ৫% সুদে ঋণ নিতে পারবেন৷ এই ফান্ডে যথাযথ ও সঠিক ব্যবহার পাটশিল্পের মেরুদণ্ডকে আরো শক্ত করতে সহযোগিতা করতে পারে৷
পাঠক, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৯৬ কোটি ২৪ লাখ ডলার, কাঁচা পাট রপ্তানিতে আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৭৮ লাখ ডলার, পাট সুতা ও কুণ্ডলী রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৬০ কোটি ৭৮ লাখ ডলার, পাটের বস্তা ও ব্যাগ রপ্তানি হয়েছে ১২ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের এবং পাটজাত অন্যান্য পণ্য থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৬ কোটি ৯১ লাখ ডলার৷ চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) পাট এবং পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ৬৬ কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলার, যা এ সময়ের কৌশলগত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১০ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বেশি৷ বহুমখি পাটপণ্যের পাশাপাশি পাটকাঠির ছাই হয়ে উঠছে অন্যতম রপ্তানিযোগ্য পণ্য৷ পাটকাঠি পুড়িয়ে যে অ্যাক্টিভেটেড কার্বন তৈরি হয়, সেগুলো ওষুধ শিল্প, পানি ও বাতাস বিশুদ্ধকরণ শিল্প, আতশবাজির কারখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে বিশ্বময়৷ এমনকি এই পাটকাঠির ছাই জমির উর্বরতা বিশুদ্ধকরণেও কার্যকরী উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ এই পাটকাঠির ছাই আমরা বর্তমানে কেবল চীনে রপ্তানি করছি৷ খুড়িয়ে খুড়িয়ে, একটু একটু করে পাটকাঠি দিয়ে যে রপ্তানিযোগ্য পণ্য তৈরি করে চলেছেন আমাদের উদ্যোক্তারা, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সেটার বাজার তৈরি করতে পারলে বাংলাদেশের বদলে যেতে বেশি সময় লাগবে না৷ দেশে প্রতিবছর আমরা যে পাটকাঠি উত্পাদন করি, তার অর্ধেকও যদি পুড়িয়ে বিদেশে রপ্তানি করতে পারি, তা ফি বছর বাংলাদেশকে আড়াই হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা এনে দেবে৷
কৃষকের শ্রম-ঘাম, উদ্যোক্তাদের প্রতিদিনকার লড়াই বাংলাদেশ পাটশিল্পকে নতুন একটা মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছে৷ বিশ্বের যেসব বড় বড় সংস্থা টেকসই ভোগের কথা বলছে, তাদের হাতে পাটের পণ্য তুলে দিতে হবে৷ দুনিয়ার বড় বড় প্রতিষ্ঠান যাতে পাটের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে, সেজন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যোগাযোগ বাড়াতে হবে৷ আর এই কাজটা করার দায়িত্ব সকলের৷ উদ্যোক্তাদের নিজেদের যোগাযোগ দক্ষতা বাড়াতে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিভাবে পাটপণ্যের ব্র্যান্ডিং আরো কার্যকরভাবে করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে৷ পাটপণ্যকে জনপ্রিয় করার জন্য দেশ ও দেশের বাইরে নানা ধরনের ক্যাম্পেইন করতে হবে৷ প্রশাসনে কিছু দক্ষ মানুষ চাই, যাঁরা দুনিয়া ঘুরে ঘুরে পাটপণ্যের মার্কেটিং করবেন৷ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাটপণ্যবান্ধব সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে৷ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ বাস করেন৷ তাঁদের প্রত্যেকেই একজন করে ‘জুট এ্যাম্বাসেডর' হয়ে উঠতে পারেন৷ আমাদের পাটপণ্যকে গ্লোবালি কানেক্ট করতে হলে প্রবাসী বাঙালিদের এগিয়ে আসার আহবান জানাতে পারি৷ তারা যাতে বিদেশে পাটের রপ্তানি বাজারকে বিকশিত করতে পারেন, সেজন্য তাঁদের তথ্যসহ অন্যান্য সহায়তা দেয়ার জায়গা গড়ে তুলতে হবে৷ গোটা বিশ্বে পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্র্যান্ড হিসেবে বহুমুখি পাটপণ্যকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে পারলে বাংলাদেশকে কেউ আর দাবায়ে রাখতে পারবে না৷ পাট আমাদের শক্তি আর সম্ভবনার জায়গা, এই সহজ কথাটি অনুধাবন করার সময় এখনই৷
পাটকে এগিয়ে নিতে সবার পাটের জন্য ভালোবাসা চাই৷ চাই নিখাদ আন্তরিকতা,কর্মনিষ্ঠা আর সততা৷ পাট বড় হোক, বাংলাদেশ বড় হোক৷
পাটশিল্পকে এগিয়ে নিতে কি পারবে বাংলাদেশ? লিখুন নীচের ঘরে৷