‘পাট চাষ করে আর সংসার চলে না'
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ডয়চে ভেলে : পাট চাষে আপনাদের খরচ হয় কেমন?
আকবর সিকদার : প্রতি শতাংশে ৭ থেকে ৮শ' টাকা খরচ হয়৷
একমন পাট উৎপাদন করতে কত শতাংশ জমি লাগে?
তিন শতাংশ জমি লাগে৷
একমন পাট কত টাকায় বিক্রি করেন?
বর্তমান বাজার দর ২ হাজার ২০০ টাকা৷ এক নম্বর পাট যেটা...
পাট উৎপাদনে আপনাদের যে খরচ হচ্ছে, বিক্রি করে সেটা তো উঠছে না...
না৷
তাহলে আপনারা যাঁরা পাট চাষ করেন, তাঁরা কিভাবে সংসার চালাচ্ছেন?
জমিতে তো আর এক ফসল হয় না৷ দুই বা তিন ফসল হয়৷ কোনো কোনো বছর আমরা আশায় থাকি এ বছর দাম ভালো পাওয়া যাবে৷ আশায় আশায় দিন যায় আমাদের৷
পাট চাষ করে যদি খরচের টাকাই না উঠে তাহলে আপনারা কেন চাষ করছেন?
আমরা করি, কারণ, সরকার বলে এ বছর ভালো রেট দেয়া হবে৷ আগামী বছর ভালো রেট দেয়া হবে৷ আশায় আশায় আমরা পাট বুনি৷ কোনো কোনো সময় ভালো রেট পেয়ে যাই, আবার কোনো কোনো সময় পাই না৷ আমরা নিজেরা শ্রম দেই৷ কাদা, পানি, বৃষ্টি, রোদ এভাবে কতক্ষন পারা যায়! সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা শ্রম দিতেই থাকি৷ পাটে অনেক শ্রম দিতে হয়৷
পাটের দাম আগের তুলনায় কমেছে না বেড়েছে?
পাটের দাম আগের বছরের তুলনায় এবার একটু ভালো৷
পাট বিক্রি করা কি সহজ হয়েছে, নাকিএখনো কঠিন?
যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের এলাকায় ভালো, এ কারণে বিক্রি করা সহজ হয়ে গেছে৷
কিভাবে বিক্রি করেন?
আমরা মন হিসেবে বিক্রি করি৷ বেশি পাট হলে পাইকাররা বাড়িতে আসে, আর কম হলে আমরা হাটে নিয়ে বিক্রি করি৷
এভাবে বিক্রি করে আপনারা কি সঠিক মূল্য পাচ্ছেন?
আমরাও কিন্তু যাচাই-বাছাই করি৷ অন্য হাটে এক নম্বর পাটটা কত রেট, আর দুই নম্বর পাটটা কত রেট৷ এগুলো খোঁজ-খবর নিয়েই আমরা পাট বিক্রি করি৷
মধ্যসত্তভোগী যাদের বলি, ফড়িয়া বা দালাল, তাদের এখানে কি কোনো প্রভাব আছে?
পাইকারি ব্যবসায়ী অনেক৷ সে কারণে আমরা দালাল বা ফড়িয়ার খপ্পড়ে পড়ি না৷
পাইকাররা জুট মিলে কত টাকায় বিক্রি করে এ বিষয়ে কোনো ধারণা আছে?
না, আমাদের কোন ধারণা নেই৷ কোনো কোনো পাইকার আমাদের বলে, ভালো রেট পাইছি৷ প্রতি মনে ৫০ টাকা বা ১০০ টাকা তাদের লাভ হচ্ছে৷ আবার অনেকে কিছুই বলে না৷ আসলে তারা কত টাকায় বিক্রি করে তা আমরা জানতে পারি না৷
সরকার পাটের একটা নূন্যতম দাম নির্ধারণ করে দেয়, তা কি আপনারা জানেন?
তৃণমূল পর্যায়ের কৃষক এটা জানতে পারে না৷ তবে অনেকে জানতে পারেন৷ যাঁরা টিভি দেখেন বা পত্রিকা পড়েন, তাঁরা কিছু কিছু জানেন৷ কিন্তু দেশের অধিকাংশ কৃষকই তো একেবারে ক্ষুদ্র কৃষক, তাঁরা এগুলো জানতে পারেন না৷
পাটের ফলন আগের চেয়ে কমেছে না বেড়েছে?
আগের চেয়ে বেড়েছে৷
কেন বেড়েছে?
কারণ এখন আধুনিক চাষ ব্যবস্থা, সেচ ব্যবস্থা ভালো৷ পানি দেয়ার জন্য ছোট ছোট মেশিন বের হয়েছে৷ পানি দেয়া সহজ হয়েছে৷ কীটনাশকও ঠিকমতো পাওয়া যায়৷
বৈজ্ঞানিক উপায়ে পাট চাষের জন্য কৃষিবিভাগ থেকে কি আপনারা কোনো সহযোগিতা পান?
তাঁরা পরামর্শ দেয়, কিন্তু জোরালোভাবে দেয় না৷ তাঁদের মাঠকর্মী আছে, ব্লক সুপারভাইজার আছে, তাঁদের সিজনে সিজনে একটু দেখি৷ এরপর তাঁদের আর দেখা যায় না৷
তাঁদের পরামর্শ নিয়ে পাট চাষ করলে কি আসলে পাটের উৎপাদন বাড়ে?
উনারা যে পরামর্শ দেন সেই পরামর্শ শুনে অনেকেই পাট চাষ করেছেন৷ কিন্তু তাঁদের উৎপাদন আশানুরূপ হয়নি৷ দেখা গেছে, ব্লক সুপারভাইজারের পরামর্শ ছাড়া যেসব কৃষক পাট চাষ করেছেন, তাঁদের ফসলই ভালো হয়েছে৷
আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে পাটের ফলন বাড়া বা কমার কি কোনো সম্পর্ক আছে?
এ ব্যাপারে তো বাংলাদেশ এক নম্বরে৷ আবহাওয়া যদি ভালো থাকে, তাহলে পাটের উৎপাদন ভালো হয়৷ আমাদের দেশে চৈত্র মাসে পাট চাষ শুরু হয়৷ চৈত্র মাসের ১২ তারিখ থেকে শুরু করে পুরো বৈশাখ পর্যন্ত দুই জাতের পাট চাষ করা হয়৷ চৈত্র মাসে যদি আমরা প্রকৃতির আশায় বসে থাকি, তাহলে অনেকে পানি পাই, অনেকে পাই না৷ আর মেশিন দিয়ে সেচ দিয়ে যদি আমরা চাষ শুরু করি, তাহলে ফসল ভালো হয়৷ খর যদি বেশি থাকে, তাহলে মাটি ফেটে যায়৷ তখন পানির প্রয়োজন হয়৷ বৃষ্টির প্রয়োজন হয়৷ কোনো কোনো বছর দেখা গেছে দুই-তিন দিন খরা গেছে, এরপর বৃষ্টি পড়ে গেছে৷ তাহলে পাটের ফলনটা খুব ভালো হয়৷
পাট চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে ,না কমছে?
যখন কৃষক পাটের রেটটা ভালো পায়, তখন তাঁদের আগ্রহ বেড়ে যায়৷
আর দাম কমে গেলে আগ্রহ কমে যায়?
হ্যাঁ, দাম কমে গেলে আগ্রহ কমে যায়৷
দাম কমে গেলে, চাষও কমে যায়৷ তখন তো দেখা যায় হুট করে দাম আবার বেড়ে যাচ্ছে?
বাংলাদেশে মোট পাট উৎপাদন যদি কম হয়, তাহলে দেখা যায় চাহিদা বেড়ে যায়৷ তখন রেটটা আবার বেড়ে যায়৷
পাটকে তো সোনালিআঁশ বলা হতো৷ এখন পাটের সেই দিন নেই কেন?
কৃষকরা পাট বাজারে নিয়ে ঠিকমতো দাম পায় না৷ কোনো কোনো সময় দেখা যায় নৌকায় করে বা ভ্যানে পাট বাজারে নিয়ে আবার ফেরত আনতে হয়েছে৷ ভালো দাম না পাওয়ার কারণে৷ এতে কিন্তু কৃষকের খরচ বেড়ে যাচ্ছে৷ এমন দাম বলে যা খরচের চেয়েও কম৷ তখন তো ফেরত আনতেই হয়৷ ভালো দাম না পেয়ে কৃষক হাটে গিয়ে পাটে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে এমন ইতিহাসও আনেক আছে৷ কয়েকটা বছর ধরে পাটের রেটও ভালো দিচ্ছে৷ এই কারণে পাট চাষে কৃষকদের আগ্রহ কিছুটা বাড়ছে৷ আর প্রতি বছরই সরকার কিছু প্রলোভন দেয় যে, আপনারা পাট চাষ করেন, আগামী বছর ভালো দাম দেয়া হবে৷ কিন্তু বাজারে যাওয়ার পর সেই দাম আর পাওয়া যায় না৷
পাটের ফলন বাড়াতে হলে আরো কি কি করা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক ক্ষুদ্র চাষি, তাঁরা দরিদ্র৷ তাঁরা আসলে অর্থ সংকটেই বেশি ভোগে৷ তখন দেখা যাচ্ছে সময়মতো তাঁরা বীজ পাচ্ছে না, হাল (লাঙল বা ট্রাকটার) পাচ্ছে না, সার পাচ্ছে না, কীটনাকশক পাচ্ছে না, সেচ দিতে পারছে না৷ ফলে সময়মতো তাঁরা রোপনও করতে পারে না৷ ফলে তাঁদের আর আগ্রহ থাকে না৷
একজন পাট চাষি হিসেবে আপনি সরকারের কাছে কি চাইবেন?
আমি চাইব, পাট চাষের সময়ের আগেই যেন কৃষকের হাতে বীজ, সার, কীটনাশক পৌঁছে দেয়া হয়৷ তাঁর হাল আছে কিনা, চাষ করার মতো টাকা আছে কিনা, সেগুলো যেন সরকার খোঁজ নেয় এবং না থাকলে দেয়ার ব্যবস্থা করে সহযোগিতা করে৷ তাহলে একজন চাষি আগেভাগে উদ্যোগ নিতে পারে৷ এবং যখন বুঝবে, তাঁর চাষের সব ব্যবস্থাই হচ্ছে, তখন সে আরো বেশি উদ্যোগী হবে, আগ্রহী হবে৷ঃ
পাটচাষিদের দূরাবস্থা কেন? লিখুন নীচের ঘরে৷