বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা
১০ এপ্রিল ২০১৮এরপরেও প্রধানত সমগোত্রীয় সমাজব্যবস্থা হয়েও বাংলাদেশ বিপজ্জনকভাবে একটি রাজনৈতিক সহিংসতাপ্রবণ দেশ থেকে ক্রমশ একটি উচ্চমাত্রার রাজনৈতিক সন্ত্রাসপ্রবণ দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে৷ অন্যদিকে বিচারহীনতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, সামাজিক সন্ত্রাস উদ্বেগজনকভাবে চলমান এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতার ঘাটতি বেড়েই যাচ্ছে৷ এমনকি নির্বাচনি সহিংসতায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও প্রাণহানি প্রায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হতে চলেছে৷ তদুপরি আশার বিষয়, বাংলাদেশ এলডিসিভুক্ত দেশ থেকে বেরিয়ে একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার দিকে যাত্রা শুরু করেছে৷ ২০২১ সালে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতও হতে পারে৷
কোনো সন্দেহ নেই, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও পরে জেনারেল জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব ও তাঁর বহুদলীয় গণতন্ত্রের আড়ালে অন্তত সতেরোটি ক্যু চেষ্টা, অতঃপর তাঁর হত্যাকাণ্ড এবং তার অল্পকাল পরেই জেনারেল এরশাদের প্রলম্বিত সামরিক শাসনে বাংলাদেশে কমবেশি উগ্রপন্থার বিস্তার ঘটেছে৷ জিয়া পর্বে সামরিক আদালতে উল্লেখযোগ্য সেনা সদস্যের ফাঁসি হওয়ারও একটি বিরাট অভিঘাত সমাজে পড়েছে৷ আবার জিয়া হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অভিযুক্ত জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডের আসামী হিসেবে জেনারেল এরশাদেও বিচারের কী ফলাফল হয়, সেদিকে সাধারণ মানুষের নজর ছিল৷ কিন্তু এর বিচার প্রক্রিয়া রহস্যজনকভাবে থেমে থেমে চলমান রয়েছে৷
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদের পতনের পরে বাংলাদেশে আইনের শাসন নির্ভর একটি দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হওয়ার যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল, তা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে৷ বাংলাদেশ আপাতত একটি রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণে তার ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে৷ একদিকে শান্তির ধর্ম ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের উদ্বেগজনক উত্থান, অন্যদিকে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে দা-কুমড়োর সম্পর্ক অব্যাহতভাবে আরো অবনতিশীল হতে থাকা, বাংলাদেশের গোটা গণতন্ত্র ও শাসনগত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকরতা হ্রাস কিংবা ভঙ্গুর করে তুলছে৷
সুশাসন, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের ঘাটতি এবং সমাজের সর্বক্ষেত্রে অসহিষ্ণু মনোভাবের বিস্তার ঘটার কারণে সহিংসতা বলতে আর বোমাবাজি, ছোটোখাটো বন্দুকযুদ্ধ বা সরকারি গাড়ি বা সম্পদে আগুন দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই৷ একসময় কেউ খুন হলে চারপাশের গ্রাম বা এলাকা থমথমে অথবা জনশূণ্য হয়ে পড়তো, সেই বাংলাদেশকে আর কেউ এখন কল্পনাতেও আনতে পারেন না৷
গত প্রায় এক দশকের ব্যবধানে রাজনৈতিক সহিংসতার চরিত্র মৌলিকভাবে পালটেছে৷ বোমাবাজি করে ভয় দেখানোর দিন শেষ৷ এখন টার্গেট কিলিং বেড়েছে৷ আগের দশকে নিয়মিত সহিংসতা প্রধানত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে সীমিত ছিল৷ সেটা কমে গেছে৷ এটা বহুগুণে বেড়েছে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর মধ্যে৷ ২০১৬ সালে বিএনপির বয়কট করা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বোচনের সহিংসতায় নিহত হওয়া ১১৬ জনের মধ্যে ৭১ জনই ছিল আওয়ামী লীগের৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ৮৪৫টি সহিংসতার ঘটনায় ১০,১৪৫ আহত ও ১৪৬ জন নিহত হন৷ বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ১৬০টি ঘটনায় আহত ১৭০২ এবং নিহত হন ১৪ জন৷
দু'টি দায়মুক্তি
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি সশস্ত্র মুক্তিযদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়৷ সুতরাং সামাজিক ও রাজনৈতিক রেডিক্যালাইজেশনের একটি ধারা বাংলাদেশ তার জন্মসূত্রেই লাভ করেছিল৷ এর উপরে তার জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে দু'টি বড় ধরনের দায়মুক্তির ঘটনা ঘটে৷
প্রথমটি হলো গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে চূড়ান্তভাবে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের মাটিতে করতে না পারা৷ ১৯৭৩ সালে দিল্লিতে সার্বজনীন মানবাধিকারের বিচ্যুতি ঘটিয়ে এই বিষয়ে ত্রিদেশীয় চুক্তি (ভারত,বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) সই হলো৷ পাকিস্তানি শাসকবর্গ, গণহত্যাকারী এবং তাদের বাংলাদেশি দোসররা (প্রধানত জামায়াত-ই-ইসলামী) ওই চুক্তিকে আজও অন্তত একটি রাজনৈতিক ইনডেমনিটি হিসেবে দেখে আসছে৷
দ্বিতীয়ত, এর মাত্র দু'বছর না যেতেই ১৯৭৫ সালের আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন এবং ৩ নভেম্বরে ইতিহাসের বর্বোরোচিত জেল হত্যার ঘটনা ঘটে৷ এবং দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসে ১৯৭৫ সালেই প্রথমবারের মতো হত্যার বিচার বন্ধ করে দিতে জারি করা হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ৷ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান পরে জাতীয় সংসদে নিয়মিত আইন হিসেবে তা পাস করিয়েছিলেন৷ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকাতায় হত্যাকারীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করাই শুধু নয়, একাদিক্রমে দুই সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া ও তাঁর উত্তরসূরি সেনা প্রধান জেনারেল এরশাদ খুনি চক্রকে রাষ্ট্রদূতের চাকরিতে নিয়োগ ও তাতে দীর্ঘকাল বহাল রেখেছিলেন৷
লক্ষণীয় যে, পঁচাত্তরের খুনিদের বিচার না করা এবং তাদের প্রশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে বিএনপি তার অবস্থান পরিষ্কার না করে বরং ১৫ আগস্টে বিতর্কিত জন্মদিন (বেগম খালেদা জিয়ার) পালন করার মধ্যেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি শাসনামলে ঘটল ইতিহাসের আরেকটি কলংকজনক অধ্যায়৷ গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন৷ বিএনপির বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে যে, তারা ওই গ্রেনেড হামলার সুবিচারের পথ নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে৷
‘ফ্রিডম পার্টির' পুনর্বাসন
১৯৯০ সালে এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলন, যাকে সফল করতে নূর হোসেন, সেলিম-দেলোয়ার, রাউফুন বসুনিয়াসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র-যুবক আত্মাহুতি দিয়েছিলেন৷ সাড়ে ন'বছর দীর্ঘ আন্দোলনকালে সমাজে উগ্রপন্থার বিস্তার ধীরগতিতে হলেও অব্যাহত থেকেছে৷ সেই উত্তাল পর্বেও জাতি দেখেছিল, খুনিদের সুউচ্চ রাজনৈতিক মর্যাদা দেওয়ার প্রচেষ্টা চলেছে৷ এরশাদ তাঁর সাজানো রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হতে খুনি চক্রের মূল নায়ক কর্নেল ফারুক রহমানকে রাষ্ট্রপতি পদে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী করিয়েছিলেন৷ বঙ্গবন্ধুর খুনিরা জেনারেল এরশাদের সামরিক আমলেই ‘ফ্রিডম পার্টি' পরিচয়ে জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেছিল৷ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বিএনপির পতনের দাবিতে আওয়ামীলীগ ও জামায়াতের সহিংস আন্দোলনকালে খুনিচক্র ফ্রিডম পার্টি নিজেদেরকে সংসদে নির্বাচিত নেতা হিসেবে দেখার পরিকল্পনা করে৷ এবং ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম এবং শেষবারের মতো ভোটারবিহীন এক প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত ষষ্ঠ সংসদে অন্যতম খুনি কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদকে ‘বিরোধী দলীয় নেতা' হিসেবে দেখা হয়েছিল৷ এরশাদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ফারুকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে৷ অন্যদিকে বর্তমানে কারাবন্দি বেগম খালেদা জিয়ার ‘পালিত' বিরোধী দলীয় নেতা কর্নেল রশীদ, যিনি ফারুকের ভায়রা ভাই, তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হিসেবে ফেরার রয়েছেন৷ আবার জেনারেল এরশাদ, যিনি একদা খুনিচক্রের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আওয়ামী লীগের দ্বারা নিন্দিত হয়েছেন, তাঁর শাসনামল যখন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অবৈধ ঘোষিত হয়, সেই মুহূর্তে তাকে মন্ত্রীর মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্বরত থাকতে দেখা যায়, যা তিনি এখনও রয়েছেন৷
জাসদের ভূমিকা
স্বাধীনতার পরে সমাজে উগ্রপন্থার বিস্তারে সিরাজুল আলম খানদের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল৷ অথচ দলটির সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন৷ মুক্তিযুদ্ধে পা হারানো কর্নেল তাহের, যিনি জিয়াউর রহমানকে তাঁর স্বপ্নের বিপ্লবের কাণ্ডারি ভেবেছিলেন এবং বন্দি দশা থেকে জিয়াকে উদ্ধারের পরে তাঁর নির্দেশেই ফাসির দড়িতে প্রাণ দিয়েছিলেন, তিনিই বঙ্গবন্ধুকে কেন কবরস্থ করা হয়েছিল, সেজন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন৷ বলেছিলেন, তাঁর লাশ বঙ্গোপসাগরেই নিক্ষেপ করা উচিত ছিল৷ ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের আগে জাসদ প্রেসিডেন্ট মুজিবকে বহনকারী গাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল৷ বলা হয়ে থাকে, তাহের দেশপ্রেমিক, কিন্তু তাঁর মুক্তির পথ ভ্রান্ত ছিল৷ তিনি সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সশস্ত্র বিপ্লবের বীজ বপন করেছিলেন৷ আবার জাসদের সশস্ত্র অঙ্গ গণবাহিনীকে ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় রক্ষীবাহিনী শক্তি ব্যয় করেছিল৷ অন্যদিকে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি হিংসাশ্রয়ী পথ বেছে নিয়েছিল৷ গ্রেপ্তারের পরে ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হওয়ার পর কয়েকটি দশক দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গোপন দলটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম কর রেখেছিল৷
অভ্যন্তরীণ কোন্দল
দুই প্রধান দলই অভ্যন্তরীণ গোলোযোগে হতাহতের বিষয়ে কোনো দলীয় পদক্ষেপ নিতে চায় না৷ তারা বিচারবিভাগের ওপর নির্ভরশীল থাকে৷ কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, দল কঠোর না হলে অভ্যন্তরীণ দলীয় সন্ত্রাসের সুষ্ঠু কিনারা পুলিশ বা আদালত দিতে পারে না৷ গত ৯ বছরে আওয়ামী লীগারের হাতে আওয়ামী লীগার খুনের সংখ্যা কম করে হলেও ২০০৷ কিন্তু এ সব হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়ার গতি অত্যন্ত মন্থর৷ পেশি শক্তির জোরে সমাজে আধিপত্য বিস্তার করাকে কেন্দ্র করেই এই হানহানির সূচনা৷
দলগুলো তার সদস্যদের সহিংসতার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে দলের ছত্রছায়ায় এমন অনেক দলীয় নেতা-কর্মীর আবির্ভাব ঘটছে, যারা পেশাদার অপরাধী৷ আবার বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারে বাংলাদেশের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে৷ কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, দুবৃত্তায়নের রাজনীতি আগের মতো আর ছোটোখাটো বিষয়ের মধ্যে সীমিত নেই৷ বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় দেখা গেছে, দলীয় প্রতিপক্ষকে সরাতে এলিট ফোর্স র্যাবকে ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে৷
বাংলাদেশ সমাজের আরেকটি বিপজ্জনক সাম্প্রতিক প্রবণতা হচ্ছে শুধু হত্যা করাই আর যথেষ্ট নয়৷ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে মৃত্যুকে ভয়াল করে তোলা হচ্ছে৷ সম্প্রতি ফেনিতে ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতাকে তাঁর গাড়িতে পেট্রোল ঢেলে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনায় ৩৯ জন দলীয় নেতা-কর্মীর ফাঁসি হয়েছে৷ তারা অভিযোগপত্রভুক্ত আসামী হওয়ার পরেও দল কিন্তু তাদের বহিষ্কারে পদক্ষেপ নেয়নি৷ এমনকি কিছু সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ উঠলেও সংসদ থেকে তাদের বহিষ্কারের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি৷ টাঙ্গাইলের একজন মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগারকে হত্যার দায়ে মুখ্য অভিযুক্ত সাংসদ ঢের বিলম্বে জেলে গেলেও দল থেকে বহিষ্কার করেনি৷ এর ফলে সহিংসতা ও হত্যার বিষয়ে রাষ্ট্রের যে দৃঢ় নৈতিক কোনো অবস্থান নেই, সেটাই পরিষ্কার হয়, যা অপরাধীদের উৎসাহিত করে৷ ব্যতিক্রম কিছু ছোট দল বাদে বিএনপি ও অন্যরাও মোটমুটি রাজনৈতিক দৃর্বৃত্তায়নে একইরকম দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে৷
‘বাংলা হবে আফগান'
বিএনপির শাসনামলে ঢাকার রাস্তায় সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেওয়া প্রত্যাগতদের একটি অংশ ‘আমরা সবই তালিবান, বাংলা হবে আফগান' স্লোগান তুলেছিল৷ রাজশাহীর অরণ্যে কথিতমতে আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট জেএমবি প্রধান বাংলা ভাই যখন অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করেছিলেন, তখন বিএনপির মেয়র তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দিয়েছিল৷ ২০০৫ সালে দেশের ৬৩টি জেলায় একদিনে একযোগে প্রায় ৫০০ বোমা হামলা থেকে মধ্যপ্রাচ্যে আকস্মিকভাবে আইএসের উত্থানের ধারায় ২০১৬ সালে গুলশান হোলি আর্টিজান আক্রমণে ২৯ জনের নিহত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে থেমে থেমে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জঙ্গি হামলা ও প্রাণহানি (বিদেশি ও ব্লগারদের টার্গেট করে হত্যা) বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে৷ অথচ রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ সমাজ সেকুলার, তার বড় প্রমাণ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে এই ভূখণ্ডের (বর্তমান বাংলাদেশ) মানুষ কোনো নির্বাচনে কখনও গড়ে ১২ শতাংশের বেশি ভোট ইসলামি দলগুলোকে দেয়নি৷ বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, জঙ্গিবাদী হামলার বিস্তার বাংলাদেশে যেটা ঘটেছে, তা প্রধানত প্রচলিত আইন ও আদালত ব্যবস্থার অকার্যকরতা এবং মাদ্রাসা ও মসজিদ ভিত্তিক ধর্মীয় শিক্ষাদানকারীদের একটি অংশের অজ্ঞানতা, উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাব এবং ধর্মীয় পাঠ্যপুস্তকের অনাধুনিকায়নের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে৷ আওয়ামী লীগ সরকার এসব বিষয়ে দেরীতে হলেও মনোযোগ দিয়েছে৷ কিন্তু তা এখনও পর্যাপ্ত নয়৷ তবে হোলি আর্টিজানের পরে একটা দীর্ঘ বিরতিতে সিলেটে অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর সম্প্রতি একটি ‘নিঃসঙ্গ নেকড়ের' হামলার ঘটনা ঘটেছে৷
অহিংস পথ!
সম্প্রতিতে প্রতিষ্ঠা পরবর্তী এই প্রথম টানা প্রায় এক যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিকে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে লিফলেট বিতরণের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে৷ তারা দেশের কোথাও পারতপক্ষে পুলিশ বা সরকারি দলের ক্যাডারদের সঙ্গে সংঘাতে যাচ্ছে না৷ কিন্তু তাই বলে তারা অহিংস পথ ধরেছে, তা ধরে নেওয়ার কারণ নেই৷
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আগের বছরে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচন করার প্রতিবাদ জানাতে কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপি৷ তখন এক নজিরবিহীন পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করেছিল বাংলাদেশ৷ যদিও দুই প্রধান দল এ জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করেছিল, কিন্তু দীর্ঘকালের চেনাজানা ‘রাজনৈতিক সহিংসতা'-র চেহারাটা বদলে গিয়েছিল৷ কারণ, সন্ত্রাসসৃষ্টিকারীরা পেট্রোল বোমাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল৷ এটা ছিল নজিরবিহীন৷ ওই সহিংসতায় ৫০ জনের বেশি নিহত হলেও আদালতে এ পর্যন্ত কারো শাস্তি হয়নি৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার আরেকটি উৎস হচ্ছে ক্যাম্পাস সহিংসতা৷ গত ৪৭ বছরে কয়েক শত ছাত্র ক্যাম্পাসে নিহত হলেও, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এর কোনো বিচার হয়নি৷ ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে সেভেন মার্ডারের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাস হত্যাকাণ্ডের সূচনা ঘটেছিল৷ ইদানীং ক্যাম্পাসে খুন হলে অভিযুক্ত ছাত্র বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে৷ বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদল প্রায় সর্বত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে৷ কিন্তু আশংকা করা হচ্ছে, কখনও পটপরিবর্তন হলে ক্যাম্পাসে এর ব্যাকল্যাশ হতে পারে৷ ক্যাম্পাসে যে একতরফা তৎপরতা চলছে, তার আড়ালে সহিংস প্রতিবাদের সম্ভাবনা ওঁৎ পেতে আছে৷
উপসংহার
এভাবে বাংলাদেশের ডামাডোলপূর্ণ ও সহিংস রাজনৈতিক আন্দোলন থেমে থেমে বিভিন্ন বাঁক নিচ্ছে৷ কিন্তু প্রায় কখনোই ন্যূনতম আইনের শাসন ও নীতিনৈতিকতা অনুসরণকে কখনও কোনো নির্বাচনি বা রাষ্ট্রীয় প্রচার-প্রচারণায় বড় কোনো ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা নজরে আসছে না৷ বরং ‘যে কোনো মূল্যে' টাকা কামানো, কর্তৃক প্রতিষ্ঠা এবং নির্বাচনে জয়লাভের মনোভাবটাই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে৷ নির্বাচন এবং সমাজে আধিপত্য বিস্তারই সমকালীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতার প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠছে৷ আবার আড়াই দশক নারী প্রধানমন্ত্রীদের অধীনে থেকেও বাংলাদেশ সর্বোচ্চ মাত্রায় নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছে৷
উগ্রপন্থার বিস্তার রোধে নাগরিক সমাজ বা যারাই যখন ভূমিকা রেখেছে, সবটাকেই ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধি' হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে লঘু বিষয় গণ্যে পাশ কাটানোর চেষ্টা চলেছে৷ একটা স্ববিরোধীতা কিংবা আত্মঘাতী রাজনীতি বাংলাদেশের অমোঘ নিয়তি হয়ে উঠেছে৷
বাংলাদেশে ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলন' সর্বদাই কৌশলগত এবং রাজপথ নির্ভর থকেছে৷ অথচ তাতে প্রায় কখনোই পুলিশ সংস্কার, বিচারক নিয়োগ ও বিচারবিভাগের স্বাধীনতা এবং ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার কার্যকরতা নিশ্চিত করার অভিপ্রায় বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি৷ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনগুলো শুধুই ক্ষমতার হাতবদল ঘটিয়েছে৷ থেমে থেমে বাংলাদেশের দীর্ঘ ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলন' কয়েক শত মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে৷ বহু মানুষকে পঙ্গুত্ব দিয়েছে৷ এসব অন্দোলন ব্যাপক ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারি সম্পদের ধ্বংস দেখেছে৷ সহিংসতার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের তারা কখনও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়ে মনোযোগ দেয়নি৷ আর রাজপথের বা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর সাধারণ প্রবণতাই হচ্ছে বিচার না হওয়া৷ দল বা গোষ্ঠী, যার যখন যেমনই হোক, কেউ নিহত হওয়ার পরে বিচারের আশা ছেড়ে দেওয়াটাই একটা স্বাভাবিক সামাজিক প্রবণতায় রূপ নিচ্ছে৷
পুলিশের সংস্কার বিষয়ে দাতাদের সমর্থনপুষ্ট একটি আইনের খসড়া সরকার আটকে রেখেছে৷ সরকার একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থা গঠনে প্রাথমিক চিন্তাভাবনা করছে৷ তবে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা, যার ঘাড়ে প্রায় ৩০ লাখ মামলা চেপে আছে, সেখানে ব্যতিক্রম বাদে কোনোভাবেই দ্রুত বিচার মিলছে না৷ প্রচলিত ব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন, বিশেষ করে দলের গণতন্ত্রায়ন ও জবাবদিহি এবং বিভিন্নক্ষেত্রে ডির্যাডিকালাইজ কর্মসূচি রাজনৈতিকভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার৷ গত বছরের নভেম্বরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বীকার করেছিলেন, ‘‘রাজনীতি থেকে সৌজন্য ও সহনশীলতা হারিয়ে গেছে, ওটা শুধু পোস্টার ও ব্যানারেই আছে৷'' বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো, রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধে শুদ্ধ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সৌজন্য ও সহনশীলতা পুনপ্রতিষ্ঠা করা৷
আপনিও কি মনে করেন, গণতন্ত্রায়ন ও জবাবদিহিতা এবং বিভিন্নক্ষেত্রে ডির্যাডিকালাইজ কর্মসূচি রাজনৈতিকভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার? লিখুন নীচের ঘরে৷