বাড়ির ছাদ, বারান্দা, কিংবা পাড়া মহল্লার অলিগলি৷ সবখানে পতপত করে উড়তে থাকে হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি কিংবা স্পেনের পতাকা৷
এই তো সপ্তাহ দুয়েক আগে অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে চোখ আটকে গেলো পাশের বাসার ছাদে৷ বিশাল আকৃতির জার্মানির পতাকা৷ ওপরে অবশ্য ছোট করে বাংলাদেশের পতাকাও আছে৷ কিন্তু আমি খানিকটা অবাক হয়েছি, পতাকাটা জার্মানির বলে৷ কারণ বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ যেখানে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলে বিভক্ত, সেখানে জার্মান ভক্তের এমন সরব উপস্থিতি৷
বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে এই উন্মাদনা যে শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক, তা কিন্তু নয়৷ গত সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে মিন্টু নামের একজন শখের বাগান বিক্রি আর স্ত্রীর জমানো মোট ৫ লাখ টাকা দিয়ে নিজের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার লম্বা দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা টানিয়েছেন৷ একই শহরে একজন তার পাঁচতলা বাড়ি ব্রাজিলের পতাকার রংয়ে রাঙিয়েছেন৷ মোটকথা বিশ্বকাপ শুরুর সময় যত ঘনিয়ে আসছে, উন্মাদনা ততোই বাড়ছে৷
ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আসার আগে থেকেই আমি আর্জেন্টিনার ভক্ত৷ কিন্তু সেদিন আমার পাঁচ বছর বয়সি মেয়ে শব্দ-কে জিজ্ঞেস করলাম, মা, তোমার কোন দল ভালো লাগে, ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা? ওর মা পাশে ছিল বলেই কিনা বেশ চটপট উত্তর দিলো আমি ব্রাজিলের সাপোর্টার৷ কেন, জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, তার জবাব, ‘মা ব্রাজিলের সাপোর্টার তাই আমিও৷’
আমার ধারণা বিশ্বকাপ নিয়ে এই যে বিভক্তি, এটা শুধু আমার বাসায় না৷ খেলা যারা পছন্দ করে এমন সবখানে৷
হাজার হাজার মাইল দূরের অচেনা-অজানা এই দেশগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশিদের এই যে আবেগের বহি:প্রকাশ, তা দেখে প্রায়ই মনে প্রশ্নে জাগে, কেন এমন আবেগী আর জোড়ালো সমর্থন৷ শুধু কি একজন মেসি, নেইমার কিংবা রোনালদোর কারণেই এতোটা মাতামাতি, নাকি অন্য কিছু৷
এই কারণ খোঁজার আগে চলুন জানার চেষ্টা করি, ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের এই যে আগ্রহ আর উন্মাদনা ঠিক কবে থেকে শুরু৷ এটা একেবারে দিন তারিখ নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না৷ তবে বাংলাদেশের মানুষের ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা বেশ পুরোনো৷ অর্থাৎ স্বাধীনতারও আগে থেকে ক্লাব ফুটবল বেশ জনপ্রিয় ছিলো এই অঞ্চলে৷ সেটা অব্যহত ছিলো ৯০ এর দশক পর্যন্ত৷
বর্তমান প্রজন্মের কাছে ব্যাপারটা একটু অবিশ্বাস্যই মনে হতে পারে৷ অথচ সে সময় আবাহনী-মোহামেডানের একটা ম্যাচকে কেন্দ্র করে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেত পুরো দেশ৷ বাড়িতে বাড়িতে উড়তো দুদলের পতাকা৷ খেলাকে কেন্দ্র করে ঝগড়াঝাটি, এমনকি মারামারি পর্যন্ত হতো আবাহনী-মোহামেডান সমর্থকদের মধ্যে৷
কিন্তু ফুটবল কর্তাদের সূদুর প্রসারী কোনো পরিকল্পনা না থাকায়, কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবলের সেই সোনালী অধ্যায়৷ স্তিমিত হয়ে গেছে ঘরোয়া ফুটবল নিয়ে সাধারন মানুষের উন্মাদনা৷ কিন্তু নিজেদের রক্তে ফুটবলের মোহনীয় জাদুর যে স্পর্শ সেসময় পেয়েছিল বাঙালি, তা কি কখনো ভোলা যায়? একদমই না৷
আমার ধারনা ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের এই উন্মাদনা তা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়ার মূল কারিগর আর্জেন্টিনার দিয়েগো ম্যারাডোনা৷ তবে তার সঙ্গে আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ তা টেলিভিশনে খেলা দেখানো৷ এ নিয়েই সেদিন কথা হচ্ছিলো ফুটবল কোচ সাইফুল বারী টিটুর সঙ্গে৷ তিনি তার স্মৃতি হাতরে মনে করছিলেন সেসব দিনের কথা৷ বলছিলেন, বিটিভির পর্দায় ১৯৮২ সালের সেই বিশ্বকাপ এখনো চোখের সামনে ভাসে৷ একদিকে আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা, অন্যদিকে ব্রাজিল দলে জিকো, সক্রেটিসের মতো ফুটবলারদের নৈপুণ্য৷ সঙ্গে ঐ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দল ইতালির পাওলো রসির খেলা এখনো নাকি স্পষ্ট দেখতে পান সাইফুল বারী টিটু৷
তবে তার মতে, এসব খেলোয়াড়দের বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে টেলিভিশন৷
টিটুর সঙ্গে আমিও পুরোপুরি একমত৷ আমার কাছে সবসময়ই মনে হয়, ম্যারাডোনার সেই চোখ ধাঁধানো নৈপুণ্যের সঙ্গে, ব্রাজিলের শৈল্পিক ফুটবল৷ সবমিলিয়ে লাতিন ফুটবলের প্রতি আরো বেশি বুদ হয়ে যায় বাংলাদেশিরা৷
পেলে-ম্যারাডোনার রেখে যাওয়া সেই ব্যাটন উঠেছে লিওলেন মেসি আর নেইমারদের হাতে৷ যাদের পায়ের যাদুতে তাবত পৃথিবীর ফুটবলপ্রেমীদের মতোই মুগ্ধ বাংলাদেশিরা৷
তারপরও মনে একটা প্রশ্ন চলেই আসে৷ তা হলো, মেসি অনেক বড় খেলোয়াড় তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই৷ কিন্তু ম্যারাডোনার যে জাদু সেটাকে কি ছাপিয়ে যেতে পেরেছেন মেসি? আবার সাফল্যের প্রয়োজনে মাঠের সেই শৈল্পিকতাকে বিদায় জানিয়েছে ব্রাজিল৷ তারপরও কেন, বাংলাদেশের মানুষ এতোটা আবেগী এই দুটো দলকে নিয়ে৷ এর কয়েকটি যুক্তিযুক্ত কারণও আছে৷
• প্রথমত, দেশের ফুটবলে বলার মতো সাফল্য নেই৷ আবার নিকট ভবিষ্যতে যে সাফল্য আসবে তার ছিটেফোঁটা কোন লক্ষণও নেই৷ আবার দেশের ক্লাব ফুটবলের অবস্থাও বিবর্ণ, আকর্ষণহীন৷ ফলে দৈনন্দিন জীবনে নানামুখী সমস্যার সঙ্গে লড়াই করতে থাকা আমার মতো অসংখ্য মানুষ বিনোদনের উপায় খুঁজতে গিয়ে সারাবছর রাত জেগে দেখি ইউরোপের ক্লাব ফুটবল৷ আর চার বছর পরপর আসা বিশ্বকাপ তো আমাদের কাছে রীতিমতো ঈদের আনন্দের চেয়ে বেশি মনে হয়৷
• দ্বিতীয়ত, কাগজে কলমে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও, বাস্তবতা পুরোপুরি উল্টো৷ মন খুলে রাজনীতি, ধর্ম কিংবা নিজের সমস্যা নিয়ে কথা বলতেও আমরা ভয় পাই৷ অথচ দলমতের ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করাতে পারে শুধুমাত্র ক্রিকেট আর ফুটবলই৷ শুধু তাই না, ঘোরতর শত্রুর সামনেও গলা উচিয়ে জানাতে পারি নিজের পছন্দ আর অপছন্দের কথা৷
• আবার জাতিগত ভাবে আমরা বাংলাদেশিরা এমনিতেই খানিকটা উৎসব প্রেমী৷ উপলক্ষ পেলে, হাজারো সমস্যার মধ্যেও, আনন্দ খুঁজি নানাভাবে৷ যা অবশ্যই ইতিবাচক৷ তাই চার বছর পরপর আসা এই বিশ্বকাপ যদি কিছুসময়ের জন্যে হলেও কমিয়ে আনে শত্রু আর মিত্রের দূরত্ব, তবে আনন্দেই কাটুক না আগামী একমাস৷ তাতে জয় হবে ফুটবলেরই৷