বাংলাদেশে বর্ণবাদের অনেক বর্ণ
৫ জুন ২০২০১. গত বছরের ৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সাথী আক্তার নামে এক গৃহবধূকে তার বাড়ির একটি কক্ষ ভেঙে উদ্ধার করে পুলিশ৷ তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করেছিল তার স্বামী ফাহিম৷ ছয় বছর আগে তাদের বিয়ে হয়৷ তাদের দুটি সন্তানও আছে৷ কিন্তু বিয়ের ছয় বছর পর তার স্বামী তাকে বাড়ির একটি কক্ষে এক মাস ধরে আটকে রাখে৷ তার ওপর চলে নির্যাতন৷ উদ্ধার করার পর তিনি পুলিশকে জানান, কালো ও খাটো হওয়ার কারণে গত ছয় মাস ধরে নির্যাতন করা হয়৷ একমাস ধরে একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়৷ জোর করে বিষপান করিয়ে হত্যার চেষ্টাও করা হয়৷
২. ছোট পর্দার অভিনেত্রী সুমাইয়া শিমু বিয়ে করেন ২০১৫ সালের আগস্টে৷ তার বিয়ে নিয়ে তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি মহল রীতিমতো সমলোচনার ঝড় বইয়ে দেয়৷ কারণ, বর নাসিরউদ্দীন নাসিমের গায়ের রঙ আর চেহারা৷ যারা সমালোচনা করেছেন, তাদের কথা হলো, শিমুর বর হিসেবে নাসিমকে মানায় না৷ কারণ, তার গায়ের রঙ কালো৷
এই দুটি ঘটনায় সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা বর্ণবাদই প্রকাশ পেয়েছে কিনা জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, ‘‘আমরা বর্ণবাদ নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করি না৷ কাজ করি নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে ৷ আর তাতে দেখা যায়, যে নারীর গায়ের রঙ কালো বা প্রচলিত দৃষ্টিতে সুন্দর না, তার পরিবারকে বেশি যৌতুক দিতে হয়৷ নির্যাতনও তাদের ওপরই বেশি হয়৷’’
‘‘বাংলাদেশে বিয়ের জন্য পাত্রী নির্বাচনে ‘ফর্সা ও সুন্দরী’ পাত্রীকে গুরুত্ব দেয়া হয়৷ এটা যে শুধু পাত্র পক্ষ থেকে তা নয়, পাত্রী পক্ষও এটা প্রচার করে পাত্র খোঁজার জন্য,’’ বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন৷ তিনি ১৯৯৯ সালে এ নিয়ে একটি গবেষণাও করেছেন৷ সেই গবেষণার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ফলোআপ গত ২০ বছরেও হয়নি৷ কাবেরী গায়েন বলেন, ‘‘পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি৷ বরং আমার বিবেচনায় আরো খারাপ হয়েছে৷’’ তিনি তখন চারটি পত্রিকায় প্রকাশিত ৪৪৬টি বিয়ের বিজ্ঞাপনের ওপর এ গবেষণা করেন৷ বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে ২২০টিতে, অর্থাৎ ৪৯.৩২ শতাংশে সরাসরি পাত্রীর গায়ের রঙ ফর্সা উল্লেখ করা হয়৷ মাত্র ১৩টি বিজ্ঞাপনে পাত্রীপক্ষ পাত্রীর শ্যামলা রঙের কথা উল্লেখ করেছে৷ সুন্দরী, প্রকৃত সুন্দরী, অসামান্য রূপসী, রূপসী, অপূর্ব সুন্দরী- এ ধরনের বিশেষণ ব্যবহার করে সৌন্দর্যকে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছে ২২২টি বিজ্ঞাপনে৷ অর্থাৎ, ফর্সার চেয়েও বেশি ৪৯.৭৬ শতাংশ বিজ্ঞাপনে৷
কাবেরী গায়েন বলেন, ‘‘এটাই আসলে বর্ণবাদ৷ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই বর্ণবাদ রয়েছে৷ এখন বর্ণবাদ এবং পুঁজিবাদ একসঙ্গে হাঁটছে৷ তাই যদি না হবে, রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন এবং বিক্রি বাড়বে কেন? কেন বাড়বে এত বিউটি পার্লার? মানুষ কেন রঙ ফর্সা করার দিকে ঝুঁকবে?''
সমাজ বিশ্লেষক এবং নৃ-বিজ্ঞানীদের সাথে কথা বলে বাংলাদেশে বর্ণবাদের বেশ কতগুলো বিষং চিহ্নিত করা গেছে৷ ওগুলোকে আশ্রয় করেই বর্ণবাদ টিকে আছে৷
১.সৌন্দর্যের ধারণা ও গায়ের রঙ
২. ভাষা ও ধর্ম
৩. জাতীয়তাবাদ
৪. আঞ্চলিকতা
৫. ক্ষমতা
৬. কর্পোরেট পুঁজি
৭. লিঙ্গ
করোনার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক পীরের জানাজায় ব্যাপক লোক সমাগম নিয়ে সমালোচনা হয়৷ এই পর্যন্ত ঠিক ছিল৷ কিন্তু এরপর ওই এলাকার মানুষকে নানাভাবে হেয় করা শুরু করে কিছু লোক৷ নানা ধরনের অপমানজনক ও আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করে পোস্ট দেয় সামাজিক যোগাাযোগ মাধ্যমে৷
কোনো কোনো এলাকার ভাষাকে হেয় করার প্রবণতাও আছে বছরের পর বছর ধরে৷ শুধু তাই নয়, কোনো এলাকার মানুষকে বিশেষ ধরণের অপরাধের জন্যও দায়ী করা হয়৷ এগুলোকেও বর্ণবাদ বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানী, অধ্যাপক ড. নেহাল করিম৷
তিনি মনে করেন ধর্ম পালনের কিছু দিক এবং ধর্ম নিয়ে, অর্থাৎ সখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর ভেদাভেদও প্রশ্ন জাগায়৷ ড. নেহাল করিম বলেন, ‘‘মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে সবাই কি সামনে দাঁড়াতে পারে? আবার ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে অন্য ধর্মালম্বীদের হেয় করাও তো চলছে অহরহ৷’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞানের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন কলি তুলে ধরলেন আরেকটি দিক, ‘‘যারা ময়লা পরিস্কার করেন, তাদের আমরা বলি ময়লাওয়ালা৷ কিন্তু যারা ময়লা করেন, তারা সমাজে সম্মানিত৷ যারা চুল কাটেন তাদের পেশাকে সম্মান দেয়া হয়মনা৷ এগুলো বর্ণবাদের নানা রূপ৷’’
বাংলাদেশে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে জোর করে বাঙালি বানানোর চেষ্টা ছিল৷ সংস্কৃতি বা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে অন্য জাতি বা ভাষাকে হেয় করা প্রবণতাও রয়েছে৷ নেহাল করিম বলেন, ‘‘এখানে ছোট কর্মচারী বড় কর্তার সামনে কথা বলতে পারে? বসের সামনে সত্য কথা বলাও অন্যায়৷ এটাও তো বর্ণবাদ৷’’
যে গণমাধ্যম বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কাজ করবে তারাও বর্ণবাদ বিস্তারে ভূমিকার রাখছে বলে কাবেরী গায়েন মনে করেন, ‘‘আমরা একটি স্টাডি করতে গিয়ে দেখেছি প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নারী সংবাদকর্মী বেশি৷ কিন্তু ব্যতিক্রম ছাড়া এর পিছনেও রয়েছে বর্ণবাদ৷ আর নারী উপস্থাপক বা নারী সংবাদকর্মীদের নেয়ার জন্য যেসব গুণের কথা বলা হয় সেগুলোও বর্ণবাদী মনের প্রকাশ৷’’
কর্পোরেট পুঁজি বর্ণবাদকে আশ্রয় করেই আবার ব্যবসা করে৷ সেটা বিউটি প্রোডাক্ট হোক বা বিউটি কন্টেস্ট৷ নারীর সাহস, যোগ্যতা আর সাফল্য খোঁজে তারা রঙ ফর্সা করার মধ্যে৷
বাংলাদেশে মাঝে মাঝে অবৈধ বিদেশিদের আটক বা গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হয়৷ সব সময়ই এই অভিযান চলে আফ্রিকার নাগরিকদের বিরুদ্ধে৷ এটাও বর্ণবাদের প্রকাশ৷ ‘‘এখানে সেই বর্ণবাদী মানসিকতা কাজ করে যে, কালো মানুষ অপরাধ করে, সাদা মানুষ করে না৷ কালো মানে খারাপ, সাদা মানে ভালো,’’ বলেন জোবাইদা নাসরীন কলি৷
তিনি আরো বলেন, ‘‘রেসিজমে শুধু গায়ের রঙ দিয়ে যে বৈষম্য করা হয় তা নয়৷ কোনো অজুহাত দেখিয়ে অসাম্য এবং বৈষম্য করাই বর্ণবাদ৷ তাই ধনী-গরিবের যে বৈষম্য এটা সবচেয়ে বড় বর্ণবাদ৷ বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় বৈষম্যৈর খাঁচাটা বড়, এখানে বর্ণবাদও বেশি৷’’
‘‘এখানে বর্ণবাদ এতই প্রবল যে, পরিবারের মধ্যেও তা আছে৷ দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই গরিব হলে তার সঙ্গে মিশতে চায় না বিত্তশালী ভাই৷ সমাজেও এটা প্রবল,’’ অভিমত নেহাল করিমের৷
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে বর্ণবাদ আছে বলেই স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পর ২০১৪ সালে হিজড়ারা আলাদা লিঙ্গ হিসেকে স্বীকৃতি পায় আর ভোটাধিকার পায় ২০১৯ সালে৷ এখনো তাদের হেয় করা হয় নানাভাবে৷