বাংলাদেশে নিউজ ওয়েবসাইট বন্ধ করছে কারা?
২৫ মে ২০১৯গত রবিবার সকাল ১১টার পর থেকে ৯ বছরের পুরনো নিউজ পোর্টাল পরিবর্তনডটকম-এ বাংলাদেশ থেকে অনেকেই ঢুকতে পারছেন না৷ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আবু সুফিয়ান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের ডোমেইন ব্লক করা হয়েছে৷ আমরা এরপর বিটিআরসিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বার বার যোগাযোগ করে যাচ্ছি, কিন্তু কেউ কোনো সদুত্তর দিচ্ছেন না৷''
সুফিয়ান বলেন, ‘‘তবে, আমরা আমাদের সূত্র থেকে জানতে পেরেছি ‘‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ'' নামের একটি সংগঠনের বিজ্ঞাপন নিয়ে আমরা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এই ঘটনাটি ঘটতে পারে৷ বিভিন্ন পত্রিকায় ওই সংগঠনের নামে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন তাদের নয় বলে এক সংবাদ সম্মেলনে তারা জানায়৷ আমরা এরপর একটি প্রতিবেদন করি ‘‘তাহলে বিজ্ঞাপনটি কারা দিয়েছে?'' শিরোনামে৷''
তিনি বলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যজনক হলো, কেন বন্ধ করা হলো, কারা বন্ধ করলেন তাও আমরা জানতে পারছিনা৷ আমাদের কোনো খবরের ব্যাপারে যে কারুর কোনো কথা থাকতে পারে৷ কোনো প্রতিবাদ বা ব্যাখ্যা থাকতে পারে৷ কিন্তু সেসব না জনিয়ে নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে দেয়া সরাসরি স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ৷ আর এই স্বাধীনতা আমাদের সংবিধান দিয়েছে৷''
সুফিয়ান বলেন, ‘‘ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে করে দেয়ার পর আমরা কর্মীরাও কোনো হয়রানির মুখে পড়ি কিনা সেই আতঙ্কের মধ্যে আছি৷ আর ঈদের আগে আমাদের দেড় শতাধিক কর্মীর বেতন ভাতা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে৷''
বাংলা রিপোর্টও কি নিষিদ্ধ?
এদিকে, গত ২৩ এপ্রিল থেকে আরেকটি নিউজ পোর্টাল বিএনডটবাংলাডটরিপোর্ট-এ বাংলাদেশে প্রবেশ করা যাচ্ছেনা বলে অভিযোগ উঠেছে৷ তবে, ডয়চে ভেলের কয়েকজন পাঠক ফেসবুকে জানিয়েছেন যে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাইটটিতে প্রবেশ করতে পারছেন৷
বাংলা রিপোর্ট সম্পাদক রফিকুল রঞ্জু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘২১ ও ২২ এপ্রিল সোনারগাঁও হোটেলে বিপিও সামিট হয়৷ টাঙ্গাইল থেকে একজন প্রতিবন্ধী হুইল চেয়ারে করে ওই সামিট-এ যোগ দিতে এসেছিলেন৷ তিনি আইটিনির্ভর কিছু করতে চান৷ সেজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সাথে দেখা করে কথা বলতে চেয়েছিলেন সহযোগিতার জন্য৷ কিন্তু সেটা তিনি পারেননি৷''
তিনি বলেন, ‘‘এই নিয়ে আমরা ২২ এপ্রিল রাত সোয়া ১১টার দিকে ভিডিওসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করি৷ যার শিরোনাম ছিল ‘‘হতাশা নিয়ে ফিরে গেলেন কামরুল''৷ এই সংবাদ প্রকাশের কয়েকঘণ্টা পরই আমাদের পোর্টালটি বন্ধ হয়ে যায়৷ আমরা মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি৷ বিটিআরসিসহ সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি৷ কিন্তু কেউই বলতে পারছেন না কারা বন্ধ করেছেন৷''
রঞ্জু বলেন, ‘‘আমরা সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেছি৷ তারাও চেষ্টা করেছেন নানা দিক দিয়ে যাতে সাইটটি চালু হয়৷ কিন্তু হয়নি৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমরা কোনো আইন লঙ্ঘন করিনি৷ আমরা সংবিধান ও আইন মেনেই কাজ করছি৷ তারপরেও আমাদের পোর্টাল বন্ধ করে দেয়া হলো৷ আর কিভাবে কারা দিলো, কেন দিলো তাও বলা হচ্ছেনা৷ আমার দাবি হচ্ছে সরকার ও তথ্যমন্ত্রণালয়ের এই বিষয়গুলো পরিস্কার করা উচিত৷ আমরা অন্ধকারে আছি৷''
তাঁর মতে, বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম, বিশেষ করে অনলাইন চাপের মুখে আছে৷ আর আবু সুফিয়ান বলেন, ‘‘পোর্টালগুলো বন্ধ হওয়ার পর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম গুরুত্ব দিয়ে খবর প্রকাশ করলেও বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে তেমন গুরুত্ব দিয়ে খবর প্রকাশ হয়না৷ এথেকে সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপের বিষয়টি বোঝা যায়৷''
এদিকে, শনিবার বিটিআরসিতে যোগাযোগ করে সংশ্লিষ্ট কারো বক্তব্য জানা যায়নি৷ তবে ইন্টারন্টে সার্ভিস প্রোভাইডার এসাসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সাধারণ সম্পাদক ইমদাদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ওই দু'টি নিউজ পোর্টাল বন্ধে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা ছিলনা৷ আমরা বন্ধও করিনি৷ তবে এখন নানাভাবে আমাদের ছাড়াও ওয়েবসাইট বন্ধ করা যায়৷ এনটিএমসি (ন্যাশনাল টেলিকম্যুনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) সবগুলো আইআইজিতে (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) তাদের নিজস্ব মনিটরিং ডিভাইস বসিয়েছে৷ তবে তারা বন্ধ করেছে কিনা তা আমরা বলতে পারবনা৷''
তিনি বলেন, ‘‘আরো কয়েকজন সাংবাদিক এর আগে জানতে চাওয়ায় আমি নিজেও বিটিআরসিতে ফোন করেছিলাম বিষয়টি জানতে৷ আসলে তারাও কিছু জানেনা৷''
‘স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ'
এদিকে, এই পরিস্থিতিকে সাংবাদিক নেতারাও স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ বা চাপ হিসেবে দেখছেন৷ বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব শাবান মাহমুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কোনো স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিউজ পোর্টালগুলো বন্ধ করা হয়নি৷ পুরো বিষয়টিই অস্বচ্ছ এবং রহস্যাবৃত৷ এই আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি করছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘সরকার এটার জন্য কতটা দায়ী সেটা বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে আমি বলবো বিষয়গুলো জানার পরে সরকারের ব্যবস্থা নেয়া উচিত৷ কারণ গণতন্ত্রিক সরকারের জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি বিষয়৷ যদি কোনো অদৃশ্য কারণে গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে যায় আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি সেটা গণতন্ত্রের জন্য, সরকারের জন্য বা গণমাধ্যমের জন্য কোনো শুভ খবর নয়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ঈদের আগে এভাবে গণমাধ্যম বন্ধ হওয়া অমানবিক৷ কোনো অদৃশ্য হাতের ইশারায় যদি গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত হয়, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়৷ তবে সংবাদ মাধ্যমকেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে৷''