বাংলাদেশে জঙ্গি তত্পরতা
৭ অক্টোবর ২০১৪এর সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে নতুন নেতৃত্ব৷ আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের উত্থান-পতনের সঙ্গেও বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর যোগাযোগের পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তন হয়েছে কৌশলের৷
পশ্চিমবঙ্গে তৎপর জেএমবি?
সর্বশেষ খবর হলো, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় বোমা বানাতে গিয়ে নিহত শাকিল আহমেদ ও সুবহান বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি-র সদস্য বলে সেখানকার পুলিশ দাবি করেছে৷ প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার তারা নিহত হয়৷
এ কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে সতর্কতা জারি করা হয়েছে৷ এই সীমান্ত বন্ধেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে মঙ্গলবার৷ তবে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গে নিহত ঐ দুই জঙ্গির ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি৷ গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘বাংলাদেশের জঙ্গিদের ব্যাপারে আমাদের কাছে যেসব তথ্য এবং তালিকা আছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের দাবি সঠিক বলে প্রতীয়মান হয় না৷''
বাংলাদেশে জেএমবি-র কার্যকলাপ
২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট বাংলাদেশের মোট ৬৪ জেলার ৬৩টিতেই একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে জঙ্গিদের শক্তির জানান দিয়েছিল জেএমবি৷ তাছাড়া ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সেই সময়ের বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল৷ হামলায় শেখ হাসিনা আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান৷ তবে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন৷ জানা যায়, এই হামলা চালায় মুফতি হান্নানের হরকাতুল জিহাদ৷ এর আগেও ঢাকার রমনা বটমুল এবং যশোরে উদীচী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে জঙ্গি হামলা চালিয়েছিল হরকাতুল জিহাদ৷
জেএমবি ১৭ই আগস্টের পর সারাদেশে একের পর এক আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাসহ ৩৩ জন জনকে হত্যা করে৷ ২০০৫ সালের ১৪ই নভেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় তখনকার জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইসহ শীর্ষ ছয়জন জঙ্গির ফাঁসি হয়৷ ১৭ই আগস্টের বোমা হামলার ঘটনায় বাংলাদেশে মোট ১৫৯টি মামলা হয়৷ এর মধ্যে ৯১টি মামলার বিচার শেষে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড, ১১২ জনের যাবজ্জীবন এবং ১০১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ পলাতক আছে ফাঁসির তিন আসামিসহ ৭৪ জন সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি৷
অন্যদিকে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা এবং ২৪ জনকে হত্যার মামলা এখনো বিচারাধীন৷ তবে প্রধান আসামি হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ অধিকাংশ আসামি এখন কারাগারে৷ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরও এই মামলার আসামি৷
প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা চেষ্টা
শেখ হাসিনাকে জঙ্গিরা একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করেছে৷ কোটালিপাড়ায় তাঁর জনসমাবেশ স্থলেও বোমা পেতে তাঁকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়৷ গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত জঙ্গিরা তাঁকে অন্তত ১৪ বার হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে৷ এ ব্যাপারে তাঁকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং এবং আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও সতর্ক করা হয়েছে৷ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনা সব সময়েই জঙ্গিদের ‘টার্গেট'-এ রয়েছেন৷
গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান হয়েছে৷ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কমপক্ষে দেড় হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ অবশ্য এ সবে তারা দুর্বল হলেও শেষ হয়ে যায়নি৷ বরং তারা নতুন নামে সংগঠিত হয়েছে৷ নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করেছে৷ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট অুনযায়ী নিজেদের অবস্থান ও কৌশল পরিবর্তন করেছে তারা৷''
তিনি বলেন, ‘‘জঙ্গিদের গ্রেপ্তারের পর তারা তদন্ত ও অনুসন্ধানে অধিকাংশ জঙ্গি সংগঠনের পেছনে কিছু প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছেন৷ এ কারণেই জঙ্গিদেও নির্মূল করা কঠিন হয়ে পড়ে৷ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোশকতাতেই নতুন জঙ্গি দল গড়ে ওঠে৷''
বাংলাদেশে নতুন জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে এখন উল্লেখযোগ্য হলো, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জাদিদ আল-কায়েদা৷ এর মধ্যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ব্লগারদের ওপর হামলায় জড়িত৷ এছাড়া নিষিদ্ধ হলেও হিযবুত তাহরির সবচেয়ে বেশি সক্রিয়৷ তারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেধাবী শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে কাজ করছে৷ তাদের তত্পরতা প্রায়ই চোখে পড়ে৷
বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলি
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত পাঁচটি জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধ হয়েছে৷ এগুলো হলো: জেএমবি, জেএমজেবি, হরকাতুল জিহাদ, হিযবুত তাহরির এবং শাহাদত্ ই আল-হিকমা৷ এরমধ্যে সবগুলোই নিষিদ্ধ অবস্থায় তত্পর রয়েছে৷ গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম জানান, ‘‘সর্বশেষ ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন ওরফে ইবনে হামদান ইরাক ও সিরিয়া ভিত্তিক আইএস-এর সঙ্গে জড়িত ৷ সে বাংলাদেশে আইএস-এর সদস্য এবং নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার কাজে নিয়োজিত ছিল৷ সে সিরিয়ায় আইএস-এর সদস্য হিসেবে যুদ্ধ করেছে৷ আর বাংলাদেশে সে দুই জেএমবি সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেই এসেছিল৷'
এর আগে মো. আসিফ আদনান ও মো. ফজলে এলাহী তানজিল নামে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়, যারা ‘জিহাদে' অংশ নিতে তুরস্ক ও সিরিয়া যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল৷ তারাও জেএমবি-র সদস্য৷
গত ১৯শে সেপ্টেম্বর জেএমবির ভারপ্রাপ্ত আমির আব্দুল্লাহ আল-তাসনিম ওরফে নাহিদসহ সাতজনকে আটক করেন৷ তারাও আইএস-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল বলে গ্রেপ্তারের পর সংবাদমাধ্যমকে জানান গোয়েন্দারা৷
গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘বাংলাদেশে আইসিসি অথবা আইএস-এর অনুসারীদের তত্পরতা আমাদের নজরে আসছে৷ কোণঠাসা হয়ে যাওয়া জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যরা ইরাক এবং সিরিয়ার ঘটনায় নতুন করে আইএস-এর দিকে ঝুকছে, উদ্বুদ্ধ হচ্ছে৷ একই সঙ্গে তারা তাদের সদস্যদেরও চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে৷''