বাংলাদেশে ঈদ: এখন এবং তখন
২১ এপ্রিল ২০২৩রাজধানী ঢাকার হাইকোর্টে জাতীয় ঈদগাহ। ঈদের দিন সকাল সাড়ে আটটায় সেখানে ঈদুল ফিতরের নামাজের প্রধান জামাত হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)-র ব্যবস্থাপনায় এই ঈদগাহে একই সাথে ৩৫ হাজার মানুষ নামাজে অংশ নিতে পারবে। তবে রাষ্ট্রপতি এই জামাতে অংশ নেবেন- এমন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তিত্ব ছাড়াও অনেক মন্ত্রী আসেন জাতীয় ঈদগাহে। ঢাকা শহরের ৪০০ বছরের ইতিহাস ফিরে দেখা যায়, এই ধারার সূচনা মোঘল আমলে। সুবা বাংলার রাজধানী শহরে তখন প্রধান জামাতে হাজির হতেন সুবাদার, নায়েবে নাজিম ও তাদের পারিষদ। ১৬৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত সেই শাহী ঈদগাহ ধানমন্ডিতে টিকে আছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভূক্ত পুরাকীর্তি হিসেবে। প্রতিষ্ঠাকাল হিসেবে এবার সেখানে হবে ৩৮৩তম ঈদের জামাত। তবে দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত ঢাকায় নয়, প্রায় ২০০ বছর ধরে সেটা হয়ে আসছিল কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায়। হালে তাকে আবার টেক্কা দিয়েছে দিনাজপুরের গোর-এ শহীদ ময়দান। এবার সেখানে ছয় লাখের বেশি মুসল্লি আসবেন- এই আশা করছেন আয়োজকরা।
বর্তমান জাতীয় ঈদগাহের আগে ঢাকা শহরে ঈদ জামাতের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম (তখনকার ঢাকা স্টেডিয়াম) এলাকার খোলা মাঠ। এ বিষয়ে বিবরণ পাওয়া যায় সৈয়দ আলী আহসানের ‘ষাট বছর আগের ঢাকা' বইয়ে। তিনি সেই ঈদগাহে আসার স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে- ‘‘সকাল বেলা থেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে এলাকাবাসী পুরুষরা নতুন নতুন পোশাক পরে বিরাট নিশান বহন করে ঢোল বাজাতে বাজাতে মিছিল করে ঈদের ময়দানে উপস্থিত হতো।’’
ঈদের জামাতে সাধারণত পুরুষরাই যান। তবে কোনো কোনো ঈদগাহে নারীদের জন্যও আলাদা ব্যবস্থা থাকে। যতটা জানা যায়, ঢাকায় প্রথম নারীদের ঈদের জামাত হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। এ প্রসঙ্গে ‘ঢাকার ইতিবৃত্ত: ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি' বইয়ে মোহাম্মদ আবদুল কাইউম লিখেছেন- ‘‘১৯৩৭ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ইমামতিতে কার্জন হলে মহিলাদের প্রথম ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। শোনা যায়, মহিলাদের জামাতে ইমামতি করতে তখন কেউ রাজি হননি।’’
ঈদ জামাত ঘিরে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে যে আনুষ্ঠানিকতা তামোঘল ঐতিহ্য বহন করছে বলে মনে করেন বাংলাদেশের উৎসব-পার্বণ গবেষক ইমরান উজ-জামান। ডয়চে ভেলে বাংলাকে তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ঈদ উৎসবের যে প্রচলন, তা মূলত মোঘল আমল থেকে শুরু। সাম্রাজ্য বিস্তারে মোঘলরা যেদিকে যেতেন, সেখানে যদি ঈদের সময় ঘনিয়ে আসতো, তখন তারা ঢাক পিটিয়ে এলাকাবাসীকে জানিয়ে দিতো কোথায় ঈদের জামাত হবে। মোঘলদের বড় কোনো কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত থাকবেন, তা-ও ফলাও করে প্রচার করা হতো। এটাও ছিল একটা আকর্ষণীয় বিষয়।’’
ঈদ উৎসবের সাথে লোকজ সংস্কৃতি কতটা সম্পৃক্ত- এমন প্রশ্নে ‘রঙ্গে ভরা বঙ্গ'র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ইমরান উজ-জামান বলেন, ‘‘বাংলাদেশে যেসব লোকমেলা রয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে মন্দির ও হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সম্পর্ক বেশি। মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবে একমাত্র মেলা বসতো চকবাজারে, যেটা তখন ঈদ মেলা নামে পরিচিত ছিল। ঢাকা ও আশপাশের লোকশিল্পীরা সারাবছর এই মেলার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন। তাদের পণ্য এখানে এনে বিক্রি করতেন।
কমিটির হাতে চাঁদ!
ঈদুল ফিতরের আগে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুটি কমিটির ব্যস্ততা থাকে। এর একটি জাতীয় সাদাকাতুল ফিতর নির্ধারণ কমিটি। অন্যটি জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি। ফিতরা নির্ধারণ কমিটি এরই মধ্যে তার কাজ শেষ করেছে। তাদের ঘোষণামতে, এবার ফিতরা জনপ্রতি সর্বোচ্চ দুই হাজার ৬৪০ টাকা ও সর্বনিম্ন ১১৫ টাকা। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রথমবারের মতো ঘোষিত ফিতরা ছিল দুই টাকা। দুই টাকা থেকে ১১৫ টাকায় যে উল্লম্ফন তা থেকে মূল্যস্ফীতির একটি পরিসংখ্যান সহজেই বের করা যায়। কারণ, ভোগ্যপণ্যের দাম তুলনা করেই ফিতরা নির্ধারিত হয়।
এদিকে চাঁদ দেখা কমিটির দিকে দুটি বিষয়ে তাকিয়ে থাকে বাংলাদেশের মানুষ। রমজানের চাঁদ দেখা গেছে কিনা- তাদের সেই ঘোষণা জেনে রোজা পালন শুরু করতে হয়। ঈদের চাঁদ নিয়েও এ কমিটির ঘোষণাই শেষ কথা। তবে চাঁদপুরসহ দেশের কিছু এলাকার মানুষ আবার বাংলাদেশ নয়, সৌদি আরবের সরকার ঘোষিত চাঁদ দেখার সঙ্গে মিল রেখে উদযাপন করে থাকেন।
চাঁদ দেখতে কমিটি বসলেও জনসাধারণ ২৯ রোজার ইফতার সেরে আকাশে চাঁদ দেখার চেষ্টা করে। মসজিদগুলোর মিনারে উঠে আকাশে চাঁদের খোঁজ করে শিশু-কিশোররা। বিশ শতকের আশি-নব্বই দশকে ঢাকা শহরে ছাদে ছাদে চাঁদ দেখতে ভিড় লেগে যেতো। এখন আকাশের চেয়ে সবাই বেশি নজর রাখে টিভিতে কিংবা অনলাইন সংবাদমাধ্যমে। সেই সুবাদারি আমলে, নবাবি আমলে এমন ব্যবস্থা ছিল না। তখন চাঁদ দেখা গেলে ঢাকায় তোপধ্বনি করা হতো। সেই শব্দে অনেকেই ঈদের দিন সম্পর্কে ধারণা পেতেন।
নবাবদের ঢাকায় চাঁদ দেখার চেষ্টা হতো আহসান মঞ্জিল থেকে। কেউ কেউ বুড়িগঙ্গার বুকে নৌযানে চেপে যেতেন আকাশটা ঠিকঠাক চোখের নাগালে আনতে। তবে সেকালে ঈদের চাঁদের চেয়েও রমজান মাসের চাঁদ নিয়ে বেশি উচ্ছ্বাস দেখা যেতো। সেই সময়ের সমাজ-সংস্কৃতি বিষয়ক বইয়ে তার প্রমাণ মেলে। ‘উনিশ শতকের ঢাকার সমাজ-জীবন' গ্রন্থে আবু যোহা নুর আহমদ লিখেছেন- ‘‘সেকালে রমজানের চাঁদ দেখার জন্য আহসান মনজিল, বড় কাটারা এবং হুসনি দালানের ছাদে ছেলে, যুবক, বৃদ্ধ দলে দলে যাইয়া দাঁড়াইত।’’
পোশাকে ঈদ, ভোজনে ঈদ
ঈদ এলে ঘরে ঘরে যে আনন্দ, তার প্রকাশ থাকে পোশাকে-আশাকে, খাবার-দাবারে। দোকানমালিক সমিতির তথ্য তথ্যানুসারে, এই কারণে ঈদকে কেন্দ্র করে লেনদেন হতে পারে এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার। তবে ঈদকে সামনে রেখে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি জমজমাট থাকে পোশাকের বাজার। তৈরি পোশাক ও থান কাপড়ের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি মার্কেট রাজধানী ঢাকার ইসলামপুরে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেচাবিক্রি হয়ে থাকে এই মার্কেটে।
আর্থিক টানাপড়েন পেরিয়ে ঈদের দিন সবাই নতুন পোশাক পরার চেষ্টা করেন। এটা ঈদ উৎসবের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। হালে তাই তৈরিপোশাকের বাজারে যে ভিড় জমে থাকে, এটা আগে ছিল থান কাপড়ের দোকানে এবং দর্জিপাড়ায়। এই পরিবর্তন নিবিড়ভাবে দেখেছেন ঢাকার সমাজ ও লোকসংস্কৃতি গবেষক শায়লা পারভীন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলছেন, এখন তৈরি পোশাক কেনা হলেও আগে প্রচলন ছিল ঈদের পোশাক দর্জি দিয়ে বানানো। থান কাপড় কিনে আনা হতো। আবার বোন বা বান্ধবীরা মিলে একই নকশা, একই রংয়ের পোশাক তৈরি করার প্রচলন ছিল। এখনকার প্রজন্ম এসব চর্চা জীবনেও করবে না।
কাপড় কিনে পোশাক দর্জি দিয়ে বানানোর বদলে তৈরি পোশাক কেনার প্রবণতা কবে থেকে শুরু হলো তা জানতে চাইলে ঢাকার আদি বাসিন্দা শায়লা পারভীন বলেন, ‘‘রেডিমেড জামাকাপড় এলো যখন গার্মেন্টস শুরু হলো তখন থেকে। সেটা আশির দশকের শেষদিক থেকে। শুরুতে মেয়েদের চেয়ে ছেলেরাই বেশি তৈরি পোশাক কিনতো। তখনো সেভাবে ব্র্যান্ড আসেনি। আড়ংয়ের মতো ব্র্যান্ড আসার পর মেয়েরাও রেডিমেড পোশাকে ঝুঁকে পড়ে।’’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঈদের খাবার-দাবারেও পরিবর্তন এসেছে। দোকান থেকে প্যাকেটজাত সেমাই কেনার বিষয়টি এখন জনপ্রিয়। কিন্তু একটা সময় রমজান মাসের মাঝামাঝি থেকে পেতলের মেশিনে ঘরে সেমাই তৈরি করা হতো। বিগত ১০০ বছরের এই অঞ্চলের ঈদ উদযাপনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বাংলাপিডিয়ায়। সেখানে উল্লেখ আছে- ‘‘ঈদ উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ ছিল বিশেষ ধরনের খাওয়া-দাওয়া। মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলের খাবারের মধ্যে থাকতো কোর্মা-পোলাও, ঘরে প্রস্তুত নানা রকমের পিঠা, সেমাই ও শিউলি বোটার রঙে মাখানো জর্দা।.. তবে শহরে এ দেশীয় উপাদানের অভাব ছিল। ঈদের খাওয়ার তালিকায় প্রধান হয়ে উঠতো ঘরে তৈরি মিষ্টান্ন।’’
ঈদ ঘিরে নতুন পোশাক পরে বেড়ানোর বিষয়টি এখনো দারুণভাবেই আাছে। আবার প্রতিবেশী, স্বজনদের বাড়িতে গিয়ে ভালো-মন্দ খাওয়া- ঈদের এই সম্প্রীতি আজো অমলিন। তবে এখন ঘরের পাশাপাশি রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়ার প্রচলন বেড়েছে। বাঙালি জীবনে ঈদেও এই পরিবর্তন দেখা যায়।