ঈদ কেবল উৎসব নয়, ভারতের ইতিহাস
২১ এপ্রিল ২০২৩চীনা কাগজের চেন আর থোকা থোকা ঝুলন্ত লম্ফ আকাশ ঢেকে দিয়েছে। আলোর মায়ায় চাঁদ আর তারা। জামা মসজিদের প্রতিটি থাম সোনালি আলোয় আগুনের মতো জ্বলছে। আর মসজিদের গম্বুজের ঠিক উপরে ফালি চাঁদে কাস্তের ধার।
শাহী ইমাম মিনিটখানেক হলো আকাশ দেখে ইদের ঘোষণা দিয়েছেন, আর তাতেই উল্লাসের জোয়ার জামা মসজিদের সিঁড়ি বেয়ে মিনা বাজারের কাবাব, শরবতি পেরিয়ে, রাজপথ পার করে লালকেল্লার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে চাঁদনি চকের গলিতে। সেখানে জমকালো শেরওয়ানি আর লহেঙ্গার দোকানে তিল ধারণের জায়গা নেই। শেষ মুহূর্তের ইদের বিকিকিনি চলছে জোর কদমে।
এ দৃশ্য দেখতে দেখতে কল্পনার স্রোত পৌঁছে যায় কয়েকশ বছর পিছনে। মুঘল বাদশা নিশ্চয় ওই লালকেল্লার পাঁচিলের ধারে অপেক্ষা করতেন শাহী ইমামের ঘোষণার জন্য। তারপর ঠিক এই পথ বেয়েই তো সম্রাট আর তার রানিদের কনভয় পৌঁছাতো মিনা বাজারে। ঘণ্টাঘরের পাশে সম্রাটের হাতি পেতো জিলিপি। আর রানিরা একে একে দেখে নিতেন গয়না, কাপড়, খাবার.... মশালের আলোয় ইদের দিন তখনো ঠিক এভাবেই নিশ্চয় জ্বলে থাকতো শাহী জামা মসজিদ, একফালি চাঁদ মাথায় নিয়ে।
ইদের এই অভূতপূর্ব উৎসবের নাম ভারতবর্ষ। জামা মসজিদের ওই প্রতিটা গম্বুজ আসলে ভারতবর্ষ। মতি মহলের রাস্তায় পুরনো দিল্লির কাবাব আসলে ভারতবর্ষ। মিনা বাজারের শরবত-ই-মোহাব্বত আসলে ভারতবর্ষ। লালকেল্লার গ্রানাইটের প্রতিটি পাথর আসলে দীর্ঘ ভারতীয় সভ্যতার এক জীবন্ত ইতিহাস।
রাজা বদলায়, বদলায় শাসকের চরিত্র। কিন্তু এই ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুঘল ইতিহাস সরিয়ে দিয়ে একটি প্রজন্মকে কেবল অর্ধশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলা যায়। কিন্তু তাতে ইতিহাসের রোশনাই স্তব্ধ হয় না। আর হয় না বলেই, আজও জামা মসজিদের সিঁড়িতে বসে এক আশ্চর্য, অভূতপূর্ব ইতিহাস চাক্ষুস করা যায়, অনুভব করা যায়। বোঝা যায়, শাসক যা-ই বলুক, ইতিহাসের ঐতিহ্য খতম করে দেওয়া যায় না। সেই সাবেক কাল থেকে যে প্রথায়, যে আচারে ইদ পালন হয়েছে মুঘল শাহজাহানাবাদে, এখনো সেই ঐতিহ্য অব্যাহত।
মুঘলের দিল্লি থেকে এবার পা বাড়ানো যাক নবাবি কলকাতায়। বন্দরের ধারে নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলি। আর অন্যদিকে নাখোদা মসজিদের রোশনাই। এদিকে জোড়াসাঁকো, মার্বেল প্যালেসের সাবেকিয়ানা, ওদিকে চিৎপুর রোডের খাবারের পসরা। রমজান শুরু মানেই নাখোদা পার্শ্ববর্তী জাকারিয়া স্ট্রিটে গাড়ি চলাচল বন্ধ। রাস্তার উপর উনুন বানিয়ে হালিম। কাঠ-কয়লার আগুনে সুতোকাবাব, সুদূর আগ্রা থেকে এসেছেন মিষ্টির বিক্রেতা। শরিমলে শুকনো ফল লাগাচ্ছেন দিল্লির রাঁধুনি।
দিল্লির জামা মসজিদ ছেড়ে কলকাতায় কেন? সাংবাদিকের প্রশ্নে বিরক্ত রাঁধুনির জবাব, এসব উত্তর পেতে হলে চার পুরুষ আগে যেতে হবে। সেই তখন থেকে পবিত্র রমজানে আমাদের গোটা পরিবার জামা থেকে নাখোদায় এসে পসার সাজায়।
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। সেই ট্র্যাডিশন মেনেই আজও মশলার গোপন তালিকা ঘেঁটে ওয়াজেদ আলি শাহের পরিবার হালিম বানায়। মনজিলাত ফতেমার সেই হালিম খাওয়ার জন্য আগে থেকে ব্যবস্থা করে রাখতে হয়। আজও ইদের দিনে ওয়াজেদ আলির সঙ্গে আসা পানওয়ালার উত্তরসূরি স্পেশাল নবাবি পান বানান। আজও টিপু সুলতান মসজিদের পাশে বৃদ্ধ কাবাবওয়ালা রুটিতে জড়িয়ে দেন স্নেহের ছোঁয়া।
আজও ইদের দিনে বাল্যবন্ধু আতহারের মা ফোন করে জানিয়ে দেন, সারাদিনের খাওয়াদাওয়া কাকিমার হেফাজতে। গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে এই নিয়ম চলে আসছে, কলকাতার ইতিহাসের ট্র্যাডিশন মেনে।