আরো এক ব্লগারকে হত্যা
১২ মে ২০১৫মঙ্গলবার সকাল ন'টার দিকে বাংলাদেশের উত্তর বিভাগীয় শহর সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ অনন্ত তখন অফিসে যাচ্ছিলেন৷ ঘটনাস্থল সিলেট বিমানবন্দর থানার ওসি গৌসুল হোসেন সংবাদমাধ্যমকে জানান, ‘‘মুখোশ পরা চারজন সন্ত্রাসী হেঁটে এসে অনন্তকে কুপিয়ে হেঁটেই চলে যায়৷ প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, হত্যাকারীরা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে চায়নি৷ অথবা অনন্ত তাদের চেনেন৷ সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে শরীরের অন্য কোথাও নয়, শুধু তাঁর মাথায় আঘাত করেছে৷ এতে ঘটনাস্থলেই আক্রান্ত ব্লগার নিহত হন৷ হাসপাতালে নেয়া হলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা৷''
হত্যার কারণ উদ্ঘাটন ও হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে এরই মধ্যে পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়েছে বলেও দাবি করেছেন ওসি গৌসুল হোসেন৷
সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘অনন্ত সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ছিলেন৷ তিনি মুক্তমনা ব্লগে লেখালেখি করতেন আর চাকরি করতেন পূবালী ব্যাংকে৷ এর আগেও উগ্রবাদীদের কাছ থেকে হত্যার হুমকি পেয়েছেন তিনি৷ সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হলে সন্ত্রাসীরা বাসার সামনেই তাঁকে কুপিয়ে জখম করে৷''
অনন্ত বিজয় দাসের ভগ্নিপতি সমর বিজয় শেখর জানান, ‘‘এর আগে ব্র্যাক এনজিওতে কাজ করতেন অনন্ত৷ সিলেট সুবিদ বাজারের নূরানী বাগ এলাকার ১৩/১২ নম্বর বাড়িতে থাকতেন তিনি৷ তাঁর বাবার নাম রবীন্দ্র কুমার দাস৷''
অনন্ত বিজয় সিলেট থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক ছোটকাগজ ‘যুক্তি' সম্পাদনা করতেন৷ ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব: লিসেঙ্কো অধ্যায়', ‘জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ', ‘ডারউইন: একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা' শিরোনামে তিনটি বইও রয়েছে তাঁর৷ পরিবারের সদস্যরা জানান, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ কর্ম বিষয়ে মাস্টার্স করার পর সুনামগঞ্জের জাউয়াবাজারে পূবালী ব্যাংকের ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসাবে যোগ দেন তিনি৷ এরপর ২০০৬ সালে তিনি মুক্তমনা র্যাশনালিস্ট অ্যাওয়ার্ড পান৷এদিকে সিলেট র্যাব ৯-এর এএসপি পঙ্কজ দেবনাথ জানিয়েছেন, ‘‘অন্য ব্লগারদের ওপর যেভাবে হামলা হয়েছে, অনন্ত দাসের ওপরও একইভাবে হামলার ঘটনা ঘটেছে৷'' সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার কামরুল আহসানও সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘অনন্ত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ এর আগে সংঘটিত ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এ ঘটনার মিল রয়েছে৷''
অনন্ত বিজয় দাসের ফেসবুক পোস্ট
অনন্ত তারঁ সর্বশেষ ফেসবুক পোস্টে সিলেটের সরকার দলীয় এক সংসদ সদস্যের কথার তীব্র সমালোচনা করেন৷ ঐ সংসদ সদস্য এক অনুষ্ঠানে অধ্যাপ ড. জাফর ইকবালকে চাবুক মারার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন৷ এছাড়া মৃত্যুর একদিন আগে নিজের ফেসবুক পোস্টে ব্লগার অভিজিৎ রায় এবং ওয়াশিকুরের হত্যাকারীদের এখনো ধরতে না পারায় পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করেন অনন্ত৷ হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর ফেসবুকের দেওয়ালে শত শত শোকার্ত এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও বিচার দাবি করে পোস্ট দিয়েছেন, দিচ্ছেন৷
বিক্ষোভ মিছিল
ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক অন্তত বিজয় দাসকে হত্যার প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই বিক্ষোভ মিছিল করেছেন সিলেটের ব্লগার ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা৷ বেলা সাড়ে ১২টার ওমসানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ মিছিলটি নগরীর মধুশহীদ এলাকা ঘুরে আবারো হাসপাতালে এসে শেষ হয়৷ মিছিলকারীরা অনন্ত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও হত্যাকারীদের শাস্তির দাবি জানান৷
সিলেটে বুধবার আধাবেলা হরতাল
ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বুধবার সিলেটে আধাবেলা হরতাল ডেকেছে গণজাগরণ মঞ্চ। এক সংবাদ সম্মেলনে এই হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেন সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু। তিনি জানান, ‘‘অনন্ত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সিলেটে কাল (বুধবার) সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হবে।’’
বাংলাদেশে ব্লগার হত্যা
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে এ নিয়ে মোট চারজন ব্লগারকে হত্যা করা হলো৷ এছাড়াও হামলার শিকার হয়েছেন আরো অর্ধশত ব্লগার৷
ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয় চলতি বছরের ২৭শে ফেব্রুয়ারি, বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির উল্টো দিকে৷ এই হত্যাকাণ্ডে ফারাবি নামে একজনকে আটক করেছে পুলিশ৷ ফারাবি ফেসবুকে অভিজিৎকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল৷ তবে সে হত্যাকণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি৷ এরপর পুলিশ অবশ্য এখনও পর্যন্ত নতুন কাউকে গ্রেপ্তার বা চিহ্নিত করতে পারেনি৷
এ বছরেরই ৩০শে মার্চ ঢাকার তেজগাঁ এলাকায় হত্যা করাহয় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে৷ সেই হত্যাকাণ্ডের সময় হিজড়ারা দু'জন মাদ্রাসা ছাত্রকে হাতে নাতে ধরে ফেলে৷ সেই পর্যন্তই৷ পুলিশ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্য কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেনি৷
২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন শুরুর দশম দিনে, ১৫ই ফেব্রুয়ারি রাতে, রাজধানীর পল্লবীতে নিজের বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার রাজীব হায়দারকে৷ ঐ মামলায় পুলিশ আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে৷ মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে দু'দিন আগে৷ তবে এখনও বিচার শুরু হয়নি৷
এর আগে ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনতে হত্যার জন্য তাঁর ওপর হামলা চালানো হয়৷ আসিফ প্রাণে বেঁচে যান৷ হামলাকারীদের আটক বা গ্রেপ্তার না করা হলেও আসিফকে জেলে যেতে হয়েছিল৷ পরে তিনি জেল ছেকে ছাড়া পেয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন৷