তিন ব্লগারের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে পুলিশ
৩১ মার্চ ২০১৫এদিকে, বিশ্লেষক ও ব্লগাররা মনে করেন, অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা না গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে৷
সোমবার ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে হত্যার পর এটা এখন নিশ্চিত যে তাঁকেও ধর্মীয় উগ্রবাদীরা হত্যা করেছে৷ আর ব্লগে ইসলাম ধর্ম নিয়ে ‘আপত্তিকর' লেখালেখির অভিযোগেই তাঁকে হত্যা করা হয় বলে আটক মাদ্রাসার দুজন ছাত্র স্বীকার করেছে৷ এই ঘটনায় তারা মোট চারজন জড়িত বলে জানিয়েছে৷ তাদের মধ্যে দুজন আবু তাহের এবং মাসুম পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়৷ তারা পালিয়ে গেলেও সোমবার ঘটনাস্থল থেকে মাদ্রাসা ছাত্র জিকরুল্লাহ এবং আরিফুল ইসলামকে আটক করা হয়৷
তাদের আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে৷ নিহত ওয়াশিকুরের ভগ্নিপতি মনির হোসেন বাদি হয়ে ওই চারজনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেছেন৷
পরবর্তী টার্গেট?
বাংলাদেশে ব্লগাররা যে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন তা এখন স্পষ্ট৷ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) এরকম আরো তিনজন ব্লগারকে চিহ্নিত করেছে যাদের নতুন করে টার্গেট করা হয়েছে৷ উগ্রবাদীরা এই তিনজনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাল ক্রস চিহ্ন দিয়ে তাদের খোঁজ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে৷ ডিবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্র ধরে তিন ব্লগার এবং তাদের যারা টার্গেট করেছে সেই উগ্রবাদীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে৷
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এধরণের ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার আগাম ব্যবস্থা নিতে আমরা চেষ্টা করছি৷ এজন্য যারা টার্গেটে পরিণত হয়েছেন তাদের নিরাপত্তা ও আগাম সতর্কতার পাশাপাশি উগ্রবাদীদের আইনের আওতায় আনার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে৷''
ব্লগাররা আতঙ্কে
লেখক ও ব্লগার মাহমুদুল হক মুন্সী বাধন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আসলে এখন আমাদের মধ্যে সার্বক্ষণিকভাবে এক ধরণের নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে৷ আমরা যখন অফিসে যাই বা কাজে বাইরে যাই তখন আমরা ধরেই নিই যে আমাদের ওপর হামলা হতে পারে৷ কারণ সরকার বা পুলিশ প্রশাসন আমাদের নিরাপত্তা বা উগ্রবাদীদের নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে৷'' তিনি বলেন, ‘‘একমাস আগে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছে৷ ২০১৩ সালে হত্যা করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হয়দারকে৷ আসিফ মহিউদ্দীনের ওপর হামলার পর সে প্রাণে বেঁচে যায়৷ আরো অনেক ব্লগারের ওপর হামলা হয়েছে৷ এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হলে হয়তো নতুন কোনো দুঃখজনক ঘটনা ঘটতোনা৷''
উগ্রবাদীরা আরো অনেক ব্লগারকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে হুমকি দিচ্ছে বলে জানান মাহমুদুল হক মুন্সী৷
তিনি বলেন, ‘‘যারা এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত তারা মাদ্রাসা ছাত্র অথবা উগ্রবাদী৷ তাই আমাদের শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন প্রয়োজন৷ কাউকে হত্যা করা, আঘাত করা যে ধর্মরক্ষা নয়, তা তাদের বোঝাতে হবে৷ সমাজের অন্ধকার দিকগুলো দূর করা না গেলে উগ্রবাদও দূর করা যাবে না৷ আর স্বাধীন চিন্তা যে প্রগতির জন্যই প্রয়োজন তা বোঝাতে হবে৷''
মাহমুদুল হক মুন্সী বলেন, ‘‘একটি মহল ব্লগারদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে, উস্কানি দিচ্ছে৷ এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন৷ এর আগে হামলার শিকার ব্লগারদের উল্টো গ্রেপ্তারেরও একাধিক ঘটনা আছে৷ সরকারের অবস্থানও পরিষ্কার হওয়া দরকার৷''
হত্যার বিচার না হওয়া একটি কারণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. সফিউল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা নিশ্চিত যে ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে একের পর এক ব্লগারকে হত্যা করছে৷ তাদের আইনের আওতায় আনা না গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে৷ আরো অনেক ব্লগারের জীবন আশঙ্কার মুখে পড়তে পারে৷ তাই সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এখনই এই ধর্মান্ধ উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত৷''
তিনি বলেন, ‘‘ভিন্ন চিন্তা বা ভিন্ন মতের জবাব কখনো হত্যা নয়৷ মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তা মানুষের অধিকার৷ আর হত্যা একটি জঘন্যতম অপরাধ৷ ভিন্ন মতের প্রতি যে সমাজ সহনশীল নয়, সেটাকে আমরা সভ্য সমাজ বলি না৷''
সফিউল আলম বলেন, ‘‘অতীতে ব্লগারদের ওপর আক্রমণ এবং হত্যার বিচার না হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷''
প্রসঙ্গত, গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা৷
২০১৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বাসায় ফেরার পথে পল্লবীর কালশীর পলাশনগরে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে৷
এর আগে ২০০৪ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার সময় প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে দুর্বৃত্তরা৷ পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জার্মানিতে তার মৃত্যু হয়৷