বাংলাদেশকে টি-টোয়েন্টি শেখালো অস্ট্রেলিয়া
২১ জুন ২০২৪টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের ভয়াবহ ব্যাটিং পারফরম্যান্সের পরও বাংলাদেশ যে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার এইটে উঠে আসতে পেরেছে, তার পেছনে বোলারদের সঙ্গে অবদান আছে উইকেটেরও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ড্রপ-ইন উইকেট আর সেন্ট ভিনসেন্টের মাঠে ১১ বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়া টি-টোয়েন্টি ম্যাচের উইকেটের অবদান কম নয়। টি-টোয়েন্টির প্রথাগত ব্যাটিং এই উইকেটগুলোতে ছিল অচল, টেস্টের পঞ্চম দিনের উইকেটের মতই আচরণ করেছে ডালাস, নিউ ইয়র্ক আর সেন্ট ভিনসেন্টের ২২ গজ। সেখানে রান করাটা হয়ে উঠেছিল কঠিন,১২০ বলের খেলায় ১১০ রানই যেন জয়ের গ্যারান্টি। তবে সুপার এইটে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথাগত সব ভেন্যুতে বেশিরভাগ ম্যাচ আর টি-টোয়েন্টিও ফিরেছে চেনা রূপে। চার-ছক্কার আতশবাজিতে। এখানেই পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ঢাকার যানজটে রিকশা কখনো কখনো গাড়ির আগে যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারলেও রেসট্র্যাকে রিকশা নিয়ে কখনো গাড়িকে পেছনে ফেলা যাবে না। এমনকি রিকশায় ইঞ্জিন বসালেও না। অ্যান্টিগাতে হয়েছে ঠিক তাই। ব্যাটিংবান্ধব উইকেটে আরো একবার মানহীন ব্যাটিং এবং দৃষ্টিকটু আউটের প্রদর্শনী মেলে ধরেছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যাটিং দিয়ে নেপালের বিপক্ষে পার পাওয়া যায়, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে না। সেই সত্যিটাই মাঠের খেলায় ফুটে উঠেছে আরো একবার।
মিচেল মার্শ টস জিতে বোলিং নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাট করতে নামে একাদশে একটি পরিবর্তন নিয়ে, জাকের আলি অনিকের পরিবর্তে শেখ মেহেদি হাসান। প্রস্তুতি ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে শুন্য রানে আউট হওয়ার পর বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও শুন্য রানে আউট হয়েছিলেন সৌম্য সরকার। সেই 'অপরাধ' তাকে বের করে দিয়েছে একাদশ থেকে, তবে যারা টিকে গেছেন তারাও একই 'অপরাধ' এর পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন। তানজিদ হাসান তামিম নেপালের বিপক্ষে ম্যাচের প্রথম বলেই ডাউন দ্যা উইকেটে এসে ক্যাচ দিয়ে আউট হয়েছিলেন শুন্য রানে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩ বল টিকলেও রান সেই শুন্যই, এবার মিচেল স্টার্ক উড়িয়ে দিয়েছেন তার স্টাম্প। এমন শুরুর পর ৫৭ রানের একটা জুটি হল, বাংলাদেশের ব্যাটিং মানদন্ডে বেশ সফলই বলা চলে। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত রানের দেখা পেলেন, লিটন দাস ডট বল একটু বেশি খেললেও ভাল ভাবেই সঙ্গত দিচ্ছিলেন। নবম ওভারের খেলা চলছে, বাংলাদেশের রান ১ উইকেটে ৫৮, বেশ স্বস্তিদায়ক। নিজের দ্বিতীয় ওভারটা করতে এসেছেন লেগস্পিনার অ্যাডাম জাম্পা। বাংলাদেশের বিপক্ষে হাত ঘোরালেই উইকেট পান এই লেগস্পিনার, এর আগের দেখায় দুবাইতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। তাকে দেখেই লিটনের যেন 'মরিবার হলো তার সাধ' । জাম্পার সোজা ডেলিভারিতে সুইপ খেলতে গেলেন লিটন, ইচ্ছে ছিল মিডউইকেট দিয়ে বল সীমানা ছাড়া করার। নিজেকেই মাঠ ছাড়তে হলো বোল্ড হয়ে, ২৫ বলে ১৬ রান করার পর। টি-টোয়েন্টিতে একজন উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান যখন ১০০'র নিচে স্ট্রাইক-রেটে রান করেন, ১৫টা ডট বল দেন এবং ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারটা মেডেন দেন; তখন বুঝতে হবে তাকে ব্যাট করতে পাঠানোর সিদ্ধান্তটাই ছিল ভুল। সেই ভুলের উপর আরো ভুল বাংলাদেশ করে আচমকাই রিশাদ হোসেনকে চারে ব্যাট করতে পাঠিয়ে। সিলেটের মাঠে রিশাদ একদিন ভানিন্দু হাসারাঙ্গার বলে বেশ পিটিয়েছিলেন, যার কিছুটা এলোপাথাড়ি আর কিছুটা লেগস্পিনারের টোপের ফল। অস্ট্রেলিয়া তো আর শ্রীলঙ্কা হয়ে যায়নি, বাংলাদেশ চমকে দিতে চেয়েছিল রিশাদকে উপরে পাঠিয়ে আর অস্ট্রেলিয়া পার্ট-টাইম বোলার গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে দিয়েই তুলে নিল ৪ বলে ২ রান করা রিশাদের উইকেট। জাম্পাকে খেলতে অসুবিধা হচ্ছিল নাজমুল হোসেন শান্ত'রও। সেই সুইপ করতে গিয়ে বল মিস করেছেন, প্যাডে লাগার পর আঙ্গুল তুলতে আম্পায়ার একটুও দ্বিধা করেননি। শান্তও জানেন কি হয়েছে, তাই রিভিউ নিয়ে সময় নষ্ট করেননি।
এরপর সাকিব আল হাসানও অলরাউন্ডার র্যাংকিংয়ের নতুন শীর্ষস্থানধারী মার্কাস স্টোয়নিসের বলে তার হাতেই ক্যাচ দিয়ে আউট হলে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে শুরু হয় ধ্বস। কারণ পরের ওভারেই প্যাট কামিন্স পর পর দুই বলে আউট করেন মাহমুদউল্লাহ আর শেখ মেহেদি হাসানকে। শর্ট বল টেনে মারতে গিয়ে স্টাম্পে নিয়ে আসেন মাহমুদউল্লাহ (২) আর আপার কাট খেলতে গিয়ে প্রথম বলেই থার্ড ম্যানে জাম্পার হাতে ধরা পড়ে শুন্য রানে বিশ্বকাপ শুরু হয় শেখ মেহেদির। ওভারের শেষ দুই বলে উইকেট নিয়েছিলেন কামিন্স, পরের ওভারটা করার সময় তার মাথাতেও ছিল না হ্যাটট্রিকের কথা। তাওহিদ হৃদয় স্কুপ খেলতে গিয়ে বল তুলে দিলেন শর্ট ফাইন লেগে দাঁড়ানো জশ হ্যাজেলউডের হাতে। ম্যাথু ওয়েড এবং অন্য সতীর্থরা এসে কামিন্সকে অভিনন্দন জানানোর সময়ই এই পেসার জানতে পারেন যে হ্যাটট্রিক হয়েছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এটা সপ্তম হ্যাটট্রিকে, অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয়। প্রথমটা করেছিলেন ব্রেট লি, ২০০৭ সালে বাংলাদেশেরই বিপক্ষে।
আউট হওয়ার আগে হৃদয় আশা জাগাচ্ছিলেন দলীয় সংগ্রহটা দেড়শ'র দিকে নিয়ে যাবার। স্টোয়নিসের এক ওভারে পর পর দুটো ছক্কাও মেরেছিলেন। কিন্তু কামিন্সের স্লোয়ার বুঝতে না পেরে ৪০ রানেই শেষ সম্ভাবনাময় ইনিংস। হৃদয়ের বিদায়ের পর বাংলাদেশের ইনিংস থামে ৮ উইকেটে ১৪০ রানে। এই উইকেটে যা জয়ের মত সংগ্রহের চেয়ে কমপক্ষে ৩০ রান কম।
বাংলাদেশ বাজি ধরেছিল শেখ মেহেদির উপর। অস্ট্রেলিয়ার দুই বামহাতি উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে তার পাওয়ার প্লে'তে সফল হবার সম্ভাবনা নিয়ে। তাতে গুড়ে বালি। জয়ের জন্য ওভারপ্রতি গড় রানের চাহিদা যেখানে মাত্র ৭, সেখানে নিয়ম করেই প্রতি ওভারে বাউন্ডারি হজম করেছেন। প্রথম ওভারে রিভার্স সুইপে বাউন্ডারি সহ ডেভিড ওয়ার্নার নিয়েছেন ৫ রান। পরের ওভারে ওয়ার্নার ছক্কা মেরেছেন, নিয়েছেন ৭ রান। তৃতীয় ওভারেও ছক্কা হজম করে দিয়েছেন ৯ রান। পাওয়ার প্লে'র ভেতর বল করে মেহেদির বোলিং ফিগার ৩-০-২১-০। ওদিকে ব্যাটিংয়েও শুন্য। সবমিলিয়ে এই বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচে দারুণ (!) অবদান। সাফল্য বলতে ট্রাভিস হেড একটা বল ইনসাইড এজ হবার পর স্টাম্পে একটুর জন্য লাগেনি।
তানজিম সাকিবের বলেও স্কয়ার লেগে হেডের শটে হাওয়ায় ভাসা বল পড়েছে হৃদয়ের সামনে। ক্যাচটা জমাতে পারলে কিছু হত, কিন্তু হয়নি। ফল, ৬ ওভারেই ৫৯ রান। পূর্বদিকের গ্যালারির দিকে বয়ে চলা বাতাস, রাতের শিশির, বৃষ্টি...কিছুই হারের অজুহাত হয়ে দাঁড়াতে পারেনি অস্ট্রেলিয়ার সামনে। বেধড়ক মার খেয়েছেন তাসকিন আহমেদ। মাত্র ৮টা বল করতে পেরেছেন, তাতেই ২২ রান দিয়েছেন। দুটো করে চার ও ছক্কা হজম করেছেন। রিশাদ হোসেন হেডকে বোল্ড করেছেন ধ্রুপদি লেগস্পিনে, ২১ বলে ৩১ রান করার পর। আর মিচেল মার্শকে ফেলেছেন লেগ বিফোর উইকেটের ফাঁদে, রিভিউ নিয়েও আম্পায়ার'স কল এর গ্যাঁড়াকলে আউট হয়েছেন মার্শ। যে নিয়মের প্রবল সমালোচনাই করেছে বাংলাদেশ, কয়েক দিন আগেও।
এসব ছোটখাট ঝাঁকিতে অস্ট্রেলিয়ার রান তোলার গতি কমেনি,তাসকিনকে স্কয়ার লেগে উড়িয়ে মারা ছক্কায় হাফসেঞ্চুরি পূরণের পর এক রান নেন ওয়ার্নার। তাতে পূর্ণ হয় দলীয় ১০০ রান আর নামে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি আর থামেনি। ১১.২ ওভারে ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন নিয়ম অনুযায়ী ৭২ রান হলেই অস্ট্রেলিয়া জিতে যেত, তাদের রান সেখানে ১০০! তাই পরে ব্যাট করেও রানে জিতে গেল অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশকে হারাল ২৮ রানে। সেই সঙ্গে রান-রেটটাও বাড়িয়ে নিয়ে (+২.৪৭১) অস্ট্রেলিয়া উঠে গেছে সুপার এইট এর গ্রুপ ওয়ান এর শীর্ষে।
হাফসেঞ্চুরি করেছেন ওয়ার্নার,জোড়া শিকার আছে জাম্পারও, তবুও হ্যাটট্রিক করে ম্যাচসেরার পুরষ্কার কামিন্সের। অস্ট্রেলিয়াকে একই বছরে ওয়ানডে এবং টেস্টের বিশ্বকাপ জেতানো কামিন্সের ক্যারিয়ারে কোন হ্যাটট্রিক ছিল না, সেটাও হয়ে গেল, ' আমার জুনিয়র পর্যায়ে কিছু হ্যাটট্রিক বোধহয় আছে, তবে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ছিল না। বেঞ্চে থাকা (অ্যাস্টন) অ্যাগার আর (নাথান) এলিসের হ্যাটট্রিক আছে টি-টোয়েন্টিতে, আমি এখন তাদের দলে। এই অর্জনটা ছিল না, হয়েছে তাই ভাল লাগছে।'
নেপাল এবং নেদারল্যান্ডসের মত আইসিসির সহযোগী সদস্য দলের বিপক্ষে কষ্টেসৃষ্টে পাওয়া জয় সুপার এইট পর্যন্ত নিয়ে আসলেও সেই একই মানদন্ডে যে অস্ট্রেলিয়ার মত দলের বিপক্ষে জেতা যায় না, সেটাই টের পেয়েছে বাংলাদেশ। পাওয়ার প্লে'র অপচয়, অতিরিক্ত ডট বল খেলার প্রবণতা এবং অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরলেও রান করাটা ভুলে যাওয়ার যে প্রবণতা, এই সবই আরো একবার বড় মঞ্চে হারাল বাংলাদেশকে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া বুঝিয়ে দিল, প্রকৃতিও তাদের জয়বঞ্চিত করতে পারে না। এজন্যই তারা ক্রিকেট বিশ্বের পরাশক্তি।