নেপালকে হারিয়ে সুপার এইটে বাংলাদেশ
১৭ জুন ২০২৪বাংলাদেশকে ১০৬ রানে অলআউট করে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বড় অঘটনের স্বপ্ন দেখাচ্ছিল নেপাল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারলো না হিমালয়দুহিতা, নেপালকে ২১ রানে হারিয়েই সুপার এইটে জায়গা করে নিল বাংলাদেশ। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ভারত, আফগানিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া।
বাংলাদেশের সামনে সমীকরণ ছিল সহজ। নেপালকে হারালেই সুপার এইট, নইলে তাকিয়ে থাকতে হবে শ্রীলংকা-নেদারল্যান্ডস ম্যাচের দিকে। ইনিংসের প্রথমার্ধের পর বাংলাদেশ দল হয়তো পরের ম্যাচের দিকেও চোখ রেখেছিল। ১০৬ রানে অলআউট হওয়ার পর জয়ের আশাটা তো মিলিয়েই যেতে বসেছিল বাংলাদেশের!
সেটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। তবে তাতে স্পেশালিস্ট ব্যাটারদের ব্যর্থতার গল্প আড়াল হয়ে যাচ্ছে না। সেন্ট ভিনসেন্টের উইকেট ব্যাটারদের জন্য খুব একটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি অবশ্যই, তবে বাংলাদেশের ব্যাটাররাও দায়িত্ব নিয়ে খেলেছেন, সেটাও বলা যাচ্ছে না।
দায়িত্বজ্ঞানহীনতার শুরুটা ম্যাচের প্রথম বলেই। বাংলাদেশের ইনিংসে প্রথম বলটাই ডাউন দ্য উইকেটে এসে খেলার সিদ্ধান্ত নিলেন তানজিদ হাসান তামিম, ফিরতি ক্যাচ দিলেন সোমপাল কামিকে। পরের ওভারে অফ স্পিনার দীপেন্দ্র সিং আইরির ভেতরের দিকে ঢোকা বলটা বুঝতেই পারলেন না অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত, ফিরে গেলেন ৪ রানেই।
লিটন দাসের জন্য আজকের ম্যাচটা হতে পারত নিজেকে ফিরে পাওয়ার মঞ্চ। চার মেরে শুরুটা ভালোই করেছিলেন। কিন্তু কামির বলে পুল করতে গিয়ে টাইমিংয়ে গড়বড় করে ফেললেন, ১০ রানে ফিরে গেলেন। ২১ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের তখন থরহরি কম্পমান। সেন্ট ভিনসেন্টের আর্ন্স ভেলে নেপালি সমর্থকেরা তখন স্বপ্ন দেখছেন বড় কিছুর।
সেই স্বপ্নটা আরও বড় হলো তাওহীদ হৃদয়ের আউটে। দুই চার মেরে ফর্মে থাকা হৃদয় পালটা আক্রমণ শুরু করেছিলেন। কিন্তু নেপালি অধিনায়ক রোহিত পডেলকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন। ৩০ রানে ৪ উইকেট, বাংলাদেশে,ঘুম ঘুম চোখে টিভি সেটের সামনে বসা দর্শকেরা বোধ হয় নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
সেই অবিশ্বাস আরও বেড়ে গেল খানিক পর। সাকিব আল হাসান আর মাহমুদউল্লাহ ২২ রান যোগ করেছিলেন পঞ্চম উইকেটে। দুজন অনেকবার এমন পরিস্থিতি সামলেছেন, বহু বিপদ থেকে দলকে উদ্ধার করেছেন। কিন্তু আজ সেটা আর হলো না। দায়টা দৃশ্যত সাকিবেরই। সন্দীপ লামিচানের ফুলটসটা মিড অফে ঠেলে রান নিতে চেয়েছিলেন সাকিব। মাহমুদউল্লাহ তার ডাকে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন ক্রিজ থেকে। কিন্তু রান নেয়ার পরিস্থিতি ছিল না। মাহমুদউল্লাহ যখন ভুল বুঝতে পারলেন, তার আগেই ফিল্ডারের থ্রো ধরে লামিচানে ভেঙে দিয়েছেন তার স্টাম্প। সাকিব হতাশায় মাথায় হাত দিযে বসে পড়লেন। আর মাঠে ও টিভি সেটের সামনে বাংলাদেশ সমর্থকদেরও তখন আক্ষরিক অর্থেই মাথায় হাত।
সাকিবের দায় ছিল ইনিংস বড় করার। কিন্তু আগের ম্যাচে অর্ধশতরান পেলেও আজ বড় করতে পারলেন না ইনিংস। ২২ বলে ১৭ রান করে এলবিডব্লু হয়ে গেলেন পডেলের বলেই। অবশ্য সেটাই হয়ে থেকেছে বাংলাদেশের ইনিংসের সর্বোচ্চ, এবং পরিস্থিতি বিচারে শেষ পর্যন্ত মহামূল্যবানও। তবে সাকিব আউট হওয়ার পর ৬১ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের তখন বড় স্কোর তো বটেই, লড়ার করার মতো স্কোরের আশাও হয়ে আসছে স্তিমিত। তানজিম সাকিবও ফিরে গেলেন দ্রুত, জাকের আলী বেশ কিছুক্ষণ উইকেটে থাকলেও ইনিংস বড় করতে পারলেন না। রিশাদ ছয়-চার মারলেন, কিন্তু আরেকটি ছয়ের চেষ্টা করতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন ১৩ রান করে। ৮৮ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের এরপর ১০০ রান করা নিয়েই টানাটানি। শেষদিকে তাসকিন আহমেদের ১২ রানে তিন অংক অবশ্য পেরিয়েছে বাংলাদেশ। তবে খেলতে পারেনি পুরো ২০ ওভারও, ১৯.৩ ওভারে অলআউট হয়ে গেছে ১০৬ রানেই।
এই রান ডিফেন্ড করতে নেমে বাংলাদেশের দরকার ছিল শুরুতেই ভালো কিছুর। কিন্তু তানজিম হাসান সাকিব ঠিক করলেন শুধু ‘ভালোতে' সীমাবদ্ধ থাকবেন না তিনি, তাকে করতে হবে অসাধারণ কিছু। তৃতীয় ওভারে দারুণ এক আউটসুইংয়ে কুশল ভুর্তেলকে বোল্ড করে শুরু হলো তার স্পেলের। তিন বল পর অনিল শাহর ক্যাচ নিলেন শান্ত, নিলেন মেডেন ওভারও। আগের ওভারটা যেখানে শেষ করেছিলেন, সাকিব পরের ওভারটা শুরু করলেন সেখান থেকেই। এবার অধিনায়ক পডেলের ক্যাচ নিলেন রিশাদ। পরের ওভারে ১৭ রান করে যখন আসিফ শেখ মোস্তাফিজের বলে আউট হয়ে গেলেন, ২৪ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলেছে নেপাল। তানজিম সাকিব টানা চতুর্থ ওভার করতে এসে আবারও ধাক্কা দিলেন নেপালকে। এবার ফেরালেন সন্দীপ জোরাকে, ৪ ওভারে ৭ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিয়ে শেষ করলেন স্পেল, ভেঙে দিলেন নেপালের ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড। পরে হয়েছেন ম্যাচের সেরাও।
এরপরেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলো নেপাল। কুশাল মাল্লা ও দীপেন্দ্র সিং ষষ্ঠ উইকেটে যোগ করলেন ৫২ রান। সাকিব-রিশাদদের বলে সিঙ্গেল-ডাবলস নিয়ে সচল রাখছিলেন রানের গতি। মাহমুদউল্লাহর করা ইনিংসের ১৬তম ওভারে চার-ছয় আর ডাবলসে মাল্লা নিলেন ১২ রান। মূলত ওই ওভার থেকেই দিগন্তরেখায় জয়ের চিহ্ন দেখতে শুরু করে নেপাল। শেষ ৪ ওভারে ৩০ রান দরকার নেপালের, ৫ উইকেট হাতে রেখে যেটা খুবই সম্ভব।কিন্তু সেই আশা জাগতে না জাগতেই বড় ধাক্কা খেল নেপালের, বাংলাদেশকে ব্রেক থ্রু দিলেন মোস্তাফিজ। শান্তর বলে ক্যাচ দিয়ে মাল্লা ফিরলেন ২৭ রানে। পরের ওভারে গুলশান ঝাকে ফেরালেন তাসকিন। তবে দীপেন্দ্র আইরি ছিলেন, তাসকিনকে ছয় মেরে নেপালের আশা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। শেষ ২ ওভারে ২২ রান দরকার, কঠিন হলেও অসম্ভব নয়, বিশেষ করে আইরি ছিলেন যখন। কিন্তু মোস্তাফিজের বলের ধাঁধা বুঝতে পারলেন না তিনিও। ১৯তম ওভারে বাংলাদেশের এই বাঁহাতি পেসারের প্রথম ৫ বল থেকে কোনো রানই নিতে পারলেন না আইরি, শেষ বলে ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে।৩১ বলে তার ২৫ রানের ইনিংসটা নেপালের জন্য তাই সান্ত্বনাই হয়ে থেকেছে। অসাধারণ এক উইকেট মেডেনে ম্যাচটা সেখানেই বাংলাদেশের হয়ে মুঠোয় পুরে নিলেন মোস্তাফিজ।
শেষ ওভারে দরকার ছিল ২২ রান, প্রথম ২ বলেই দুই টেল এন্ডারকে ফিরিয়ে আনুষ্ঠানিকতাটা সেরে ফেললেন সাকিব। ৮৫ রানে অলআউট হলো নেপাল, ২১ রানে জিতে বাংলাদেশের সামনে খুলে গেল সুপার এইটের দরজা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই এত কম ডিফেন্ড করেনি জেতেনি কোনো দল। তবে বোলারদের এমন অসাধারণ এক পারফরম্যান্সের পরও সুপার এইতের আগে ব্যাটারদের জন্য হয়তো খানিকটা খচখচানি হয়তো থেকেই গেছে অধিনায়ক শান্ত ও টিম ম্যানেজমেন্টের।