বসনিয়া সীমান্তে শরণার্থীদের কারা পেটায়?
২৩ অক্টোবর ২০২০নির্মমভাবে শরণার্থী ও অভিবাসীদের পেটানোর অভিযোগ রয়েছে ক্রোয়েশিয়া পুলিশের বিরুদ্ধেও৷ এমনকি অনেক শরণার্থী বলছিলেন, বসনিয়া সীমান্ত পাড়ি দেয়ার পর ধরা পড়লে তাদের কালো মুখোশধারী পরিহিত পুলিশ চোখ বন্ধ করে পেটায়৷ এসব পুলিশের অনেকের ইউনিফর্মে জার্মান নাম লেখা, তেমনটাও অভিযোগ করেছেন অনেক শরণার্থী৷
বসনিয়া-ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তের ঠিক কাছেই অবস্থিত মিরাল ক্যাম্প৷ আর সে কারণে বসনিয়ায় অন্য অঞ্চলে অবস্থিত ক্যাম্পগুলোর চেয়ে এই ক্যাম্পটিই শরণার্থী ও অভিবাসীদের কাছে বেশি আগ্রহের৷ এখান থেকে তারা সহজেই অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করতে পারেন৷ এই চেষ্টার একটা নামও দিয়েছেন তারা- ‘গেম মারা’৷
ক্যাম্পের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি শরণার্থী এই অঞ্চলে থাকায় বেশিরভাগেরই আশ্রয় নিতে হয়েছে পাশের জঙ্গলে, অথবা পরিত্যক্ত এক ছাদবিহীন কারখানায়৷
বসনিয়ার তিনদিনে অনেক বাংলাদেশি শরণার্থী ও অভিবাসীর সঙ্গে কথা হয়েছে৷ প্রায় প্রত্যেকেই নিজের গায়ের কাপড় সরিয়ে দেখিয়েছেন লাঠির দগদগে দাগ৷
প্রতিদিনই রাস্তায় আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে বাংলাদেশ ছাড়াও আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মরক্কোসহ নানা দেশের অভিবাসন প্রত্যাশীদের সঙ্গে৷ কারো চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে, কারো পিঠে রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে৷
কাওসার আহমেদের কথাই ধরুন৷ ডয়চে ভেলের সংবাদকর্মীদের দেখে তিনিও এসেছিলেন কথা বলতে৷ তখনও তার পায়ে ব্যান্ডেজ৷ রাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে জঙ্গলে ঘুমাচ্ছিলেন, সকালে তাকেসহ অন্যদের ঘিরে ফেলে পুলিশ, তারপর তাদের বসনিয়া ফেরত পাঠানোর সময় পেটায় ইচ্ছেমতো৷ এমনকি কেবল অন্তর্বাস ছাড়া তাদের সব জামা-কাপড় এবং মোবাইল ফোনও রেখে দেয়া হয়৷
শরণার্থীরা জানান, বসনিয়ায় পুশ-ব্যাকের পর তারা যখন প্রচণ্ড শীতের মধ্যে খালি গায়ে, খালি পায়ে হেঁটে আসেন, তখন কোনো বাসও তাদের নিতে চায় না৷ তবে কিছু বসনিয়ান সহমর্মী হয়ে তাদের জামা-জুতা দান করেন৷
ক্লাদুসার মিরাল ক্যাম্পে গিয়ে এমন অনেকের সঙ্গে দেখা হলো যাদের হাত ভাঙা, চোখে পট্টি বাঁধা৷ একজন পিঠের কাপড় তুলে দেখালেন স্পষ্ট লাঠির ক্ষত৷
সালমান নামের পাকিস্তানি এক শরণার্থী জানিয়েছেন, তাকে মেরে ফেরত পাঠানোর পর রাতের অন্ধকারে পথ ভুলে আবার বসনিয়া থেকে ক্রোয়েশিয়া ঢুকে পড়েন তিনি৷ সেখানে আবার ধরা পড়েন আগের রাতে তাকে পেটানো পুলিশের হাতেই৷ এবার দ্বিগুণ নির্যাতন করে আবার বসনিয়া ফেরত পাঠানো হয় তাকে৷
শরণার্থী যেসব এলাকাতে থাকেন, সেসব এলাকাতে সব দেশেই কিছু মানুষ তাদের পছন্দ করেন না, এটাই স্বাভাবিক৷ বাংলাদেশেও শুরুতে রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের মানবিক আচরণ থাকলেও এখন স্থানীয়দের অনেকেই রোহিঙ্গাদের অপছন্দ করতে শুরু করেছেন৷ কিন্তু অনেকে এখনও রোহিঙ্গাদের প্রতি অবিচারের যৌক্তিক সমাধানও চান৷
বসনিয়াতেও একই অবস্থা৷ বিশেষ করে ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় শরণার্থী ও অভিবাসীদের আনাগোণা বেশি থাকায় এখানকার মানুষ বসনিয়া সরকারের ওপরও বেশ ক্ষিপ্ত৷ তেমনই কয়েকজন নিয়মিত মিরাল ক্যাম্পের সামনে জড়ো হয়ে ক্যাম্প বন্ধের দাবি জানান৷ একদিন তো আমরা ক্যাম্পের সামনে শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলার কারণে আমাদের ওপরেই চড়াও হলেন৷ পরে পুলিশ এসে বলতে গেলে আমাদের উদ্ধার করে৷
কিন্তু অন্যদিকে বসনিয়ার অনেকেই শরণার্থীদের দুর্দশায় নিজেরাও ব্যথা পান৷ অনেকেও ক্ষিপ্ত ক্রোয়েশিয়ার পুলিশের ওপর৷ এমন একজন বসনিয়ান নিজে ডেকে আমাদের একটি ভিডিও দিয়েছেন৷ জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে কয়েকজন শরণার্থীকে হেঁটে আসতে দেখেছেন তারা, যাদের শরীরে নির্মম অত্যাচারের দাগ৷
ক্যাম্পের ম্যানেজার মিতে চিলকোভস্কিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ক্রোয়েশিয়া পুলিশের বর্বরতার বিষয়ে৷ তিনিও শরণার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া অভিযোগের কথা জানালেন, বললেন যে ক্রোয়েশিয়া পুলিশকেও এ বিষয়ে জানানো হয়েছে৷ কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে স্বাভাবিকভাবেই সব অস্বীকার করা হয়৷
বাংলাভাষী সাংবাদিক হিসেবে আমরাই প্রথম গিয়েছি এই অঞ্চলে৷ ফলে আমাদের দেখে নিজের মনের সব কথা খুব সহজেই খুলে বলতে পেরেছেন তারা৷ বারবার একটা আকুতিই জানিয়েছেন, যাই করা হোক, ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত পুলিশের নির্যাতনের বিষয়টি যাতে তুলে ধরা হয়৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়া ইউরোপের ভিসাবিহীন অঞ্চল শেঙ্গেনে নেই৷ ইইউ সীমান্তে সংশ্লিষ্ট দেশের পুলিশের সঙ্গে কাজ করে ফ্রন্টেক্স নামের ইউরোপিয়ান সংস্থাও৷ ক্রোয়েশিয়া পুলিশের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে জার্মানি ফিরেই যোগাযোগ করি ফ্রন্টেক্সের সঙ্গে৷ উত্তরে সীমান্তে এমন কোনো ঘটনা সম্পর্কে তাদের কিছু জানা নেই বলে জানান সংস্থাটির মুখপাত্র ক্রিস বরভস্কি৷
সীমান্তে ফ্রন্টেক্সের কেবল ছয় জন অফিসার কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন বরভস্কি৷ ক্রোয়েশিয়া পুলিশকে তারা আকাশপথে নজরদারিতে সহায়তা করে৷ একই সঙ্গে ফ্রন্টেক্স সব ধরনের মানবাধিকার ও আইন মেনেই কাজ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ স্বভাবতই এমন উত্তর আসবে ভেবেই বাড়তি একটা প্রশ্ন যোগ করে দিয়েছিলাম- ফ্রন্টেক্স এমন নির্যাতনের নিন্দা জানায় কিনা৷ উত্তরে বলা হয়েছে, যেকোনো নির্যাতন ও মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘনের নিন্দা জানায় ফ্রন্টেক্স৷
আমাদের অনেক প্রতিবেদনের নীচে অনেক পাঠক ও দর্শকই শরণার্থীদের নিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘এরা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে’, ‘এরা টাকার লোভে বিদেশ গেছে, এমনই হবে’, এমনকি অনেকে শরণার্থীদের পেটানো ‘উচিত’ বলেও মন্তব্য করছেন৷
মানবাধিকারের বিষয়টিই এমন৷ কেউ কোনো অপরাধ করলেও তার আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার রয়েছে৷ একজন চোরকেও পেটানো মানবাধিকারের লঙ্ঘন, সেটাও বেআইনী৷ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না করে যেকোনো অপরাধের অভিযোগের ‘পেটানোর’ যে সংস্কৃতি বাংলাদেশের মানুষের মনে গড়ে উঠছে, সেটা দূর করতে না পারলে অর্থনীতিতে দেশ এগিয়ে গেলেও, আমরা সভ্য হতে পারবো না৷
অন্যদিকে ইউরোপের দেশগুলোও যদি এই ‘পেটানো’ এবং ‘দেখেও চোখ বন্ধ করে রাখা’ সংস্কৃতির চর্চা করে, তাহলে তারা তথাকথিত ‘মানবতার পতাকা’ ওড়ানোর অধিকার হারাবে৷
কেউ যদি অবৈধ পথে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টাও করে, তাকে আটক করা যায়, জেলে পাঠানো যায়, দেশে ফেরত পাঠানো যায়, কিন্তু তার কাপড়চোপড় খুলে নেয়া যায় না, মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া যায় না, তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা যায় না৷ এই সহজসরল কথাগুলো ইউরোপের পুলিশকে নতুন করে বোঝানোর কথা না৷
বলকান রুটে শরণার্থীদের ওপর পুলিশি অত্যাচার সীমাহীন হয়ে উঠেছে৷ ইউরোপের বন্ধ চোখ কি জোর করে খুলতে হবে?