1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বন্ধুত্বপূর্ণ রুশ-বাংলাদেশ সম্পর্কে শঙ্কার ছায়া

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক ভারসাম্য রক্ষায় বাংলাদেশ আরো জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। মস্কোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তলব সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে বলে মত বিশ্লেষকদের।

https://p.dw.com/p/4Nqsx
Bangladesch | Don Lu und Abdul Momen treffen sich in Dhaka
ছবি: Harun Ur Rashid Swapan/DW

তারা মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারতের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হচ্ছে বলে বাংলাদেশ এখন চ্যালেঞ্জের মুখেই আছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলেই এ পরিস্থিতির অবসান হবে না। দুই পক্ষই আরো স্পষ্ট অবস্থানের জন্য মিত্রদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সেক্ষেত্রে কূটনৈতিক পেশাদারিত্ব, দক্ষতা ও গভীর যোগাযোগ ছাড়া এই পরিস্থিতি মোকাবেলা কঠিন বলে মনে করছেন তারা।

মঙ্গলবার রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল ইসলামকে ডেকে নেয় দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকায় ৬৯টি রুশ জাহাজকে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে না দেয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায়ই রাষ্ট্রদূততে তলব করা হয়। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, "যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞার হুমকির  কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।”

রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, "বাংলাদেশি বন্দরে বাংলাদেশের জন্য মালামালবাহী রুশ জাহাজ ভেড়ার ক্ষেত্রে তার দেশের ( বাংলাদেশ) কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক প্রতিবেদন কূটনৈতিক মিশনের প্রধানের নজরে এনেছি আমরা। এই পদক্ষেপ ঐতিহ্যগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়েছে, যা  বহুমাত্রিক পর্যায়ে আমাদের সহযোগিতার জন্য এটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।”

জানুয়ারি মাসে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম নিয়ে আসা রুশ জাহাজ ‘উরসা মেজর' অনুমতি না পাওয়ায় পণ্য খালাস না করেই ভারতীয় জলসীমা থেকে ফিরে যায়। এরপর রাশিয়ার যেসব জাহাজ মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় রয়েছে, সেসব নৌযানের বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশে গত ১৬ জানুয়ারি নিষেধাজ্ঞা দেয় বাংলাদেশ সরকার।

আমি বিস্মিত হয়েছি: হক

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর রাশিয়ান ব্যাংক, জাহাজ, পণ্য, সুইফট ও মূদ্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ঋণ চুক্তি ছাড়াও ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে। রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ গমসহ আরো অনেক পণ্য আমদানি করে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার আছে রাশিয়ায়। সবচেয়ে বড় কথা, মুক্তিযুদ্ধের সময় রশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় দেশটিরর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বুধবার বলেছেন, "আমরা আমাদের রাষ্ট্রদূতের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছি। প্রতিবেদন পেয়ে আশা করি বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে পারবো।”

তিনি আরো বলেন, "ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব এক জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা দেশের স্বার্থ মাথায় রেখে আমাদের সিদ্ধান্ত ও অবস্থান নিচ্ছি।”

এদিকে সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন," রাশিয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করায় আমি বিস্মিত হয়েছি। আমরা তো তাদের কাছ থেকে বিলিয়ন ডলারের পণ্য নিচ্ছি। এখন ওই জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমরা নিতে পারিনি। আমাদের ওপরও তো চাপ আছে। হয়ত রাশিয়াও এটা জানান দিতে চাইছে যে, অ্যামেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাই জাহাজ ভিড়তে দাওনি, কিন্তু আমরাও তো তোমাদের ঋণ দিচ্ছি। আমাদের কথা তোমরা কেন শুনবে না?”

তার কথা, "সমস্যা হচ্ছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে সামনে রেখে এখন অ্যামেরিকা-রাশিয়া চাইছে মিত্রদের অবস্থান পরিষ্কার করতে। হয় ওর দিকে থাকো , নয় আমার দিকে। মাঝামাঝি অবস্থান নেয়া আমাদের মতো দেশের পক্ষে সামনে আরো কঠিন হয়ে যেতে পারে। আমরা এখন চারটি ফ্রন্ট খোলা রেখেছি। এতগুলো ফ্রন্ট খুলে ‘যুদ্ধ' করা কঠিন।”

‘‘রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকেই আমরা সবচেয়ে বেশি গম আনছি। এখন গমের জাহাজের ওপর যদি কোনো নিষেধাজ্ঞা আসে, তাহলে কিন্তু আমরা বিপদে পড়ে যেতে পারি। আমরাপারমাণবিক বিদ্যুতের সরঞ্জাম ও গম ছাড়াও আরো অনেক কিছু রাশিয়া থেকে আনি,'' বলেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।

রাশিয়া উল্টো বাংলাদেশের ওপর কোনো শর্ত আরোপ করতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "সেটা আমার মনে হয় তারা করবে না। তবে খাদ্যপণ্যবাহী জাহাজের ওপর যদি অ্যামেরিকা নিষেধাজ্ঞা দেয় অথবা নিষেধাজ্ঞা আছে এমন জাহাজে করে রাশিয়া পণ্য পাঠায়, তাহলে আমরা আরো সংকটে পড়ে যেতে পারি।”

তার মতে, "ভারতের সাথে অ্যামেরিকার একটি টানাপোড়েন শুরু হয়েছে রাশিয়া নিয়ে। এখন এটা যদি আরো বাড়তে থাকে, তাহলে তার প্রভাব আমাদের ওপরও পড়তে পারে। আর আমরা যে নোটটি পাঠিয়েছি, তারও একটা প্রভাব পড়বে। চীনের সাথেও কোনো ইস্যু আছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে আমরা ক্রমশ জটিল অবস্থার দিকে যাচ্ছি।”

সামনে আরো বড় চ্যালেঞ্জ?

একটি পক্ষ নেয়ার চাপ আছে: কবির

কূটনীতিক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির মনে করেন, "ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধের করণে বাংলাদেশ একটি জটিল কূটনৈতিক পরিস্থিতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ চাইছে ব্যালেন্স করে সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে; কিন্তু চাপ আছে। কোনো একটি পক্ষ নেয়ার চাপ আছে। রাশিয়া যে  সেদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে এটা সেই চাপেরই অংশ। তারপরও আমি মনে করি, বাংলাদেশ এখনো সঠিক পথেই আছে। মন খারাপ করার কিছু নেই।”

তিনি বলেন, " আমাদের আরো এই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। এজন্য আমাদের এখন যা প্রয়োজন তা হলো কূটনৈতিক সক্ষমতা, দক্ষতা, গবেষণা। খুব দ্রুত এগুলো বাড়াতে হবে। এটা এখন আর ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শেষ হবে বলে মনে হয় না। এটা আরো অনেক দূর গড়াবে। দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার দিকে যাচ্ছে। আমাদের মতো দেশগুলো এই জটিলতায় জড়িয়ে যাচ্ছে। আমরা যাদের সঙ্গে কাজ করি, তাদের সঙ্গে নানা ধরনের স্বার্থ আছে। সেটা বিবচনায় রেখে, মাথা গরম করে কারো বিরুদ্ধে কিছু না বলে, প্রত্যেক পক্ষকে কূটনৈতিক দক্ষতায় বোঝানো, তাদের সঙ্গে এনগেজড থাকা দরকার।”

"আশঙ্কার জায়গা হলো, এখন রাশিয়ার জাহাজ ভিড়তে দিলাম না।এরপর যদি আবারো একই অবস্থা হয়, তাহলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজে দেরি হবে। এটা যদি দেরি হয় আর এরমধ্যে ঋণের টাকা ফেরত দেয়ার সময় আসে, তাহলে আমরা সার্ভিস পাবো না; কিন্তু টাকা দিতে হবে,” বলেন এই কূটনীতিক।

তার কথা, "পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো নিজেই বলছেন যে, আমাদের একটি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারতের সঙ্গে আমাদের একসঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হচ্ছে। এটা চ্যালেঞ্জিং এবং সংকটের। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এটার সমাধান নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কূটনীতি মানে যে প্রটোকল দেয়া, তা নয়। এইযুগ পার হয়ে গেছে। এখন আমাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, যোগাযোগ বাড়াতে হবে। দেশের স্বার্থ মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।”