1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বইমেলায় কখনো রাজনীতি, কখনো অনুভূতির ‘রাজনীতি’

২৭ জানুয়ারি ২০২৩

একটি বই নিয়ে বাংলা একাডেমির আপত্তি থাকায় এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় স্টল পায়নি আদর্শ প্রকাশনী৷ বাংলাদেশে বই নিয়ে ‘আপত্তি’ বা মেলায় স্টল বরাদ্দ নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়৷

https://p.dw.com/p/4MnZw
একুশে বইমেলা৷
বাংলাদেশে বই নিয়ে ‘আপত্তি’ বা মেলায় স্টল বরাদ্দ নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়৷ছবি: Mortuza Rashed/DW

এবার একাডেমি কর্তৃপক্ষ তাদের আপত্তির কারণ ব্যাখ্যা করেছে৷ তারা বলছে বইমেলার নীতিমালা অনুসরণ না করে ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ নামের একটি বই প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য বইমেলার স্টলে রাখতে চাওয়ায় আদর্শ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে না৷ বইটির লেখক ফাহাম আব্দুস সালাম৷

বাংলা একাডেমি তাদের চোখে বইয়ের ‘বিতর্কিত’ অংশটুকুও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তুলে ধরেছে৷ তারা বলছে, বইটির ১৫ নম্বর পৃষ্ঠায় বাঙালি জাতিসত্তা; ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বিচার বিভাগ, বিচারপতি, বাংলাদেশের সংবিধান, সংসদ সদস্য; ২০ নম্বর পৃষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ৭১ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে অশ্লীল, রুচিগর্হিত, কটাক্ষমূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে, যা সংবিধানের ৩৯ (২) অনুচ্ছেদে বর্ণিত মত প্রকাশের স্বাধীনতা, যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের পরিপন্থী৷ কমিটি মনে করে, বইটি বইমেলার নীতিমালা ও নিয়ামাবলির পরিপন্থি৷

‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ বইটির লেখক ফাহাম আব্দুস সালাম বলেন, ‘‘আমার বইটি যদি কেউ পড়েন, তাহলে তাদের মনে হতে পারে বাংলা একাডেমিতে আমার কোনো লোক আছে, তাদের দিয়ে আমি বইটি বই মেলায় নিষিদ্ধ করিয়েছি চাহিদা বাড়ানোর জন্য৷ বইয়ে এমন কিছু নেই যার জন্য আপত্তি করা যায়৷ আমরা মনে হয়, কেউ আমার বইটির কিছু লাইন মার্ক করে বাংলা একাডেমিকে দিয়েছে, তারা সরকারকে খুশি করতে আদর্শ প্রকাশনীকে ‘নিষিদ্ধ' করেছে৷’’

তার কথা, ‘‘এতে আমার কোনো ক্ষতি হয়নি৷ কিন্তু আরো অনেকের বই তারা প্রকাশ করতো, সেই লেখকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন৷ প্রকাশক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন৷ এখন পাঠকরা বাইরে থেকে আমার বই হুমড়ি খেয়ে কিনছেন৷ তারাও  আবার পড়ে হতাশ হতে পারেন৷ কারণ, তারা মনে করছেন হয়ত অনেক কিছু পাবেন, কিন্তু তারা যেরকম চান, সেরকম কিছু পাবেন না৷’’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমার বই নিষিদ্ধ না, কিন্তু প্রকাশক ‘নিষিদ্ধ’৷ এর মাধ্যমে বাংলা একাডেমি প্রকাশকদের বলে দিলো আমাদের চিন্তার বাইরে কোনো বই প্রকাশ করলে তোমরাও বই মেলায় আসতে পারবে না৷’’ তিনি বলেন, তিন বছর আগের বই নিয়ে এখন তারা স্টল দিলো না৷ এই তিন বছর তারা কী করেছেন? আর আদর্শর কর্ণধার মাহবুব রহমান বলেন, ‘‘বাংলা একডেমি তো বই নিষিদ্ধ করতে পারে না৷ তারা স্টল নিষিদ্ধ করে উৎসে সেন্সর করলো৷ জানিয়ে দিলো, তাদের পছন্দের বাইরে গেলে স্টল পাওয়া যাবে না৷ ফলে এমনিতেই তো প্রকাশকরা নিজেরা সেন্সর করে, এটা আরো বাড়বে৷ ফলে সরকারকে আর সেন্সর করতে হবে না৷’’

তার কথা, ‘‘এর ফলে ভিন্নমত, ভিন্নস্বর কমে যাবে৷ সেটাই চাওয়া হচ্ছে৷ এ বছর ৬০ জন লেখকের বই নিয়ে আসতাম, তাদের বই এলো না৷ প্রকাশক হিসেবেও আমি ক্ষতিগ্রস্ত হলাম৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমাকে যদি সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী প্রকাশ করতে হয় , লিখতে হয়, তাহলে তো আমাকে সরকারি চাকরি করতে হবে৷’’

এরফলে ভিন্ন মত, ভিন্নস্বর কমে যাবে: মাহবুব রহমান

স্টল বরাদ্দের নীতিমালায় যা আছে

বাংলা একাডেমি তার নীতিমালায় বলেছে-অশ্লীল, রুচিগর্হিত, জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি কটাক্ষমূলক, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয় এমন বা জননিরাপত্তার জন্য বা অন্য যে কোনো কারণে বইমেলার পক্ষে ক্ষতিকর কোনো বই বা কোনো পত্রিকা বা অন্য কোনো দ্রব্য অমর একুশে বইমেলায় বিক্রি, প্রচার ও প্রদর্শন করা যাবে না৷ একাডেমি বা বইমেলা পরিচালনা কমিটি যদি বইমেলায় কোনো বই, ম্যাগাজিন, লিফলেট বা এ জাতীয় অন্য কোনো দ্রব্য বিশেষ কারণে বা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রচার বা প্রদর্শন বা বিক্রি করা বাঞ্ছনীয় বিবেচনা না করে, তাহলে কোনো অংশগ্রহণকারী তা প্রদর্শন বা প্রচার বা বিক্রি করতে পারবেন না৷ এ সিদ্ধান্ত কোনো অংশগ্রহণকারী যদি মানতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার স্টল বরাদ্দ বাতিল হবে, তার জমা দেয়া টাকা ফেরত দেয়া হবে না৷ এবং ভবিষ্যতে তিনি মেলায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না৷

লেখক ও গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, ‘‘এইসব নীতিমালার কোনো ব্যাখ্যা নেই৷ আর এর মানদণ্ড কী হবে তা-ও স্পষ্ট নয়৷ আসল কথা হলো, আমার পছন্দ হলে ঠিক আছে আর পছন্দ না হলে ঠিক নাই৷ এটা নির্ভর করে কখন কারা ক্ষমতায় তার ওপর৷’’

তিনি বলেন, ‘‘বিকৃত রুচি বললে এর পক্ষে বিপক্ষে দুই গ্রুপ কথা বলবে৷ কিন্তু আমাদের বিকৃত রুচির কারণ হলো আমাদের রাজনীতি খুব বিকৃত রুচি হয়ে গেছে৷’’

আসল কথা হলো আমার পছন্দ হলে ঠিক আছে, পছন্দ না হলে ঠিক নাই: আফসান চৌধুরী

‘‘আগেও এটা হতো৷ তবে এখন বাড়ছে৷ বাংলা একাডেমি একটা উদাহরণ সৃষ্টি করে দিলো৷ আগামীতে যে কত স্টল আর বই বন্ধ হবে তা ভাবা যায় না,’’ বলেন আফসান চৌধুরী৷

নিষেধাজ্ঞার অতীত

২০১৫ সালে ‘নবী মোহাম্মদের ২৩ বছর’ নামের একটি বইয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দিয়েছিল বাংলা একাডেমি৷ সেটি ছিল এক ইরানি লেখকের বইয়ের অনুবাদ৷ এরপর ২০১৬ সালে ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে একটি বইয়ের কারণে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত লাগার আশঙ্কায় অমর একুশে বইমেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয় পুলিশ৷ এ ঘটনায় লেখকসহ পাঁচ জনকে আটকও করা হয়৷ একই বছর শ্রাবণ প্রকাশনীকে দুই বছরের জন্য বাংলা একাডেমিতে নিষিদ্ধ করা হয় ধর্ম নিয়ে ‘আপত্তিকর’ বই প্রকাশের প্রস্তুতির অভিযোগে৷

২০২০ সালে বই মেলা চলাকালে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অভিযোগে দুইটি বই নিষিদ্ধ করে হাইকোর্ট৷ বই দুইটি হলো দিয়ার্ষি আরাগ নামের এক লেখকের ‘দিয়া আরেফিন’ এবং ‘নানীর বাণী’৷ আদালত তখন বই মেলার সব স্টল এবং সারা বাংলাদেশ থেকে বই দুটি তুলে নেয়ার নির্দেশ দেয়৷

বাংলাদেশে আদালতের নির্দেশের বাইরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরাসরি আইনের অধীনে বই বা কোনো লেখা নিষিদ্ধ করতে পারে৷ হুমায়ূন আজাদের নারী, তসলিমা নাসরিনের লজ্জা-সহ ছয়টি বই এ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্তণালয় নিষিদ্ধ করেছে৷ কর্নেল অলি আহাদের ‘রেভ্যুলিউশন, মিলিটারি পার্সোনেল অ্যান্ড দ্য ওয়ার অব লিবারেশন’ বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল আদালতের নির্দেশে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ২০২০ সালের আগস্টে নিষিদ্ধ হয় সাইফুল বাতেন টিটোর ‘বিষফোড়া’৷ ওই বছরের বইমেলায় বইটি প্রথমে বিক্রি হলেও শেষ দিকে বইটির সব কপি মেলা থেকে তুলে নেয় পুলিশ৷

প্রতিবছর বইমেলার বইগুলো মনিটর করার দায়িত্বে থাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ৷ তাদের পক্ষে কাজটি করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ৷ কোনো বই তাদের কাছে আপত্তিকর মনে হলে তারা প্রথমে বইটি তুলে নেয়৷ পরে তাদের প্রতিবদেনের ভিত্তিতে প্রয়োজনে নিষিদ্ধও করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণলয়৷ তাদের বিবেচনায় থাকে ‘শান্তিশৃঙ্খলা পরিপন্থী’ বিষয়টি৷ তবে এ বছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও একটি কমিটি গঠন করে বই মনিটর করছে৷

বিষফোড়া বইয়ের লেখক সাইফুল বাতেন টিটো তার বই নিষিদ্ধ হওয়ার পর দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন৷ তিনি বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমার বইটি নিষিদ্ধ করে৷ তারা সংবাদমাধ্যমে নিষিদ্ধের প্রেসরিলিজও পাঠায়৷ আমার বইটি ছিল কওমী মাদ্রাসায় শিশু নির্যাতন ও বলাৎকার নিয়ে গবেষণা গ্রন্থ৷ অবাক করা ব্যাপার হলো, মাদ্রাসা থেকে আমি কোনো প্রতিক্রিয়া পাইনি৷ কিন্ত তথাকথিত প্রগতিশীলরাই আমার বিরুদ্ধে লেগেছিল৷ বই নিষিদ্ধের পর নানা ধরনের হুমকি পাওয়ায় আমি দেশ ছাড়ি৷’’

তিনি বলেন, ‘‘বই নিষিদ্ধ করা মুক্ত চিন্তা ও বাক স্বাধীনতাবিরোধী৷ আমি চাই এই প্রক্রিয়া বন্ধ হোক৷’’

আফসান চৌধুরি বলেন, ‘‘গত ৫০ বছর ধরেই এই চর্চা চলে আসছে৷ আমরা এখন বলছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা৷ বিএনপি আমলে আমরা পাকিস্তানি বাহিনিকে পাকিস্তানি বাহিনি, ঘাতক বাহিনি বলতে পারতাম না৷ এখানে সব কিছুকেই রাজনীতি প্রভাবিত করে৷ সরকার চাইলে বন্ধ হবে, সরকার চাইলে চলবে৷ বই মেলায় স্টল বন্ধ হলো, এটা কি বাংলা একাডেমি করেছে, না সরকার করেছে? সরকার চাইলে তো বাংলা একাডেমির সেটা করতে হবে৷’’

‘‘যেটা হবে, তা হলো, তাদের পছন্দের বাইরে লেখকের  পছন্দ বা স্বাধীনতা সংকুচিত হবে,’’ বললেন আফসান চৌধুরী৷

বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব ডা. এ কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘বইয়ের ব্যাপারে আমাদের নীতিমালা আছে, সেটা অনুসরণ করি৷ আর এটা প্রকাশকদেরও দায়িত্ব৷ স্টল নিষিদ্ধ হওয়ায় লেখকের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে কিনা আমি বলতে পারবো না৷ আমি তো লেখক না৷ সেটা দেখবে মেলা পরিচালনা কমিটি, মিডিয়াসহ অন্যান্যরা৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য