পরাধীন সাহিত্যে নিষিদ্ধ আর মৃত্যুর মিছিল
৩১ জানুয়ারি ২০২০দরজায় কড়া নাড়ছে একুশে বই মেলা, বাঙালির প্রাণের মেলা৷ ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির এই মেলা ঘিরে বাংলাদেশে লেখক, প্রকাশ ও পাঠকদের অপেক্ষা আর উৎসাহের কমতি নেই৷ কিন্তু বাংলাদেশে ঠিক কতটা স্বাধীনভাবে সাহিত্য চর্চা করা যায়৷ বিশ্বজুড়েই বা সাহিত্য চর্চায় কতটা স্বাধীনতা আছে৷ সমাজ, ধর্ম বা রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাহিত্য কি কোনো কালে আপন গতিতে চলতে পেরেছে৷
বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না-এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি বই লিখে অনেককে দেশছাড়া হতে হয়েছে সেটাও চরম সত্য৷ বাংলাদেশে এ যেন আরো নিদারূণ সত্যে পরিণত হয়েছে৷ বাংলাদেশে প্রথম লেখার জন্য দেশছাড়া হয়েছিলেন দাউদ হায়দার৷ তিনি অবশ্য ঠিক বই লিখে নয়, কবিতা লিখে নির্বাসিত হন৷ ১৯৭৪ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’ এর সাহিত্য পাতায় তিনি ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লিখে এই পরিণতির শিকার হন৷ তার কবিতা ছাপা হওয়ার পর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ তুলে শুরু হয় প্রতিবাদ৷ এক শিক্ষক তার বিরুদ্ধে মামলা করেন৷ এরপর তাকে নেওয়া হয় নিরাপত্তা হেফাজতে, পরবর্তীতে বিমানে করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ সেই থেকে নির্বাসিত আছেন তিনি৷ মাঝে বাংলাদেশে সরকারের পালা বদল হয়েছে কয়েকবার, কিন্তু দাউদ হায়দারের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি৷ তিনি নির্বাসিতই থেকে গেছেন, একবারের জন্যও পা রাখতে পারেননি দেশের মাটিতে৷ বর্তমানে তিনি জার্মানিতে বসবাস করছেন৷
দাউদ হায়দারকে একটি কবিতার জন্য নির্বাসিত হতে হয়৷ তবে আক্ষরিক অর্থে বই নিষিদ্ধ করার ঘটনা প্রথম ঘটে সম্ভবত ১৯৯৩ সালে৷ সেবার তসলিমা নাসরিনের বই ‘লজ্জা’ নিষিদ্ধ হয়৷ ওই বইয়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, মিছিল-মিটিং, নামে-বেনামে হত্যার হুমকি এমনকি লেখিকার মাথার দাম পর্যন্ত ঘোষণা হয়৷ এখন কলকাতায় একরকম নির্বাসিত জীবনই কাটাচ্ছেন তিনি৷
নারীবাদ নিয়ে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের বই ‘নারী’ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয় ১৯৯৫ সালে, ২০০০ সাল পর্যন্ত ওই নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল৷ মৌলবাদের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে প্রকাশিত তার উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ বাংলাদেশের একটি শ্রেণীকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করেছিল৷ একটি অপশক্তি তার বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করে, এমনকি ওই বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে তার উপর হামলা হয়৷ বইমেলা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজ বাসায় ফেরার সময় দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের কোপ তাঁকে মৃত্যুর মুখ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল৷ যদিও চিকিৎসকদের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত প্রাণে রক্ষা পান তিনি৷
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ প্রাণে বেঁচে গেলেও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও লেখক অভিজিৎ রায় অতটা সৌভাগ্যবান ছিলেন না৷ বই মেলায় যোগ দিতে স্ত্রীকে নিয়ে ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় আসা অভিজৎকে টিএসসির কাছে রাস্তায় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনিও বইমেলা থেকেই ফিরছিলেন৷ আরো কয়েকজন ব্লগার ও প্রকাশক একইভাবে খুন বা হামলার শিকার হয়েছেন৷
এই যে এক জনের মতের সঙ্গে নিজের মত না মিললেই অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ, শুধুমাত্র লেখার কারণে লেখকদের ‘মাথার’ দাবিতে রাজপথে মিছিল, নামে-বেনামে হত্যার হুমকি, আক্রমণ, হত্যা- এ যেন এক অস্থির সময়ে বাস করছি আমরা৷
সরকার থেকেও ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানো প্রতিরোধের নামে সেই লেখকদেরই হাত-পা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে৷ বই প্রকাশের ওপর নজরদারি বাড়াতে মাঠে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী৷ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে ২০১৬ সালে বইমেলা চলার সময়ই ‘ব-দ্বীপ’ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেয় পুলিশ৷ গ্রেপ্তার করা হয় প্রকাশনীর মালিক শামসুজ্জোহা মানিককে৷ ‘ইসলাম বির্তক’ সহ প্রকাশনীর আরো কয়েকটি বই জব্দ করা হয়৷
বাংলাদেশে বই নিষিদ্ধেরও অনেক আগে বাংলা ভাষার বই নিষিদ্ধের ঘটনা ঘটেছে৷ ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলা ভাষার বেশ কয়েকটি বই নিষিদ্ধ হয়েছিল৷ যার মধ্যে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘যুগবাণী’ অন্যতম৷ ১৯২২ সালে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়৷ তারপর একে একে ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙ্গার গান’, ‘প্রলয় শিখ’ সহ নজরুলের অনেক বই ও লেখা নিষিদ্ধ করেছিল ব্রিটিশ শাসকরা৷
শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বজুড়েই এভাবে সাহিত্যিকদের কলম আটকে দেওয়া চলছে৷ ব্লাসফেমি ও যৌনতার অভিযোগে জেসম জয়েসের ‘ইউলিসিস’ ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে নিষিদ্ধ ছিল৷ জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস ‘এনিম্যাল ফার্ম’ ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় নিষিদ্ধ ছিল৷ ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ ২০০৩ সালে লেবাননে নিষিদ্ধ করা হয়৷ বোরিস পেস্টারনেকের উপন্যাস ‘ডক্টর জিভাগো’ দীর্ঘকাল নিষিদ্ধ ছিল সোভিয়েত রাশিয়ায়৷ আলেকজান্ডার কাম্পবেলের কল্পকাহিনী ‘দ্য হার্ট অফ ইন্ডিয়া’ ১৯৫৮ সালে ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ টেড ডাভের ‘ইনটু দ্য রিভার' বইটি ২০১২ সালে নিউজিল্যান্ডে নিষিদ্ধ করা হয়৷
বিশ্বের অনেক দেশে নিষিদ্ধ এবং আলোচিত বইয়ের তালিকায় প্রথম দিকেই থাকবে ব্রিটিশ ভারতীয় লেখক সালমান রুশদির বই ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’৷ রুশদি বলেছিলেন, বইটি তিনি মহানবি (সাঃ) এর জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে লিখেছেন৷ কিন্তু বইয়ের কিছু অংশে মহানবি (সাঃ) কে অবমাননা করা হয়েছে বলে মনে করেন অনেক মুসলমান৷ নানা দিক থেকে নানা হুমকি এমনকি মৃত্যুর হুমকি পান তিনি৷ ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনি তাঁকে হত্যার ফতোয়াও জারি করেন৷ এই বই বিক্রি করায় বিভিন্ন দোকানে বোমা হামলার ঘটনাও ঘটেছে৷