ফের হাসপাতালে হেনস্থা, কর্মবিরতি চিকিৎসকদের
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪এই ঘটনার পর কর্মবিরতিতে সেখানকার জুনিয়র চিকিৎসকরা৷ আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে লাগাতার কর্মবিরতি চালিয়েছেন চিকিৎসকরা৷ ৪২ দিনের বিরতির পর গত শনিবার থেকে কাজে ফিরেছেন তারা৷ এর ঠিক সাতদিনের মধ্যে চিকিৎসকেরা আক্রান্ত হলেন কর্মক্ষেত্রে।
ওয়ার্ডে ঢুকে মারধর
উত্তর ২৪ পরগনার কামারহাটি এলাকায় সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ৷ সেখানে শুক্রবার বিকেলে সঙ্কটজনক অবস্থায় নিয়ে আসা হয় এক রোগীকে৷ বছর তিরিশের রঞ্জনা সাউয়ের জ্বরের পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট ছিল৷
হাসপাতাল সূত্র অনুযায়ী, দ্রুত চিকিৎসা শুরু হলেও তরুণীকে বাঁচানো যায়নি৷ কয়েকজন নারী চিকিৎসক অক্সিজেন দেন রোগীকে, অন্যান্য উপায়ে চেষ্টা করা হলেও কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান৷
মৃত্যুর পর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন মৃতার পরিজনেরা৷ তারা চড়াও হন মৃতার চিকিৎসায় যুক্ত চিকিৎসকদের উপর৷ তিন নারী চিকিৎসককে নিয়ে টানাটানি করতে থাকেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা৷ তাদের সঙ্গে থাকা প্রায় ১৫-২০ জন ঢুকে পড়েন ফিমেল মেডিসিন ওয়ার্ডে৷ নার্স, ওয়ার্ড বয়দের গায়ে হাত তোলা হয় বলে অভিযোগ৷
ঘটনার সময় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন চিকিৎসক ও নার্সরা৷ চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে রোগীর পরিজনেরা ক্ষোভ জানাতে থাকেন৷ শাসানি দেয়া হয় বলেও অভিযোগ৷ ‘আর একটা আরজি কর ঘটিয়ে দেয়া হবে' বলে হুঁশিয়ারি দেয়া হয়৷
হাসপাতালের একাধিক সিসিটিভি ফুটেজে কয়েকজন বহিরাগতকে দেখা গিয়েছে৷ নার্সের গায়ে হাত দেয়ার দৃশ্য উঠে এসেছে৷ সব জায়গায় সিসিটিভি না থাকায় ঘটনার পুরো ছবি পাওয়া যাবে না বলে জানান স্বাস্থ্যকর্মীরা৷ এই ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
মৃতার পরিবারের অভিযোগ, রোগীকে ইসিজি করতে নিয়ে যাওয়া হলেও অপেক্ষা করতে হয়৷ চিকিৎসক আসেননি৷ ততক্ষণে রঞ্জনার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয়৷ গাফিলতি না হলে রোগীকে বাঁচানো যেত৷
এই অভিযোগ খারিজ করে সাগর দত্ত মেডিক্যালের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম প্রধান বলেন, ‘‘চিকিৎসকরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন৷ রোগীকে মৃতপ্রায় অবস্থায় আনা হয়েছিল৷ এখানে কোনো ভগবান নেই যে, তিনি প্রাণে বাঁচাবেন৷ চেষ্টা করার পরও এই অভিযোগ ওঠা দুর্ভাগ্যজনক৷''
কর্মবিরতিতে চিকিৎসকেরা
এই ঘটনার পরই সাগর দত্ত হাসপাতালের চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন, তারা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করবেন৷ শনিবার থেকে কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন তারা৷ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে জুনিয়র চিকিৎসকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন৷
৯ আগস্ট তরুণী চিকিৎসকদের দেহ উদ্ধার হয় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে৷ এর ৫১ দিনের মাথায় সাগর দত্ত মেডিক্যালের ঘটনা৷ চিকিৎসকদের প্রশ্ন, সাত সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও কেন হাসপাতালে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা গেল না?
গত ১৬ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আর জি করের জুনিয়র চিকিৎসকদের চূড়ান্ত বৈঠক হয়৷ তারপর মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, সব সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে৷ মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটির কথা বলেন তিনি৷
প্রশাসনিক স্তরে উদ্যোগ শুরু হলেও সরকারি হাসপাতালের নিরাপত্তা এখনো ঢিলেঢালা৷ পুলিশ ক্যাম্প সব হাসপাতালে থাকলেও তাতে চিকিৎসকরা সুরক্ষিত বোধ করছেন না৷ সাগর দত্ত হাসপাতালে পুলিশের সামনেই নিগ্রহের শিকার হন নারী চিকিৎসক ও নার্সরা৷ প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশের বাধা পেরিয়ে কীভাবে ফিমেল মেডিসিন বিভাগে পৌঁছে গেল বহিরাগতরা?
শনিবার সাগর দত্ত মেডিক্যালে কলেজ কাউন্সিলের বৈঠক হয়৷ স্বাস্থ্য সচিব বৈঠকের পর আশ্বাস দেন, নিরাপত্তা বাড়ানো হবে৷ এদিন থেকে হাসপাতালে আড়াইশো সিসিটিভি বসানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷
এদিন স্বাস্থ্য সচিব সাগর দত্তে পৌঁছলে তাকে ঘিরে বিক্ষোভ করেন জুনিয়র চিকিৎসকরা৷ সেখানে পৌঁছন আর জি করের আন্দোলনরত চিকিৎসকরা৷
এদের অন্যতম অনিকেত মাহাতো বলেন, ‘‘শুধু আর জি কর নয়, রাজ্যের সব মেডিক্যাল কলেজ একসঙ্গে রয়েছে৷ সরকার তার প্রতিশ্রুতি মতো পদক্ষেপ নিক, নইলে আন্দোলন আরো তীব্র হবে৷ সাগর দত্ত মেডিক্যালের পাশাপাশি সব কলেজে আতঙ্কমুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে, থ্রেট কালচার শেষ করতে হবে৷’’
শুক্রবার এই চিকিৎসকরা গণ কনভেনশনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, প্রতিবাদের মধ্যেই এবারের দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হবে৷ ৩ অক্টোবর মহালয়ার দিন মহামিছিল আয়োজিত হবে৷ তার আগে ৩০ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টে আর জি করের ধর্ষণ ও খুনের মামলার শুনানি৷ সেদিনও পৃথক কর্মসূচি নেয়া হয়েছে৷
এমনই প্রতিবাদের আবহে সাগর দত্তে আক্রমণের মুখে পড়লেন নারী চিকিৎসকরা৷ এই হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসক মনোজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ক্যামেরার সামনে ও আড়ালে আমাদের অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয় না৷ তাই দিনের পর দিন আমাদের পরিস্থিতির সঙ্গে আপোস করতে হয়৷ ২০১৯ সালে একবার সরকারের সঙ্গে কথা হয়েছিল, কিছুদিন ঠিকঠাক চলার পর একই অবস্থা৷ এর স্থায়ী সমাধান করতে হবে৷’’
নার্সেস ইউনিটি-এর সাধারণ সম্পাদক ভাস্বতী মুখোপাধ্যায় বলেন,‘‘সুপ্রিম কোর্ট যতই নির্দেশিকা দিক, প্রশাসন যতই ভালো ভালো কথা বলুক, হাসপাতালের নিরাপত্তা যেখানে ছিল, সেখানেই আছে৷ নিরাপত্তারক্ষী, সিসিটিভি, গেট বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কাজ এখনো হয়নি৷ এটাই প্রমাণ করল সাগর দত্ত মেডিক্যালের ঘটনা৷ সব কলেজে একটা ঘটনা ঘটলে তারপর যদি পদক্ষেপ নেয়া হয় তা হলে মুশকিল৷’’