ফুল যখন প্রতিবাদের হাতিয়ার

গত ২৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর পুনর্নির্বাচনের প্রতিবাদে রাজধানী মিনস্ক জনতার প্রতিবাদে৷ প্রতিবাদী জনতার ওপর পুলিশ হামলা চালালে আরো বাড়তে থাকে ক্ষোভ৷ বেলারুশের নারীদের দেখা যায় সাদা পোশাক ও হাতে ফুল নিয়ে মিছিল করতে৷ রাজধানীর পথে ফুল হাতে মানববন্ধন করে শান্তির বার্তা দেন তারা৷

টানা পাঁচ দশক ধরে পর্তুগালে ছিল সামরিক শাসন৷ বিরুদ্ধ মতের ফলে সেন্সরশিপ বা নাগরিকদের ওপর অসহনীয় অত্যাচার ছিল তৎকালীন নেতৃত্বের দৈনন্দিন চর্চার অংশ৷ ১৯৭৪ সালে সামরিকবাহিনীর ভেতর থেকেই ওঠে প্রতিবাদী স্বর৷ কোনো ধরনের খুনোখুনি ছাড়াই বদল আসে পর্তুগালে৷ তৃতীয় পর্তুগিজ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এই বিপ্লবের উদযাপন করতে পর্তুগিজরা বেছে নেন লাল কার্নেশন ফুল৷

টিউনিশিয়ার জাতীয় ফুলের নামেই এই বিপ্লবের নামকরণ৷ ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিবাদী জনতার চাপে রাষ্ট্রনেতা জিনে এল আবিদিন বেন আলি ক্ষমতাচ্যুত হন৷ ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা এই শাসক পরে বিক্ষোভকারীদের চাপে সৌদি আরবে পালিয়ে যান৷

টিউনিশিয়ার অভ্যুত্থানের পর একে একে আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে বিপ্লবের আঁচ৷ মিশর, সিরিয়া, লিবিয়ার পাশাপাশি উত্তর আফ্রিকার কিছু দেশেও দেখা যায় এই ধারা৷ অন্যান্য দেশেও সরকার পতন হয় অনেকটা টিউনিশিয়ার ধাঁচেই৷ সব জায়গাতেই দেখা যায় ফুলের ব্যবহার৷

একাধিক গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে আজও গৃহযুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়৷ এই ছবিটি ২০১৩ সালে গৃহযুদ্ধের চরম পরিস্থিতির সময়ের৷ সিরিয়ান কুর্দিশ পপুলার প্রোটেকশান ইউনিটসের এক যোদ্ধার বন্দুকে গোঁজা আছে গোলাপ, যা যুদ্ধবিরতির প্রতীক৷ কিন্তু সাত বছর কেটে গেলেও যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই সিরিয়ায়৷

আরব অভ্যুত্থান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১১ সালে চীনেও শুরু হয় গণতন্ত্রকামী বিক্ষোভ৷ অংশগ্রহণকারীরাও টিউনিশিয়ার আদলে হাতে তুলে নেন জুঁইফুল৷ এর উত্তরে চীনা কর্তৃপক্ষ নিষিদ্ধ করে জুঁইফুল বিক্রি৷ শুধু তাই নয়, ইন্টারনেটে ’জুঁইফুল’ লিখে সার্চ করার ওপরেও জারি হয় নিষেধাজ্ঞা৷

২০০৩ সালে গোলাপ বিপ্লবের কারণেই জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট এডুয়ার্ড শেভার্দনাদজে গদি ছাড়েন৷ শেভার্দনাদজের বিরুদ্ধে সেই সময় একটি স্লোগান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল, যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘‘আমাদের শত্রুর গায়েও আমরা বুলেটের বদলে গোলাপ ছড়াবো৷’’

২০০৫ সালে নির্বাচনের পর কিরগিজস্তানের রাষ্ট্রপতি আকায়েভের অপসারণের দাবিতে প্রতিবাদের ঢল নামে৷ আকায়েভের বিরোধী গোষ্ঠীর প্রতীক টিউলিপ হয়ে ওঠে প্রতিবাদেরও প্রতীক৷ ২০১০ পর্যন্ত অচলাবস্থা চলার পর কিরগিজস্তান একটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ তবুও থামেনি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ও অন্যভাবে মতপ্রকাশকে বাধা দেয়ার চেষ্টা৷

শুধু ফুলের রঙের সাথে সামঞ্জস্য রেখেও বেশ কয়েকটি বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের নামকরণ হয়েছে সোভিয়েত-পরবর্তী দেশগুলিতে৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইউক্রেনের কমলা বিপ্লব (কমলা রঙ, ফল নয়)৷ এর আগে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্সাপটে অ্যামেরিকায় ফুল হাতে পথে নামে হিপিরা৷ অন্যদিকে, লাল গোলাপ ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সোশাল ডেমোক্র্যাটদের পছন্দের প্রতীক৷

প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে ফুল সব সময় যে প্রতিবাদীদের হাতেই উঠবে, তা ঠিক নয়৷ ২০১৩ সালে থাইল্যান্ডে উল্টো চিত্র৷ প্রতিবাদীদের শান্তির বার্তা দিতে পুলিশকর্মীরা বিক্ষোভকারীদের লাল গোলাপ দেন৷ কিন্তু একদিকে সরকারপক্ষে থাকা ‘লাল শার্ট’ গোষ্ঠী ও বিরোধী মতের ‘হলুদ শার্ট’ গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব চলমান থাকতে থাকতেই সামরিক বাহিনীর হাতে যায় শাসন ক্ষমতা৷ ২০১৪ সাল থেকেই এরপর জারি থাকে সামরিক আইন৷ প্রতিবাদ হয় ব্যর্থ৷