ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ
৩ এপ্রিল ২০১২ঘটনার গতিপ্রকৃতি বুঝতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে সেই ১৮৩৩ সালে৷ আর্জেন্টিনার দাবি, কলোনিয়ালিজম বা সাম্রাজ্যবাদের সেই রাম রাজত্বে ব্রিটেন তাদের ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নিয়েছিল৷ দেড়শো বছর ধরে সেই দখলদারি চলে আসছে৷ ৩০ বছর আগে, ১৯৮২ তে ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচার'এর শাসনামলে ফকল্যান্ড উদ্ধারে একটা বিদ্রোহের চেষ্টা হয়েছিল বটে, তবে সে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়৷ সোমবার সেই বিদ্রোহের বর্ষপূর্তিতে নতুন করে শুরু হয়েছে ব্রিটেনের ওপরে চাপ৷
কীরকমের চাপ? হাতে না মেরে ভাতে মারার চাপ দেওয়া শুরু করেছে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা ফার্নান্ডেজ'এর সরকার৷ দেশজুড়ে অসংখ্য জাতীয়তাবাদী মিছিলের পরিকল্পনা করেছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ফার্নান্ডেজ৷ প্রেসিডেন্টের একটি ভাষণেও নতুন করে আর্জি জানানো হয়েছে ব্রিটিশ সরকারের কাছে৷ লক্ষ্য, ফকল্যান্ডের হস্তান্তর৷ আর অন্য দিক দিয়েও চলছে নানারকমের বাণিজ্যিক চাপের পালা৷
বাণিজ্যিক চাপ বলতে আর্জেন্টিনার কর্মী ইউনিয়নগুলির নেতাদের সিদ্ধান্ত৷ তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন, আর্জেন্টিনায় ব্রিটিশ মালবাহী জাহাজের মাল খালাস করবে না কর্মীরা৷ সাম্প্রতিক অতীতে ফার্নান্ডেজ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রীরা হুঁশিয়ারি শুনিয়েছেন আর্জেন্টিনায় ব্যবসা করা বা বিনিয়োগ করা ব্রিটিশ সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে৷ বলা হয়েছে, ফকল্যান্ডের যাবতীয় ব্রিটিশ সংস্থাগুলিকে আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে৷ তৈরি করা হবে এমন আইনি জটিলতা, যে তাদের সেদেশ থেকে পাততাড়ি গোটানো ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা থাকবে না৷ আর বাণিজ্যে ঝামেলা পাকালে সেটা তো হাতে না মেরে ভাতে মারার চেষ্টা অবশ্যই৷
এদিকে রাজধানী বুয়েনস আইরেস আর্জেন্টিনার বামপন্থী দলগুলি একজোটে একটি প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেছে৷ দাবি, সেই ফকল্যান্ডের হস্তান্তর৷ রাজধানীর ব্রিটিশ দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ বিক্ষোভের সেই বামপন্থী জমায়েতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের তীব্র নিন্দাধ্বনি শোনা গেছে৷ ছেড়ে কথা বলছেন না আর্জেন্টিনা এবং ল্যাটিন অ্যামেরিকার নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীরাও৷ সম্মিলিতভাবে তাঁদের অভিযোগ, ব্রিটেন ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে সেনা সমাবেশ করে যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে৷
কী বলছে ব্রিটেন? লন্ডনের বক্তব্য, আলোচনা বা বোঝাপড়ার কোন জায়গাই নেই এখানে৷ ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ আসলে স্ব-শাসিত একটি ব্রিটিশ অঞ্চল৷ আর ব্রিটেনের দাবি, ফকল্যান্ডের বাসিন্দারাই স্থির করবেন তাঁদের ভবিষ্যত৷ আসলে এখানেই ব্রিটিশ সরকারের সবচেয়ে বড় চাল৷ কারণ, ফকল্যান্ডের বাসিন্দারা যে কেউই ‘ব্রিটিশ' পরিচয়পত্র হারাতে চান না, তা তারা ভালোই জানে৷ কারণ ফকল্যান্ডের দ্বীপবাসীরা সকলেই নিজেদের ব্রিটিশ বলেই ভেবে থাকেন৷
আর এখানেই সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ আর্জেন্টিনার মানুষের৷ তারা দ্বীপবাসীদের এই ব্রিটেন প্রেমকে তেড়ে গালাগাল দিচ্ছে৷ বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইট থেকে শুরু করে সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে জাতীয়তাবাদের জোয়ার৷ যাতে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের ‘জলদস্যু' থেকে শুরু করে ‘দেশদ্রোহী' পর্যন্ত আখ্যা দেওয়া হচ্ছে৷
এসবই চলছে পাশপাশি৷ একদিকে আর্জেন্টিনার মূল ভূখণ্ডে সরকারি মদতে প্রতিবাদ আন্দোলনের জোয়ার আর অন্যদিকে ফকল্যান্ডের অভ্যন্তরের বাসিন্দাদের নিজেদের ব্রিটেনের মানুষ বলে ভাবার প্রবণতা৷ ওয়াকিবহাল মহল বলছে, এই পরিস্থিতির কোনরকমের পরিবর্তনের সম্ভাবনাই নেই৷ কারণ, আর্জেন্টিনায় যতই প্রতিবাদ আন্দোলন হোক না কেন, ব্রিটেনের হাত থেকে তাদের নিজেদের ভূখণ্ড বা এই দ্বীপগুলিকে উদ্ধারের কোনরকম আশা দেখা যাচ্ছে না৷ তার অন্যতম প্রধান কারণ হল, ফকল্যান্ডের মানুষজন স্বয়ং৷ যেখানে তারাই নিজেদের ‘আর্জেন্টিনার মানুষ' বলে মনে করেনা, সেক্ষেত্রে কোন আন্দোলন এই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের থাবা থেকে মুক্ত করতে পারবে ফকল্যান্ডকে? এ প্রশ্নের উত্তর তাই অজানা নয়৷ ফকল্যান্ডের দখল ফিরে পাওয়া আর্জেন্টিনার পক্ষে সম্ভব নয়৷ তেমনই মত প্রায় সব মহলেরই৷
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়/এপি, এএফপি
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ