প্রবাসে নির্মম মৃত্যুর নিয়তি
২৯ মে ২০২০১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ কাজ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন৷ পরিসংখ্যানটি বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের৷ এটি মূলত বৈধভাবে পাড়ি জমানোদের হিসাব৷ এর বাইরেও একটি বড় অংশ বিপদ জেনেও জীবন বাজি রেখে নানা উপায়ে দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন, নিজের ভাগ্য পরিবর্তন আর পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরানোর আশায়৷ কখনো কখনো তার সলিল সমাধি হয় স্বপ্নের গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই৷
ফেব্রুয়ারিতে ভূমধ্যসাগর থেকে শরণার্থীদের বহনকারী জাহাজ ওশান ভাইকিংস নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনায় আসে৷ সেই জাহাজে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন ডয়চে ভেলের সাংবাদিক মিওদ্রাক জরিচ৷ সেখানে তিনি অন্যান্য দেশের শরণার্থীদের সঙ্গে বাংলাদেশিদেরও দেখেছেন৷ তারা হয়ত ভাগ্যবান বেঁচে গেছেন বলে৷ কিন্তু মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে, কিংবা ইউরোপ পৌঁছাতে গিয়ে অনেকেরই স্বপ্ন ডুবে যায় ভূমধ্যসাগরের নোনা জলে৷
তাদেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এমন বিপদসঙ্কুল পথে ঠেলে দেয়ার পেছনে আছে দেশি-বিদেশি পাচার চক্র৷ দিনের পর দিন এমন ঘটনা ঘটে চললেও তাদেরকে বাগে আনতে পারছে না বা আনার চেষ্টা করছে না সরকারগুলো৷ মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে তাদের সঙ্গে প্রশাসন কিংবা নীতিনির্ধারকদের জড়িত থাকার প্রমাণও মিলেছে৷
বেশ কয়েক বছর আগে দেশটির জঙ্গলে গণকবরের সন্ধান মিলে৷ পাচারকারীদের আস্তানা থেকে বহু মৃত্যুপথযাত্রী বাংলাদেশিদের সেই সময় উদ্ধারও করা হয়৷ সেই খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে বেশ আলোড়ন তুলেছিল৷ কিন্তু এরপরও একই পথে মানব পাচার ঠিকই চলছে৷ পাচারকারীদের থামাতে পারেনি মালয়েশিয়া, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও৷
সবশেষ লিবিয়ায় ২৬ জন বাংলাদেশির নিহত হওয়ার একটি খবর এসেছে গণমাধ্যমগুলোতে৷ তার পেছনেও রয়েছে পাচারের ঘটনা৷ এক মানবপাচারকারী এর আগে সেখানকার অভিবাসীদের হাতে খুন হয়েছিলেন৷ তার বদলায় পরিবারের সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স৷ বিষয়টি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও৷
বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর ঘটনা এখন অনেকটাই যেন মামুলি হয়ে গেছে৷ যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ সালে এক বছরে শুধু মালয়েশিয়াতে ৭৮৪ জন বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করেছেন৷ গত দশ বছরে বিদেশ থেকে মোট ২৬ হাজার ২৫৮ জনের লাশ ফিরেছে৷ ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে ১০০৮, কুয়েত থেকে ২০১, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২২৮, বাহরাইন থেকে ৮৭, ওমান থেকে ২৭৬, জর্ডান থেকে ২৬, কাতার থেকে ১১০, লেবানন থেকে ৪০ সহ মোট তিন হাজার ৫৭ জনের লাশ দেশে ফিরেছে৷
অন্য একটি দেশে নাগরিকের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে স্বভাবতই ভুক্তভোগীর দেশের পক্ষ থেকে বড় ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতা হওয়ার কথা৷ তার নাগরিকের মৃত্যুর জন্য ঐ দেশের সরকার বা কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতা চাওয়াই স্বাভাবিক৷ কিন্তু বাংলাদেশের সরকার এক্ষেত্রে বরাবরই যেন উদাসীন৷ সেটি আমরা গত বছর সৌদি আরবে একের পর এক নারী শ্রমিকের মরদেহ ফেরত আসার পরও উপলব্ধি করেছি৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তাদের উপর চালানো নির্যাতনের ঘটনাকে সেসময় অতিরঞ্জিত হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত৷ আর ‘সৌদি আরব থেকে ৫৩ নারীর মরদেহ ফিরেছে, যা খুবই কম' নভেম্বরে সংবাদ মাধ্যমের কাছে এমন মন্তব্য করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী৷
প্রবাসে মৃত্যুর ঘটনায় সরকারের এমন বক্তব্য এবারই প্রথম নয়৷ ২০১৪ সালে গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ১৪ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের লাশ ফিরেছিল দেশে৷ এই তথ্য নিয়ে সেসময় আলোচনা হয় জাতীয় সংসদেও৷ সেই সময়কার প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সংসদে তখন বলেছিলেন, মৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের চেয়েও কম (সূত্র: ১২ ফেব্রুয়ারি, প্রথম আলো)৷ সে কারণেই বিভিন্ন দেশের পাচারকারীরা কিংবা কর্মদাতারাও হয়তো জেনে গেছেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের মেরে ফেললে সরকারের কিছু যায় আসে না৷
গত বছরের নভেম্বরের ছবিঘরটি দেখুন...