প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মাত্র ১৫ মিনিট!
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯১৯৭৫ সালে বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের প্রায় সকলকে হারান শেখ হাসিনা৷ জার্মানিতে অবস্থান করায় নিজে প্রাণে বেঁচে গেলেও, তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় তাঁর জীবনসংগ্রাম, তৈরি হয় মুজিবকন্যার সরাসরি রাজনীতিতে আসার পটভূমি৷
আপনি বলবেন, এ আর নতুন কী? এ গল্প তো সকলেই জানে৷ কিন্তু ১৯৭৫ সালের সেই কালো রাত আমার জন্য শুধু একটা ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, এমন এক সত্য, যা আমার জন্ম এবং পরবর্তীতে গোটা জীবনে তমস বয়ে এনেছিল৷
বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয়, তখন আমি মায়ের পেটে, বাংলাদেশে আমার মামা বাড়িতে৷ সেখানেই আমার জন্ম হওয়ার কথা৷ কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হওয়ায়, আট মাসের পেট নিয়ে মাকে চলে যেতে হয় কলকাতায়৷ আর সারা জীবনের মতো বাংলাদেশের থেকে আমি দূরে সরে যাই৷ আমার পরিচয় হয়ে যায়, ‘ভারতীয়’৷ বছরে প্রায় তিন মাস করে বাংলাদেশে কাটানোর পরও আমি সেই ‘অনাত্মীয়ই’ থেকে যাই৷
২০০৫ সালে আমি যখন ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগে যোগ দেই, তখনও সকলে আমায় ‘ভারতীয়’ বলে ‘একঘরে’ করে রাখে৷ এমনকি বছর কয়েক পর বাংলা বিভাগের প্রধান হওয়ার পরও, আমার সেই ‘ভারতীয় অপবাদ' ঘোচে না৷ দাদু বিধুভূষণ সেন, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, রাধিকা রঞ্জন গুহ, জেঠু দেবপ্রসাদ, রণজিৎ গুহ, বাবা প্রদীপ কুমার গুহ, বড়মামা বিধায়ক সেন, ছোটমামা বিনায়ক সেন – পরিবারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যত আপনজনই থাকুন না কেন, আমি সেই অ-বাংলাদেশিই থেকে যাই৷
তারপরও বাংলাদেশের মাটিকে, সেখানকার মানুষকে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে আমার বরাবরই আপন মনে হতো, আজও হয়৷ নটরডেম কলেজে পড়াশোনা করা আমার বাবা বলতেন, ‘‘মহানগরী কলকাতা না ছাই, আমাদের ঢাকায় জানিস সংসদ ভবনের সামনে আস্ত একটা বিমান ল্যান্ড করতে পারে!’’ ছোটবেলার সেই ঢাকা শহর আসলেই ভারি সুন্দর ছিল৷ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার গাছ, ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি, বসন্ত উৎসবের রঙিন আসর, রবীন্দ্র-নজরুল – আমাকে সবসময়ই টানতো৷ যেমন টানতেন শেখ হাসিনা, অনেকটা জন্মসূত্রেই৷
আমি যখন ডয়চে ভেলেতে কাজ করা শুরু করি, তখন বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন কণ্ঠসৈনিক আব্দুল্লাহ আল-ফারূক৷ ফারূক ভাই একদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকারের একটা ছবি দেখালেন৷ খুব সম্ভবত সে সময় এরশাদ ছিলেন ক্ষমতায়৷ হাসিনা জার্মানিতে এসেছিলেন৷ উজ্জ্বল কটা চোখের শাড়ি পরা ছিপছিপে এক তরুণী৷ দেখে ভারি অবাক হয়েছিলাম৷ ঠিক করেছিলাম, একদিন আমিও তাঁর সাক্ষাৎকার নেবো৷
এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে৷ আমি বাংলা বিভাগের পর দক্ষিণ এশিয়া, তারপর গোটা এশিয়ার দায়িত্ব পেয়েছি৷ কিন্তু শেখ হাসিনার নাগাল পাইনি৷ তাই হাসিনা টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার পর ভাবলাম– এই সুযোগ, অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগে আমাকে নিতে হবে, হবেই৷
চেষ্টা শুরু হয়ে গেল৷ চিঠি পাঠালাম পিএমও-র অফিসে৷ ফলো-আপ করার জন্য লাগিয়ে দিলাম আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশিদ স্বপনকে৷ একটা একান্ত সাক্ষাৎকার যে আমার চাই-ই চাই৷
এ কথা শুনে ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোলও বলে বসলেন, ‘‘আমিও হাসিনার সাক্ষাৎকার নেবো৷’’
সুযোগও এলো অচিরেই৷ প্রধানমন্ত্রী রাজি হলেন৷ কিন্তু স্বয়ং প্রধান সম্পাদক ইচ্ছেপ্রকাশ করেছেন, তাই ইংরেজিতে সাক্ষাৎকারটা তো তাঁকেই করতে দিতে হয়৷ তা সেভাবেই সব ঠিক করা হলো৷ সব মিলিয়ে আমরা ঘণ্টাখানেক সময় পাবো৷ আধ ঘণ্টা ইংরেজি আর আধ ঘণ্টা বাংলার জন্য৷ ইনেস করবে ইংরেজিতে আর আমি বাংলায়৷
লোকাল ক্যামেরা টিম ঠিক করে ফেললো হারুন উর রশিদ স্বপন৷ সে-ই প্রডিউসার, এছাড়া তিনটে ক্যামেরা, ক্যামেরাম্যান, সাউন্ডের লোক, মেকআপ ম্যান, স্টিল ফটোগ্রাফার – সব মিলিয়ে আমাদের প্রায় ১৬ জনের একটা দল ৯ই ফেব্রুয়ারি সাত সকালে পৌঁছে গেলাম গণভবনে৷
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর সবরকম সিকিউরিটি চেকের পর ভেতরে গেলাম আমরা৷ হাতে বেশি সময় নেই৷ তাই সবকিছু সেট করতে সাজ সাজ রব পড়ে গেল৷ ঘরটা দারুণ৷ পিছনে বঙ্গবন্ধুর ছবি, সামনে হাসিনা আর যিনি সাক্ষাৎকার নেবেন তাঁর বসার জন্য চেয়ার৷ সব নিখুঁত৷ হাসিনার প্রেস সেক্রেটারি ইহসানুল করিম, অ্যাডিশনাল প্রেস সেক্রেটারি মো. নজরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, পুলিশের মো. ইসমাইল হোসেন, পিএমও অফিসের নতুন সংযোজন ফরহাদ শাহ আলী – একে একে সকলে এসে আমাদের সঙ্গে আলাপ করে গেলেন৷
সাড়ে দশটা বাজে৷ আমরা তৈরি৷ প্রধানমন্ত্রী ঢুকলেন এগারোটার কিছুক্ষণ আগে৷ ডয়চে ভেলের লোগোর মতো নীল রঙের শাড়িতে৷ জানালেন, এক ঘণ্টা নয়, ৫০ মিনিট সময় দেবেন আমাদের৷ যা-ই হোক, ইন্টারভিউ শুরু করলো ইনেস পোল৷ সব ভালোই চলছিল৷ কিন্তু হঠাৎই প্রডিউসার বললো, ‘‘দিদি, ম্যাডামের শাড়িতে মাইক্রোফোন লেগে একটা খসখস শব্দ হচ্ছে৷’’ কী আর করা? ইন্টারভিউ থামালাম৷ প্রধানমন্ত্রীকে বললাম সমস্যাটা৷ মাইক্রোফোনটা কে ঠিক করে দেবে? প্রধানমন্ত্রীর গায়ে হাত দিয়ে ঠিক করে দিতে সংকোচ হচ্ছিল৷ বুঝতে পেরে তিনি হাসলেন এবং নিজেই মাইক্রোফোনটা খুলে আবার লাগালেন৷
আমি থ৷ কিন্তু এ সবে আরো প্রায় মিনিট ১০ নষ্ট হয়ে গেছে৷ ইংরেজির স্বার্থে আমার ভাগ্য থেকেই সেটা কাটা পড়লো৷ ইনেসের যখন শেষ হলো, তখন আমার জন্য সাকুল্যে ১৫ মিনিট সময় আছে৷ ভাবলাম, ‘‘তাতে কী? এটাই বা কে পায়?’’
আমি এগিয়ে গেলাম৷ নিজের শাড়িতে মাইক্রোফোন গুঁজতে গুঁজতেই কথা বলতে শুরু করলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে৷ বললাম, ‘‘এই নিন, আপনার জন্য একটা উপহার আছে...৷’’
এবার অবাক হওয়ার পালা মুজিবকন্যার৷ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া আগের প্রায় সবক'টা সাক্ষাৎকারের ছবি সংগ্রহ করে একটা কোলাজ তৈরি করেছিলাম আমি৷ সবগুলো সাক্ষাৎকারই ফারূক ভাইয়ের করা৷ অত্যন্ত সাধারণ একটা উপহার৷ কিন্তু তাতে প্রথম সাক্ষাৎকারের সেই ছবিটাও ছিল৷ উজ্জ্বল কটা চোখের শাড়ি পরা ছিপছিপে সেই তরুণী – যা দেখে তিনি বলে উঠলেন, ‘‘এ ছবি আপনি কোথায় পেলেন?’’
আমি হাসলাম৷ এরপর আমাদের দু'জনের মধ্যে, বাংলাদেশের সঙ্গে আমার এতদিনের সমস্ত দূরত্ব যেন নিমেষেই ঘুচে গেল৷ বঙ্গবন্ধুকন্যা আমায়, আর তার সঙ্গে ডয়চে ভেলেকে যেন আপন করে নিলেন৷ বলতে শুরু করলেন ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের কথা৷ বললেন, ‘‘সেদিন যখন আমার গোটা পরিবারকে হত্যা করা হয়, তখন আমি আর আমার বোন রেহানা জার্মানিতে ছিলাম৷ তারপর থেকে আমাদের সঙ্গে জার্মানির একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে৷ আজকে ভালো লাগছে আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পেরে৷’’
আমার হাতে সময় কম৷ তাই ইনেস যেসব প্রশ্ন ইতিমধ্যেই ইংরেজিতে করেছেন, সেগুলো বাদ দিলাম তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে৷ প্রফেশনালিজমকে তো ধরে রাখতে হবে! তাই প্রশ্ন রাখলাম নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ, বিরোধী দল প্রায় না থাকায় সংসদে ভারসাম্যহীনতা, একদলীয় শাসন কায়েমের আশঙ্কা, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন ও ভারতের অবস্থান, মধ্যবর্তী পরিকল্পনা, শরণার্থীদের কর্মসংস্থান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে বাংলাদেশের আশা, দেশের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলার সমাধানসূত্র আর হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রফেসরিয়াল ফেলোশিপ’ নিয়ে৷
আপনারা হয়ত বলবেন, অনেক প্রশ্ন যে বাদ থেকে গেল৷ গেল তো! বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতি নির্মূলের কৌশল, আইসিটি ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অপব্যবহার, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, তিস্তা চুক্তি – এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা – কিছুই জানা হলো না...৷
প্রধানমন্ত্রী অবশ্য ধীরে ধীরে ধৈর্য্য সহকারে আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন৷ এমনকি মাইক্রোফোন খুলতে খুলতেও গল্প করে গেলেন৷ ব্লগার হত্যার বিচার প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘রাজীব হত্যার যেমন বিচার হয়েছে, তেমনই অন্য সমস্ত হত্যার বিচার হবে৷’’ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যাশা কী জানতে চাইলে হাসতে হাসতেই বললেন, ‘‘আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর রেখে কী লাভ?’’
আরো কত কী বললেন হাসিনা৷ এমনকি বঙ্গবন্ধুর দু-দু’টি ইংরেজি বই এক কথাতেই আমার মানসসন্তান আগামীর নামে সই করে দিলেন৷ আমি যে ন'টা বিভাগ চালাই, সাতটা ভাষায় কথা বলতে পারি – এসব শুনে আমায় বাংলাদেশে এসে, বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে বললেন৷ আদর করে কাছে টেনে নিলেন৷ জানালেন, ইন্টারভিউয়ের পর আমরা যাতে শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ও বঙ্গবন্ধু জাদুঘরটি ঘুরে দেখতে পারি, তার ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছেন৷ তাই সাংবাদিক হিসেবে বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাবান এই নারীর বিষয়ে আমার মনে যত ক্ষোভ, যত সমালোচনাই থাকুক না কেন, তাঁর ব্যবহার, তাঁর সঙ্গে কাটানো ১৫টা মিনিটই আমার কাছে বড় একান্ত মনে হলো৷ বাঙালির স্বভাবসুলভ একটি প্রণাম এই ‘যোদ্ধা'র প্রাপ্য বলে মনে হলো৷ করলাম৷ আর ঠিক করলাম, আলাপ যখন হলো তখন একটা পুর্ণাঙ্গ ইন্টারভিউ আমি একদিন নিশ্চয়ই নেবো৷ কিন্তু ইংরেজি সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে হাসিনা যে বলেই দিয়েছেন, এটাই তাঁর শেষ টার্ম! পাঁচ বছর পর তিনি হয়ত আর রাজনীতি করবেন না! তাহলে? এটাই আমার তাঁর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ হয়ে যাবে না তো?
দেবারতি গুহ’র এই লেখাটি আপনাদের কেমন লাগলো লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷