প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর: বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী?
৬ অক্টোবর ২০১৯‘‘তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে সুস্পষ্ট কোন প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি৷ উল্টো ফেনী নদীর পানি তুলবে ভারত৷ সেটা যতটুকুই হোক৷ এগুলো দেশের মানুষ ভালোভাবে নেয় না৷ ফলে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে৷ সেটাই স্বাভাবিক৷'' ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন৷
প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে কী পেল বাংলাদেশ? এমন প্রশ্নের জবাবে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘যে চুক্তিগুলো হয়েছে সেগুলো ভালো৷ কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, আমাদের যেগুলো জীবন মরণ সমস্যা, সেগুলো যদি না পাই তাহলেতো প্রশ্ন উঠবেই৷ তিস্তা নিয়ে কোনো অগ্রগতি নেই৷ রোহিঙ্গা ইস্যুতে শক্তভাবে পাশে দরকার ভারতকে৷ এনআরসি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী আশ্বস্ত করলেও তাঁর মন্ত্রীরা প্রতিনিয়তই হুমকি দিচ্ছেন৷ এগুলোর সুরাহা হওয়া দরকার৷ পাশাপাশি সাবরুমের মানুষের খাবার পানির সংকট সেটা পূরণ হোক৷ আমাদের দাবিওতো পূরণ হতে হবে৷''
দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর বাংলাদেশ-ভারত সাতটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছে৷ এগুলোর মধ্যে আছে, ফেনী নদী থেকে এক দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত৷ ওই পানি তারা ত্রিপুরার সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে৷ উপকূলে সার্বক্ষণিক মনিটরিং ব্যবস্থার (কোস্টাল সারভেইল্যান্স সিস্টেম-সিএসএস) বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে দুই দেশ৷ চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর দিয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের বিষয়ে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরও (এসওপি) স্বাক্ষর হয়েছে৷ আর চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশকে দেওয়া ভারতের ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নে৷ সহযোগিতা বিনিময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে৷ এছাড়া সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বিনিময় নবায়ন এবং যুব উন্নয়নে সহযোগিতা নিয়ে দুটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে৷
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা আসলে দেখছি, ভারত বাংলাদেশের জনগনের সঙ্গে নয়, সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে আগ্রহী৷ কারণ তারা বাংলাদেশের জনগনের কোন সুবিধার কথা চিন্তা করছে না৷ এতে তাৎক্ষণিকভাবে মনে হতে পারে, তারা জিতে গেছে৷ জনগনের কাছেও হয়ত এসব বলে দু'চারটি ভোটও বেড়ে যেতে পারে৷ কিন্তু তাদেরও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও কিন্তু জনগনের কাছে এসব নিয়ে বলতে হবে৷ ফলে দেশের জনগন বা সরকার যদি মনে করে, তারা আসলে প্রতিবেশী দেশের কাছ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাহলে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সুসম্পর্কে ফাটল ধরবে৷ এক সময় হয়ত আমাদের সরকার অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরীতে অধিক মনোযোগী হবেন৷ সেটা তো ভালো হবে না৷''
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ রোববার সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেছেন, ভারতের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তিকে জনগণের কাছ থেকে আড়াল করতে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটককে গ্রেফতারের নাটক সাজানো হয়েছে৷ রিজভী অভিযোগ করে বলেন, ‘‘গত ১২ বছরে ভারতকে এই সরকার যা দিয়েছে তারপর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের কিছু কি অবশিষ্ট থাকলো? দেশ বিক্রি করে হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা প্রয়োজন৷’’ বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘‘সব দেশের প্রধানমন্ত্রীরা বিদেশ সফরে কিছু না কিছু আনতে যান৷ আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যান সবকিছু উজাড় করে দিয়ে আসতে৷’’
আরেকজন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কী পেলাম আর কী দিলাম, বিবেচনাটা এভাবে হওয়া উচিৎ নয়৷ তিস্তার পানি আমাদের প্রয়োজন৷ এটা দেশের মানুষ চায়৷ কিন্তু এটা পাচ্ছি না বলে আমরা ফেনী নদীর পানি দেব না, বিষয়টা সেভাবে দেখা উচিৎ না৷ সাবরুমের মানুষও তো আমাদের প্রতিবেশী৷ তাদের বিপদ আমরা দেখব৷ পাশাপাশি চাইব যেন আমাদের সমস্যাগুলোও সমাধান হোক৷ তবে এটাও সত্যি তিস্তা কিন্তু শুধু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নেই৷ মোদী এ ব্যাপারে অনেকবারই আগ্রহ দেখিয়েছেন৷ কিন্তু তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে তিনি চাইলেও দিতে পারছেন না৷ এটা নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে৷’’
১৯৮৭ সালের পর থেকে তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের সাথে কোনো চুক্তি নেই বাংলাদেশের৷ একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে দেশটি৷ ফলে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় পানিসংকট চলছে৷ ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরে তিস্তা পানি চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তখন ঢাকায় আসার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আসেননি, তিস্তা চুক্তিও তাই হয়নি৷ এরপর ২০১৫ সালে ঢাকা সফরকালে তিস্তার পানি দেয়া যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন মমতা৷ পরিবর্তে তিনি তোর্সা নদীর পানিবণ্টনের প্রস্তাব দেন৷