1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তিস্তা কি হাসিনার ভাগ্য নির্ধারক?‌‌

১৫ এপ্রিল ২০১৭

বছর দেড়েক পর সাধারণ নির্বাচনে যেতে হবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে৷ তিস্তার জল ছাড়া এবার আর শুকনো কথায় চিঁড়ে ভিজবে না বাংলাদেশবাসীর৷ নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে গেলে তিস্তার জলই একমাত্র ভরসা হাসিনার৷

https://p.dw.com/p/2bE7w
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman

১৯৮৩ সাল থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে৷ প্রাথমিকভাবে ঠিক হয়েছিল, ৩৯ শতাংশ জল পাবে ভারত আর ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ৷ বাকি ২৫ শতাংশ জল নিয়ে আরও আলোচনা হবে৷ তথ্য সংগ্রহ করা হবে৷ কিছু পরিমাণ জল সবসময় ছেড়ে রাখতে হবে নদীর মূল প্রবাহ বজায় রাখার জন্য৷

দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর ২০১১ সালে দুই দেশ তিস্তা চুক্তির অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছায়৷ ঠিক হয়, ৪২. দশমিক ৫ শতাংশ জল পাবে ভারত৷ ৩৭ দশমিক ‌৫ শতাংশ জল পাবে বাংলাদেশ৷ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে তিস্তাচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ তাঁর আপত্তির প্রধান কারণ ছিল, উত্তরবঙ্গের জলসংকট৷

এর ঠিক ছ'‌বছর পর ভারত সফরে আসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ কথা ছিল, এবার অন্তত তিস্তাচুক্তি নিয়ে সহমতে পৌঁছাবে ভারত-‌বাংলাদেশ৷ কিন্তু শেষমেশ এবারও তা সম্ভব হলো না৷ তিন দিনের সফর সেরে হাসিনাকে দেশে ফিরতে হলো, তিস্তা চুক্তির পরিবর্তে তোর্সা-‌বিকল্পের প্রস্তাব নিয়ে৷

তিস্তার সাতকাহন

*‌ তিস্তা নদীর উৎস ভারতের সিকিম রাজ্যে৷ উত্তরবঙ্গ হয়ে নদীটি বাংলাদেশে ঢুকেছে৷

*‌ তিস্তা অববাহিকার ৮৩ শতাংশ ভারতে, ১৭ শতাংশ বাংলাদেশে৷

*‌ তিস্তার মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৪১৪ কিলোমিটার৷ মোটামুটি ভাবে সিকিমে ১৫০ কিমি, উত্তরবঙ্গে ১২৪ কিমি এবং বাংলাদেশে ১৪০ কিমি৷

*‌ সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে যাওয়া নদীগুলির মধ্যে তিস্তা চতুর্থ দীর্ঘতম৷

*‌ তিস্তার প্লাবনভূমি বাংলাদেশের ২৭৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা৷

*‌ তিস্তার অববাহিকায় বাস করেন বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ, যা দেশের জনসংখ্যার ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ৷

*‌ শুখা মরশুমে পাঁচটি জেলার এক লাখ হেক্টর জমির চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় জলের অভাবে৷

তিস্তার জল এক ফোঁটাও গড়ায়নি৷ তিস্তার পরিবর্তে তোর্সা নদীর মমতার বিকল্প প্রস্তাব আর মোদীর শুকনো আশ্বাস নিয়ে ঢাকায় ফিরতে হয়েছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে৷ স্বভাবতই রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে ময়দানে নেমে পড়েছে বাংলাদেশের হাসিনা-বিরোধী গোষ্ঠী৷ কিন্তু হাসিনা হার মানতে চান না৷ ঢাকার ফিরে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‌‘‌তিস্তার পানি আসবেই৷ কেউ আটকে রাখতে পারবে না৷ ভারত সফর সব দিক দিয়ে সফল৷'‌'‌

প্রত্যাশিত ভাবেই সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প প্রস্তাবের বিষয়টি ওঠে৷ জবাবে হাসিনা জানান, তিনিও বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন৷ কী সেই প্রস্তাব? মমতা বলেছিলেন, তিস্তা ছেড়ে তোর্সার জল নিতে৷ হাসিনার প্রস্তাব, ‘‌‘‌তিস্তার জল বাংলাদেশকে দিয়ে অন্যান্য নদীর জল নিজের কাছেই রাখুক ভারত৷ নরেন্দ্র মোদীর আশ্বাসের কথাও দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী৷'‌'‌

হাসিনা আরও বলেছেন, ‘‌‘‌ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আমাকে বলেছেন, ‘তিস্তা চুক্তি হবেই৷ তিনি ও আমি ক্ষমতায় থাকতেই হবে৷'‌' ২০১৮ সালে বাংলাদেশে নির্বাচন৷ ভারতে ২০১৯-এ৷ তিস্তার জলের উপর মোদীর ভাগ্য নির্ভর করছে না৷ কিন্তু ভোট বৈতরণী পেরোতে তিস্তার জল লাগবেই হাসিনার৷ তাই মোদীর কথায় ইঙ্গিত স্পষ্ট, ২০১৮ সালের মধ্যেই তিস্তা চুক্তি সেরে ফেলতে চায় ভারত-বাংলাদেশ৷

কেন্দ্রীয় সরকারও তিস্তায় আরও জল কীভাবে আনা সম্ভব তা খতিয়ে দেখার কাজ শুরু করছে৷ সিকিমে তিস্তার উপর দশটি বাঁধ রয়েছে৷ সেই বাঁধ থেকে আরও জল ছাড়া যায় কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য দল পাঠানোর চিন্তাভাবনা করছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ সিকিম থেকে বাড়তি জল তিস্তায় এলে বাংলাদেশকে দেওয়ার ব্যাপারে রাজ্য সরকারের মত বদলাতে পারে৷ কারণ মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান আপত্তি হলো, তিস্তায় কোনও জল নেই৷

এদিকে, তিস্তা জটে দিল্লির শাসক দল বিজেপি মমতাকে তুলোধোনা করছে৷ বিজেপি-‌র সুরেই মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনায় সরব হয়েছে বাম-কংগ্রেস৷ অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অনুরোধ উপেক্ষা করে যেভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা জলবণ্টনের চুক্তি ফের খারিজ করে দিয়েছেন, তাতে রীতিমতো ক্ষুব্ধ কেন্দ্রীয় সরকার৷ শুধু তাই নয়, রাজ্যের স্বার্থেই মমতা বাংলাদেশকে তিস্তার জল দিতে অস্বীকার করলেও, রাজনীতি ও তৃণমূল বিরোধিতার তাগিদে এই ইস্যুতে প্রায় এক সুরে কথা বলছে বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেস৷

অধীররঞ্জন চৌধুরি

পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সবাপতি তথা মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের প্রভাবশালী সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরির কথায়, ‘‌‘‌বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৫৪টি নদীর সম্পর্ক আছে৷ তারমধ্যে তিস্তা অন্যতম প্রধান নদী৷ এমনিতেই তিস্তার জল যাচ্ছে৷ বাংলাদেশ গ্রীস্মের মরশুমে বেশি জল চায়৷ কিন্তু বাংলার কৃষকদেরও জল প্রয়োজন৷ দু'‌দেশের স্বার্থেই তিস্তাচুক্তি হওয়া জরুরি৷ সেদেশে এখন ধর্মনিরপেক্ষ সরকার আছে৷ শেখ হাসিনার সরকারই পারে বাংলাদেশে ভারত-‌বিরোধী কার্যকলাপ রুখে দিতে৷ আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা জোর করে ইতিহাস বদলাতে পারলেও কখনওই ভূগোল বদলাতে পারব না৷ জলের পরিমাণ কতটা, তা নিয়ে সমীক্ষা করা যেতে পারে৷ বাস্তবিকতা বোঝার চেষ্টা না করেই বিরোধিতা করা অহমিকা, গোঁয়ার্তুমির বহিঃপ্রকাশ৷''

তিনি আরও বলেন, ‘‌‘‌তিস্তায় এখন যে পরিমাণ জল আছে, তার নিরিখেই দু'দেশের মধ্যে জলবণ্টন চুক্তি হোক৷'‌'‌

মমতার আপত্তি প্রসঙ্গে অধীরের মত, ‘‌‘‌২০১১ সালে মনমোহন সিংও তাঁকে ডেকে নিয়ে আগাম সব জানিয়ে চুক্তি করতে চেয়েছিলেন৷ উনি তো রাজি হননি৷ এটা কোনো অহমিকা বোধ থেকে এমনটা করছেন না তো?‌ আসলে ভারতের মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো যুক্ত দেশে একটা রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে কোনও প্রধানমন্ত্রী এমন কাণ্ড করবেন না৷ তাই মুখ্যমন্ত্রী যদি বলেন, আমাকে কিছু জানানো হয়নি৷ সেক্ষেত্রে তাঁর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷'‌'‌

সুখেন্দুশেখর রায়

ওদিকে, পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূলের প্রবীন সাংসদ তথা দলের রাজ্যসভার উপনেতা সুখেন্দুশেখর রায় এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‌‘‌মুখ্যমন্ত্রী বার বার যে সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন তা হলো, তিস্তার অববাহিকায় পর্যাপ্ত জল নেই৷ তার কারণ, সিকিমে তিস্তার ওপর ১০টি জলাধার তৈরি করা হয়েছে৷ ফলে তিস্তা এখন শুকিয়ে গেছে৷ এই জল বাড়াতে হলে সঙ্কোষ নদীর সঙ্গে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার মেলবন্ধন ঘটালে সমস্যার সমাধান হতে পারে৷'‌'‌

‌তৃণমূলের এই সাংসদ আরও বললেন, ‘‌‘‌আমরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ঘর পোড়া গরুর মতো সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই৷ ১৯৯৬ সালে বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বাংলাদেশের সঙ্গে ফারাক্কায় গঙ্গাচুক্তি করেছেন৷ এর ফলে কলকাতা বন্দরে শুখা মরশুমে ৪০ হাজার কিউসেক জল পাওয়ার কথা ছিল৷ তা পাওয়া যায়নি৷ তার ফলে কলকাতা বন্দরের মৃত্যু হয়েছে৷ নাব্যতা কমে যাওয়ায় এখন আর সেখানে কোনো জাহাজ ঢুকতে পারে না৷ ফলে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা পূর্ব ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে৷ বাংলাদেশকে জল দেওয়ার ফলে ফারক্কা থেকে কলকাতা বন্দর পর্যন্ত যে ৫২টি পুর এলাকা আছে, সেখানে জলস্তর কমে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকায় আর্সেনিক থাবা বসিয়েছে৷ ‌সেই জন্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার পরিবর্তে তোর্সা, রায়ডাক, জলঢাকা-‌সহ অন্যান্য নদীর জল দেওয়ার কথা বলেছেন৷ সুতরাংএই চুক্তি করার আগে অনেক ভাবনা-‌চিন্তা করে না এগোলে পরে শুধু বাংলা নয়, দেশের পূর্বাঞ্চলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে৷''

উত্তরবঙ্গের বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় সংসদীয় প্রতিমন্ত্রী সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া অবশ্য অভিযোগ করেছেন, ‘‌‘‌বাংলাদেশকে তিস্তার জল দিতে অস্বীকার করে আন্তর্জাতিক কূটনীতির নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন মমতা৷ তাঁর মতে, ‘‌‘‌তিস্তার জল দেওয়ার বিষয়টা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়৷ এক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনেক বেশি ভাবা উচিত ছিল৷ উনি কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে যে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন তা ঠিক নয়৷'‌'‌ মোদী মমতাকে সম্মান দেখিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তিস্তা নিয়ে আলোচনা করতে অনুরোধ করেছিলেন৷ আলুওয়ালিয়া বলছেন, ‘‌‘‌সেই সৌজন্যের মর্যাদা দেননি মমতা৷ তিনি বলেন, ‘‌‘‌মোদীজি বারবার বলেন সবকা সাথ, সবকা বিকাশ৷ সেই নীতিতেই তিনি মমতাকে ডাকেন৷ কিন্তু মমতা তাঁর প্রতি সম্মান দেখাননি৷'‌'‌

মমতার সমালোচনায় সরব কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ও৷ তিনি বলেছেন, ‘‌‘‌যখন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এই তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জনসমক্ষে এই বিষয়ে তাঁর মন্তব্য প্রকাশ না-করলেই পারতেন৷ এর ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বাকি বিষয়গুলি লঘু হয়ে গেল৷'‌' মমতার সমালোচনা করেছেন সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমও৷ সেলিমের অভিযোগ, ‘‌‘‌এটা দু'টি দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক চুক্তির বিষয়৷ সেখানে বিদেশনীতি জড়িত৷ মমতার এই সিদ্ধান্তে দু'দেশের সম্পর্ক প্রভাবিত হতে পারে৷''

তিস্তা চুক্তি হাসিনার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন?

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান