পুলিশি পাহারায় পূজা স্বস্তি ফেরাতে পারবে?
১১ সেপ্টেম্বর ২০২২নিরপাত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, পুলিশ-আনসার মোতায়েন করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের বিষয়টিতেই বুঝা যায় যে, দেশে একটি আসাম্প্রদায়িক পরিবেশে পূজা উদযাপন করার বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করা যায়নি৷
গতবছর দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজার সময়ে মণ্ডপ, মন্দিরে নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে৷ আর তাই প্রশ্ন উঠে- সরকারের নিরাপত্তাব্যবস্থার ওপর কতটা আস্থা রাখতে পারছেন হিন্দু সম্প্রদায় লোকেরা৷ সেইসাথে কতটা নির্ভয়ে তারা পূজা উদযাপন করতে পারবেন সে প্রশ্নটিও সামনে এসেছে৷
এবার সারাদেশে ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে পূজার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী যা গত বছরের চেয়ে বেশি৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘‘গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আসন্ন দুর্গাপূজায় এবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো তৎপর থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে৷ এবছর পূজামণ্ডপে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা ছাড়াও ২৪ ঘন্টা আনসার বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে৷ পূজায় সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর হচ্ছে সরকার৷’’
তিনি বলেছেন, এবার পূজায় যেকোনো ধরনের গুজবের ব্যাপারে সতর্ক নজর রাখা হবে৷ বিশেষ করে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মনিটরিং করা হবে৷ কোনো ধরনের গুজব ছড়ানোকে কঠোর হাতে দমন করা করা হবে৷
তিনি বলেন, ‘‘পূজামণ্ডপে অবশ্যই সিসি ক্যামেরা থাকতে হবে৷ এমন জায়গায় পূজামণ্ডপ করা যাবে না, যেখানে গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না৷ পূজামণ্ডপের স্বেচ্ছাসেবকদের বাধ্যতামূলকভাবে হাতে আর্মব্যান্ড পরতে হবে৷’’
পূজার সময় পুলিশ সদরদপ্তর এবং জেলা পর্যায়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হবে৷ ২৪ ঘন্টা কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করা যাবে৷ থাকবে ভ্রাম্যমাণ আদালত৷ আর পোশাকি পুলিশের পাশাপাশি নজরদারির জন্য গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরাও তৎপর থাকবেন৷
রবিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে পূজার সময় আইনশৃঙ্খলা প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান৷
তিনি জানান, ‘‘আজানের সময় পূজামণ্ডপে বাদ্যযন্ত্র বাজানো বন্ধ রাখতে হবে৷’’
এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চন্দ্রনাথ পোদ্দার৷
তিনি বলেন, ‘‘আমরা আতঙ্কে থাকলেও সরকারের ওপর তো আমাদের আস্থা রাখতে হবে৷ কাউকে তো আমাদের বিশ্বাস করতে হবে৷''
নিরাপত্তার বিষয়ে সরকারের উপর আস্থা আছে জানালেও উদ্বেগের কথাও শোনা যায় তার মুখে৷
তিনি বলেন, ‘‘বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের পুলিশের পাহারায় পূজা করতে হচ্ছে৷ আমরা এমন একটা বাংলাদেশ চাই যেখানে সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে তার ধর্ম এবং উৎসব পালন করতে পারবে৷’’
তার কথা, ‘‘এরজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও মানসিকতার পরিবর্তন দরকার৷ গত বছর তো ঢাকেশ্বরি মন্দিরে পুলিশ ছিল৷ তারপরও তো কিছু উগ্রবাদী মিছিল নিয়ে মন্দিরের সামনে লাফালাফি করেছে৷’’
গতবছর পূজার সময় কুমিল্লার একটি মন্দিরে পবিত্র কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে ব্যাপক হামলা চালানো হয়৷ কুমিল্লায় অনেকগুলো মন্দির ও পূজামণ্ডপ ভাঙচুর করা হয়৷ হিন্দুদের বাড়িতেও হামলা হয়৷ আর কথিত কোরআন অবমাননার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও রংপুরেও হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়ে হামলার ঘটনা ঘটে৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘যদি কুমিল্লায় স্বেচ্ছাসেবক থাকত, তাহলে ওই ঘটনা ঘটত না৷ কুমিল্লার মণ্ডপে একজন নিরাপত্তাকর্মী ছিল৷ তাও সে মণ্ডপ থেকে অনেক দূরে বেঞ্চে রাতে ঘুমিয়েছিল৷’’
তার এই কথার জবাবে পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘‘সবখানে সিসি ক্যামেরা থাকলে ভালো হয়৷ কিন্তু বাস্তবে সেটা সম্ভব নয়৷ এখানে খরচের বিষয়ও আছে৷ কিন্তু কথা হলো সিসি ক্যামেরা, স্বেচ্ছাসেবক না থাকলে হামলা হবে এটা তো মেনে নেয়া যায় না৷ তাহলে বোঝাই যায় হামলা পরিবেশ আছে৷ আমাদের নিরাপত্তার মধ্যে থাকতে হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা সব জেলার পূজা উদযাপন কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি৷ তাদের ২১ দফা নির্দেশনা দিয়েছি৷ আমাদের দিক থেকে যতটুকু ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব, তা নিচ্ছি৷ কিন্তু মূল দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের৷’’
তার কথা, ‘‘গত পূজার সময় যে হামলা হয়েছে তার তো বিচার হয়নি৷ বিচার হলে দুর্বৃত্তরা ভয় পেত৷ কিছু মামলায় চার্জশিট হয়েছে৷ যারা ধরা পড়েছে তারা জামিন পেয়েছে৷ যারা মামলা করেছেন তারা তো উল্টো ভয়ের মধ্যে আছে৷ ফলে আমাদের আতঙ্ক কাটেনি৷’’
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাসগুপ্ত বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলছেন তার মানে হলো পুলিশ আছে, পূজা আছে৷ পুলিশ নেই, পূজাও নেই৷ এইরকম পরিস্থিতি তো আমরা চাই না৷ পুলিশ পাহারা দিয়ে যদি পূজা উদযাপন করতে হয় তাহলে পরিস্থিতি কেমন তা বোঝাই যাচ্ছে৷’’
তার অভিযোগ, ‘‘গত দুই সপ্তাহে সারাদেশে প্রতিমা ভাঙচুরের সাত-আটটি ঘটনা ঘটেছে৷ আর গত পূজার সময় হামলার পর এই এক বছর তো আর হিন্দুরা হামলার বাইরে ছিলেন না৷ হামলা তো বন্ধ হয়নি৷ নানা গুজব ছড়িয়ে তো মন্দির, হিন্দুদের বাড়ি ঘরে অনেক হামলা হয়েছে৷ তাহলে পরিবেশের তো কোনো উন্নতি দেখতে পাচ্ছিনা৷’’
তিনি বলেন, ‘‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় আমরা আশ্বস্ত হতে চাই, কিন্তু বিশ্বাস রাখতে পারছি না৷ এরকম আশ্বাস অতীতে অনেক দেয়া হয়েছে কিন্তু বাস্তবে কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি৷’’
রানা দাসগুপ্ত বলেন, ‘‘গত পূজার সময় কুমিল্লায় পরিকল্পিত হামলার পর দেশের ১০-১২ জায়গায় মন্দির, মণ্ডপ ও হিন্দুদের বাড়িতে হামলা হলো৷ দুই-একজন গ্রেপ্তারও হয়েছে৷ কিন্তু বিচার তো পাওয়া যায়নি৷ বিচার না হলে, আইনের সঠিক ও সমান প্রয়োগ না হলে তো হামলা বন্ধ হবে না৷ যারা ওই সব মামলার সাক্ষী তারা তো ভয়ে আছেন৷’’
চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার আরো বাড়তি কিছু মন্দিরে পূজার প্রস্তুতি চলছে৷ তবে শেষ পর্যন্ত কতগুলো মন্দিরে পূজা হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি৷
বাংলাদেশে ১ অক্টোবর ষষ্ঠী পূজা দিয়ে দুর্গোৎসব শুরু হবে৷ ৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে শেষ হবে৷