পাঠ্যসূচিতে থাকবেন না কবিগুরু?
৩০ জুলাই ২০১৭রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রভাবিত সংগঠন ‘শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস'-এর বক্তব্য, দশম শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে রবীন্দ্রচিন্তার উল্লেখ করে জাতীয়তাবাদ এবং মানবতাবাদের মধ্যে বিভেদ দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে৷ ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং বা এনসিইআরটি-র কাছে পাঁচ পাতার প্রস্তাব দিয়েছেন ন্যাসের প্রধান দীনানাথ বাত্রা৷ এনসিইআরটি-র বিভিন্ন শ্রেণির বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক থেকে কী কী বাদ দিতে হবে, দেওয়া হয়েছে তার তালিকা৷ তার মধ্যে আছে রবীন্দ্রনাথও৷ আপত্তি রবীন্দ্রনাথের চিন্তাদর্শ নিয়ে৷ এমন উদ্ভট প্রস্তাব শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে আপামর বাঙালি-সহ বেশিরভাগ ভারতবাসী৷
বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতেই তুমুল হইচই বেধেছে ভারতের সংসদেও৷ রাজ্যসভায় বিরোধী দলের সাংসদদের অভিযোগ, ‘‘আজ পাঠ্যবই থেকে রবীন্দ্রনাথকে ছাঁটার চেষ্টা চলছে, কাল জাতীয় সংগীত ছেঁটে দেবে সরকার৷''
বাত্রার প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করেছে সিপিএম৷ সিপিএম সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে একটি চিঠি লিখেছেন৷ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঋতব্রত জানান, ‘‘আসলে দীনানাথ বাত্রার মতো অপদার্থকে দিয়ে এইসব কুকীর্তি করানো হচ্ছে৷ স্কুল পাঠ্য থেকে শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নয়, মির্জা গালিব, কবি পাশের কবিতা বাদ দিতে হবে – এইসব সুপারিশ আগেও করেছেন দীননাথ, যা সমস্ত বাঙালি-সহ সমগ্র ভারতবাসীকে অপমানিত করেছে৷ রবীন্দ্রনাথকে অপমানের চেষ্টা বাঙালি কখনওই মেনে নেবে না৷''
প্রস্তাবে অনেক কিছু ছেঁটে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন:
● ১৯৮৪ সালের দিল্লি-দাঙ্গা নিয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০০৫ সালে জাতির তরফে সংসদে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন বলে যে উল্লেখ রয়েছে দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইয়ে, তা বাদ দিতে হবে৷
● বিজেপিকে হিন্দুত্ববাদী দল বলা হয়েছে যে অনুচ্ছেদে এবং সাভারকর ‘হিন্দুত্ববাদী' শব্দটি চয়ন করেছিলেন বলে যে উল্লেখ রয়েছে, ছাঁটতে হবে তা৷
● রামের জন্মস্থানে বাবরি মসজিদ তৈরি হয়েছিল বলে হিন্দুদের কারও কারও বিশ্বাস – এই উল্লেখ বাদ দিতে হবে৷
● গোধরার ঘটনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ট্রেনে আগুন লেগেছিল, মুসলিমরা তা লাগিয়েছিল বলে সন্দেহ৷ দাবি, ‘লেগেছিল' বলার বদলে ‘লাগানো হয়েছিল' লিখতে হবে, ‘সন্দেহ' কথাটি বাদ দিতে হবে৷
● হিন্দি পাঠ্যবই থেকে ভাইস-চ্যান্সেলর, ওয়ার্কার, পোশাক, ইলাকা, তাকত, ইমান, বদমাশ ইত্যাদি শব্দ বাদ দিতে হবে৷
● বাদ দিতে হবে গালিবের পদ্য: ‘হামকো মালুম হ্যায় জন্নত কি হকিকত লেকিন/দিল কো খুশ রাখনে কো গালিব ইয়ে খেয়াল আচ্ছা হ্যায়৷'
● বৈদিক-উত্তর যুগে মহিলাদের সাধারণত শূদ্রের তুল্য বলে দেখা হতো৷ তাই ছাঁটতে হবে এই উল্লেখ ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে৷
● বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণরা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করত....মহাভারতের মতো অনেক গ্রন্থ এই ধারণা মজবুত করেছে৷ দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে এটি বাদ দিতে বলা হয়েছে৷
● মোগল শাসকদের উদার, প্রজা দরদি হিসেবে দেখানো নিয়েও আপত্তি তোলা হয়েছে৷
রাজধানী দিল্লিতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চায় অগ্রনী ভূমিকা নেন বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক তপন সেনগুপ্ত৷ তাঁর কথায়, ‘‘বিশ্বজুড়ে ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ কবিগুরুই দেশে প্রথম নোবেল এনেছেন৷ তাছাড়া জাতীয় সংগীত রচয়িতাকে অসম্মান করে গোটা দেশকে অপমান করা হচ্ছে৷ এমন অপচেষ্টার আঁচ পেলেই আমরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ব৷''
‘শিক্ষা সংস্কৃতি উত্থান ন্যাস'-এর মাথায় আছেন সংঘের তাত্ত্বিক নেতা দীননাথ বাত্রা৷ আরএসএস-এর শাখা বিদ্যাভারতীর শীর্ষে ছিলেন আগে৷ শিক্ষা সংস্কারে বাত্রার তৎপরতা নিয়ে আগেও বিতর্ক হয়েছে৷ ন্যাসের সচিব অতুল কোঠারির কথায়, ‘‘শিশুদের দাঙ্গার কথা শিখিয়ে কী লাভ? বরং রাণা প্রতাপ, ছত্রপতি শিবাজির মতো মহান দেশনায়কদের জীবন বৃত্তান্তের কথা শেখানো উচিত৷''
গুজরাট-দাঙ্গায় প্রায় দু'হাজার মুসলিম ধর্মাবলম্বীর মৃত্যু হয়েছিল, এহেন তথ্যেও ঘোর আপত্তি সংগঠনের৷ তারা তা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে৷ রাম মন্দির নির্মাণের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যোগ আছে, এ রকম কোনো কথা থাকাও আপত্তিজনক৷
অভিযোগ, নিজেদের ইচ্ছে ও মতাদর্শ অনুযায়ী স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানের পাঠ দিতে চাইছে সংঘ৷ হাত দিতে চাইছে সাহিত্য-রুচিতেও৷ তবে মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাওড়েকর বলেছেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথকে পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়া হবে, এমন কোনো চিন্তা সরকারের নেই৷ কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান অটুট আছে সরকারের৷ তাছাড়া অশান্তি হতে পারে এমন কিছুতে সরকারের সায় নেই৷'' মন্ত্রীর এই বক্তব্য শোনার পর তাঁকে কবিগুরুর লেখা তিনটি বই উপহার দিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও'ব্রায়েন৷
বন্ধু, ভারত কি ক্রমশই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে? জানান নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷