পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালে দালাল-দুষ্কৃতীদের রাজত্ব কেন?
১৩ আগস্ট ২০২৪আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুন। এই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে। অন্য কোনো দুষ্কৃতী এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কিনা তা জানতে তদন্ত হচ্ছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসকদের সুরক্ষার পাশাপাশি হাসপাতালে অন্যান্য অব্যবস্থার কথা উঠে আসছে।
দুষ্কৃতীদের যাতায়াত
শুধু আরজি কর মেডিক্যাল নয়, অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকরা প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। মূলত নারী চিকিৎসকরা বলছেন, বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নেই।
হাসপাতালে পুলিশ মোতায়েন থাকে। থাকে সিভিক ভলান্টিয়ার বাহিনী। তা সত্ত্বেও দুষ্কৃতীদের কবল থেকে হাসপাতালকে পুরোপুরি মুক্ত করা যায়নি, এমনই অভিযোগ উঠছে বারবার।
পুলিশ থাকা সত্ত্বেও হাসপাতাল যে মুক্তাঞ্চল তার নজির ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ওই চত্বরে। হাসপাতালে ভিতর পাওয়া গেছে প্রচুর খালি মদের বোতল। খাস কলকাতার প্রথম সারির হাসপাতালে যদি এই ছবি হয় তাহলে জেলার কি অবস্থা
আরজি করে তরুণী চিকিৎসক খুনের প্রতিবাদ যখন চলছে, সেই সময় হুগলি জেলার একটি সরকারি হাসপাতালে কয়েকজন মদ্যপ পাকড়াও হয়েছে। উত্তরপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতাল থেকে ধরা হয়েছে নয় জনকে।
স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিযোগ, পাঁচিলের ভাঙা অংশ দিয়ে সমাজবিরোধীরা হাসপাতাল চত্বরে ঢুকে পড়ছে, সেখানেই বসছে মদের আসর। এর ফলে হাসপাতালের কর্মীদের পাশাপাশি রোগী ও তার পরিবারের সুরক্ষা নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
দালালদের বাড়বাড়ন্ত
সরকারি হাসপাতালে দালালদের রাজত্ব নতুন কিছু নয়। সর্বত্রই রোগী ও তার পরিবারকে এই দালালদের খপ্পরে পড়তে হয়।
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা মেলে। বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন আউটডোরে ভিড় করেন সাধারণ মানুষ। চিকিৎসকরা ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলে সমস্যায় পড়েন রোগীরা। সব হাসপাতালে মোট শয্যার যে সংখ্যা রয়েছে, তা রোগীর তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই কম।
এই সুযোগে রোগীর পরিবারের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করে দালালরা। যে শয্যা বিনা পয়সায় পাওয়ার কথা, তার জন্য হাজার হাজার টাকা দাবি করা হয়। অভিযোগ, হাসপাতালের কর্মীদের একাংশের সঙ্গে এই দালালদের যোগসাজশে টাকা লেনদেনের একটা বড় চক্র চলে।
এই চক্রের সামনে রোগীরা অসহায়। অথচ হাসপাতালে পুলিশ ও সিভিক ভলান্টিয়ার রয়েছে। বড় বড় করে লেখা রয়েছে দালাল সম্পর্কে সতর্কবাণী। তা সত্ত্বেও দালালরাজ বন্ধ করা যায়নি।
গত বছর উত্তর ২৪ পরগনার সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ ভর্তি হওয়ার জন্য এক রোগীর পরিবারের কাছে ছয় হাজার টাকা দাবি করেছিল দালাল। এই টাকা পরিবারের কাছে ছিল না। উপরমহলে অভিযোগ জানিয়ে, দালালদের কবল এড়িয়ে ওই রোগীকে যখন ভর্তি করা হয়, তখন তিনি মৃতপ্রায়। তাকে বাঁচানো যায়নি।
সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত শীর্ষ আধিকারিকরা এই সমস্যার কথা স্বীকার করছেন। পূর্ব বর্ধমানের উপ মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সুবর্ণ গোস্বামী বলেন, "চাহিদা যা রয়েছে, তার থেকে যোগান কম। একজন চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানকে চারজনের কাজ করতে হয়। বহু শূন্যপদ খালি পড়ে রয়েছে। তাই অপারেশন কিংবা পরীক্ষা নিরীক্ষার দিন এগিয়ে আনতে দালালদের টাকা দিতে হয়। বেকার ছেলেরা কর্মসংস্থান না পেয়ে রোজগার করতে দালাল চক্রে জড়িয়ে পড়ছে।"
চিকিৎসকদের সংগঠন মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের সেক্রেটারি ডা. অংশুমান মিত্র বলেন, "সরকারের স্বাস্থ্যনীতি এ জন্য দায়ী। স্বাস্থ্যখাতের বাজেট দ্রুত কমিয়ে আনা হচ্ছে। এর বেশিটাই চলে যাচ্ছে বিমার বিল মেটাতে। হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ সাংঘাতিক কম। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে মেডিক্যাল কলেজ পিপিপি মডেলে চলছে। মুনাফাই দেখা হচ্ছে। এসবের ফলে ভেঙে পড়ছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।"
রক্ষকই ভক্ষক?
সাম্প্রতিক ঘটনায় অভিযোগ আরো গুরুতর। একজন সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ উঠেছে। সূত্রের খবর, পুলিশি জেরায় অপরাধের কথা কবুল করেছে ধৃত।
সিসিটিভি ফুটেছে দেখা গিয়েছে, ভোররাতে চেস্ট মেডিসিন বিভাগে ঢুকেছিল ধৃত সঞ্জয় রায়। এত রাতে ওই বিভাগে ঢোকার পথে কোলাপসিবল গেট রয়েছে। সেখানে নিরাপত্তারক্ষীর থাকার কথা। কিন্তু বিনা বাধায় বিভাগের সেমিনার রুমে চলে যায় সঞ্জয়, যেখানে ঘুমোচ্ছিলেন তরুণী চিকিৎসক।
সূত্রের খবর, সঞ্জয়ের বেশ দাপট ছিল হাসপাতালে। রোগী ভর্তির ক্ষেত্রেও তার সুপারিশ কাজে লাগত। অভিযোগ, দালাল চক্রের সঙ্গে সিভিক ভলান্টিয়ারদের একাংশের যোগাযোগ রয়েছে। তারা হাসপাতালে সুব্যবস্থার বদলে আদতে দুষ্কৃতীদের সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
সিভিকদের ভূমিকা নিয়ে বারবার বিতর্ক হয়েছে। রাজ্যে পুলিশের থেকে থেকে সিভিক ভলান্টিয়ারের সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি। এই বড় বাহিনী কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই কাজ করে। পুলিশের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার আইনি বৈধতা তাদের নেই। অথচ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই সিভিকরা অভিযোগের কেন্দ্রে চলে আসছেন।
কলকাতা পুলিশের সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার বিকাশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, "সিভিক ভলান্টিয়াররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে, তার কারণ প্রশাসনিক। প্রশাসন এদের ঠিকমতো দেখছে না। এরা বেতন পায়, এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নামানো উচিত। দুইমাসের প্রশিক্ষণ দিতে পারে।"