পদ্মা সেতু উদ্বোধন: শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে জোর নিরাপত্তায়
১৯ জুন ২০২২এরই মধ্যে সেতু এলাকাসহ সারা দেশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে৷ অতিথিদের আমন্ত্রণ জানানো শুরু হচ্ছে সোমবার থেকে৷ ২৫ জুন উদ্বোধনের পরদিন ২৬ জুন সকাল ৬টা থেকে সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে৷
মোট তিন হাজার অতিথিকে উদ্বোধনের দিন আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে৷ তবে সেতুর জাজিরা প্রান্তে ১০ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটানোর পরিকল্পনা আছে৷ দুই প্রান্তেই সেতু উদ্বোধন হবে৷ ২৫ জুন সকালে মাওয়া প্রান্তে সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ সেখানে সুধী সমাবেশ হবে৷ এরপর সেতু পার হয়ে তিনি জাজিরা প্রান্তে যাবেন৷ সেখানে তিনি পদ্মা সেতু উদ্বোধন করে জনসমাবেশে বক্তৃতা করবেন৷ পদ্মা সেতু পরিদর্শনে গিয়ে সড়ক পরিবহণ এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১২ জুন বলেন, ‘‘ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতু পার হতে লাগবে অনলি সিক্স মিনিট৷''
সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শেখ ওয়ালিদ ফয়েজ সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, আমন্ত্রিত সুধীজনদের এ তালিকায় রয়েছেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, দাতা সংস্থার প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, নির্মাণ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা৷
তিনি জানান, মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশে আমন্ত্রণ পাবেন তিন হাজার সুধীজন৷ জাজিরা প্রান্তে যে জনসভা হবে, সেটা সবার জন্য উন্মুক্ত৷
সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত৷ এর কোনো কাজই এখন বাকি নেই৷ সেতু, লাইটিং, অ্যাপ্রোচ সড়ক, টোল প্লাজা সবকিছুই প্রস্তুত আছে৷ এখন শুধু ফাইন টিউনিং-এর কাজ চলছে৷ সব কিছু পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে৷
তিনি জানান, উদ্বোধনের আগেই তারা সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে সেতুটি হস্তান্তর করবেন৷ এটা উদ্বোধনের দুই-এক দিন আগে হতে পারে৷
সেতুর খরচ কতদিনে উঠবে?
মূল সেতু পুরোপুরিই বাংলাদেশের অর্থায়নে তৈরি হয়েছে৷ সেতু চালু হলে প্রতিদিন ২৭ হাজার যানবাহন চলাচলের আশা করা হচ্ছে৷ এরই মধ্যে সেতুর টোলও চূড়ান্ত হয়েছে৷ যা ফেরি পারাপারের খরচের চেয়ে বেশি বলে সমালোচনা হচ্ছে৷
পদ্মা সেতুর খরচ কতদিনে উঠে আসতে পারে তা নিয়ে সরকারি পর্যায় থেকে বিভিন্ন সময় কথা বলা হয়েছে৷ সর্বশেষ গত ১৯ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনেয়ারুল ইসলাম কথা বলেছেন৷ তিনি জানিয়েছেন, ‘‘পদ্মা সেতুর টাকা সেতু কর্তৃপক্ষকে এক শতাংশ হার সুদে সরকারকে ফেরত দিতে হবে৷ ফিজিবিলিটি স্টাডিতে যেমন ছিল যে, ২৪ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে টাকাটা (নির্মাণ ব্যয়) উঠে আসবে৷ এখন মনে হচ্ছে ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যেই টাকাটা উঠে আসবে, কারণ মোংলা পোর্ট যে এত শক্তিশালী হবে, পায়রা বন্দর হবে, এত শিল্পায়ন হবে সেগুলো কিন্তু ফিজিবিলিটি স্টাডিতে আসেনি৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘ধারণা ছিল পদ্মা সেতু এক দশমিক তিন শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি আনবে৷ এখন দেখা যাচ্ছে, এটা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দুইয়ের কাছাকাছি চলে যাবে৷''
পদ্মা সেতু নিয়ে এডিবি ছাড়াও আরো আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের গবেষণা আছে৷ সব গবেষণায়ই সর্বনিম্ন এক থেকে সর্বোচ্চ এক দশমিক আট শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে৷ আর সেতুর খরচ ২৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে উঠে আসবে বলে ধারণা করা হয়৷ কিন্তু এই সব গবেষণা যখন করা হয় তখন পদ্মা সেতু নির্মাণের সম্ভাব্য খরচ এর চেয়ে কম ছিলো৷
বাংলাদেশের জিডিপি এখন ৪১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর জিডিপির প্রবৃদ্ধি সাত দশমিক ২৫ শতাংশ৷
গবেষকরা যা বলছেন:
পদ্মা সেতুর সম্ভাব্য নির্মাণ খরচ যখন ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছিলো তখন এই খরচের উপর ভিত্তি করে এর অর্থনৈতিক দিক নিয়ে গবেষণা করে ব্র্যাকের সহায়তায় ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠান কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার৷ তাদের গবেষণার শিরোনাম ‘বেনিফিট অ্যান্ড কস্ট অব কমপ্লিটিং দ্য পদ্মা ব্রিজ'৷ এই গবেষণায় শুধু টোল আদায় নয় , পদ্মা সেতুর ফলে পুরো অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়বে তা তুলে ধরা হয়৷
তাদের গবেষণায় বলা হয় এই সেতু থেকে দুই বছরের মধ্যে প্রতিদিন ২৭ থেকে ৩০ হাজার যানবাহন চলাচল করবে৷ আর জিডিপিতে ১ থেকে ২ ভাগ অবদান রাখবে৷ এটা সময়ের সাথে সাথে বাড়বে৷ সেতুটির স্থায়িত্ব ১০০ বছর বলা হলেও তারা গবেষণায় সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৫০ বছরের হিসাব করেছে৷
গবেষণাটি করেন পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ইকোনমিস্ট ড. আশিকুর রহমান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. বজলুল হক খন্দকার৷ ড. আশিকুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন খরচ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছড়িয়ে গেলেও এর অর্থনৈতিক লাভে খুব বেশি হেরফের হবে না৷ ৩০ বছরে এর খরচ উঠে আসবে৷''
তবে তিনি মনে করেন, ‘‘কত টোল বছরে আদায় হবেসেটা মূল লাভের বিষয় নয়৷ এটার টাইম কস্ট বেনিফিট অনেক বেশি৷ নদী দিয়ে বিচ্ছিন্ন দক্ষিণাঞ্চল দেশের অন্য এলাকার সাথে সংযুক্ত হবে৷ পণ্য খুব অল্প সময়ে বাজারে আসতে পারবে৷ ব্রিজ বাদ দিলে এখন ঢাকা থেকে মোংলা পোর্ট ২৭০ কি.মি৷ কিন্তু ব্রিজের কারণে দূরত্ব কমে হবে ১৭০ কি.মি৷ এই দূরত্ব কমার ঘটনা আরো অনেক ক্ষেত্রেই ঘটবে৷ ব্রিজের কারণে দক্ষিণ পুর্বের অর্থনৈতিক কার্যক্রমও বাড়বে৷ সব মিলিয়ে ২০-৩০ বছরেই এটা লাভের মুখ দেখবে৷''
এদিকে সেতু প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘২৮-৩০ হাজার যানবাহনের হিসাব করা হয়েছিল অনেক আগে তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ট্রাফিক আরো বেড়ে যাবে৷''
পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘‘এই সেতুর তো প্রথম ফিজিবিলিটি টেস্ট করেছিলো বিশ্ব ব্যাংক৷ তারা তো এটা ভায়াবল বলেই সেতুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল৷ এখন আমার কথা হচ্ছে ফেরির চেয়ে সেতুতে সাধারণত টোল ধরা হয় দুইগুণ৷ সব দিক চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী দেড়গুণ করেছেন৷ আর টোল আদায় হবে সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে৷ আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এই ডিজিটাল পদ্ধতির কারণে প্রচলিত পদ্ধতির টোল আদায় দুইগুণ বেড়ে যায়৷ কারণ এই পদ্ধতিতে মিসইউজের সুযোগ নাই৷''
তার কথায়, ‘‘এখন পণ্য পরিবহণে সময় কম লাগবে, কানেকটিভিটি বাড়বে৷ এর একটা বড় প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে৷তাই আমার বিবেচনায় ৩০ বছরে এই সেতুর খরচ উঠে আসবে৷''