পণ্য হিসেবে বিয়ের পাত্রীর বাজার
৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭আশির দশকে বলিউডে একটা সিনেমা হয়েছিল৷ নাম বাজার৷ কাহিনিতে দেখানো হয় হায়দ্রাবাদে বিয়ের পাত্রী কীভাবে বিকিয়ে যায় পণ্য হিসেবে৷ গরিব ঘরের অশিক্ষিত মুসলিম মেয়েকে কীভাবে তুলে দেওয়া হয় ধনী বিদেশি শেখদের হাতে, শুধুমাত্র টাকার বিনিময়ে৷ কৃষ্ণা-কাবেরি দিয়ে তারপর কত জল বয়ে গেছে, কিন্তু বাস্তব ছবিটা বদলায়নি এতটুকু৷ নিকাহ বা বিয়ের নামে পণ্য হিসেবে পাত্রী বেচা-কেনা চলছে সমানেই৷ নিকাহর মোড়কে নাবালিকা পাচার হচ্ছে পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে৷ কিছু করার নেই৷ আসলে করারই বা কী আছে? কেউ অভিযোগ বা মামলা না করলে?
এবারে তা হয়নি৷ সম্প্রতি নাবালিকা এক পাত্রীর মা সাঈদান্নুসা সোজা থানায় এসে অভিযোগ করেন যে, তাঁকে না জানিয়েই তাঁর ১৫ বছরের মেয়েকে স্বামী সিকান্দার ও তাঁর ননদ ঘাউসিয়া বেগম গোপনে বিয়ে দিয়েছে ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ ওমানি শেখের সঙ্গে, তাও আবার রমজানের আগে আগে৷ দরদাম করে বিয়ের পণ্য হিসেবে পাত্রীর দাম ওঠে পাঁচ লাখ টাকা৷ পুরানো হায়দ্রাবাদ শহরের বারকাস এলাকার স্থানীয় এক হোটেলে একজন কাজিকে ভাড়া করে নিকাহ করে ঐ ওমানি শেখ আহমেদ৷ হোটেলেই দাম চুকিয়ে দেন ঐ ওমানি শেখ৷ বিয়ের পর কাজির নিকাহনামা দেখিয়ে কাগজপত্র তৈরি করে৷ কয়েকদিন পরে শেখ বৌকে নিয়ে সোজা যায় মাস্কটে৷ বিয়েতে নাবালিকাকে রাজি করাতে বেগ পেতে হয়নি৷ তাঁকে দেখানো হয় শেখের বিলাসবহুল জীবনের ভিডিও৷ গরিব ঘরের দুবেলা পেট পুরে খেতে না পাওয়া মেয়েটি রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে৷ না বলার সাধ্য কি তাঁর? এত স্বপ্ন৷ হোক না স্বামী দাদুর বয়সি৷ ভালোমন্দ খেতে পরতে তো পারবে, আরাম আয়েসে থাকতে তো পারবে৷ আর কী চাই? প্রেম-ভালোবাসা ধুয়ে কি জল খাবে? হৃদয়ের চেয়ে উদরের টান যে বড্ড বেশি৷
কিন্তু সেই স্বপ্নভঙ্গ হয় কিছুদিনের মধ্যেই৷ টেলিফোনে মেয়েটি জানায় সে ভালো নেই৷ তাকে যেন দেশে ফিরিয়ে আনা হয়৷ বৃদ্ধের সঙ্গে এক নাবালিকার বিয়ের ঘটনা কেন্দ্রীয় মহিলা ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী মানেকা গান্ধীর গোচরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হায়দ্রাবাদের পুলিশ কমিশনারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গেও কথা বলেন মানেকা গান্ধী, যাতে ঐ নাবালিকা মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনা হয় দেশে৷ জাতীয় শিশু সুরক্ষা কমিশনকে নাবালিকার পরিবারকে সাহায্য করতে বলেন মানেকা গান্ধী৷ এ তো একটা নির্দিষ্ট ঘটনা৷ এ রকম কত ঘটনা অগোচরে ঘটে যায়, কেউ তার খোঁজ রাখে না৷
পুলিশ মেয়েটির বাবা ও কাজিকে থানায় ধরে আনে৷ জেরা করার পর সন্দেহের আঙুল ওঠে মেয়েটির মায়ের দিকেও৷ পাঁচ লাখ টাকার বখরা নিয়ে বাবা-মায়ের মধ্যে আসল গণ্ডগোল৷ মা যে বিয়ের কথা জানতেন না, এটা প্রমাণ সাপেক্ষ৷ পুরানো হায়দ্রাবাদ শহরের মুসলিম প্রধান এলাকার সঙ্গে আরব দুনিয়ার একটা আত্মীক যোগ আছে৷ তাই ছুটে আসে পাত্রীর খোঁজে টাকার থলি নিয়ে৷ চুক্তিবদ্ধ নিকাহ৷ পাত্রীর পরিবার বেশির ভাগই গরিব বা নিম্নবিত্ত৷ পাত্রী অনুযায়ী দাম ওঠে ১০ হাজার থেকে ১০ লাখ৷ এই কাজে প্রধান ভূমিকা দালালদের৷ ৬০-৭০ জন দালালকে চিহ্নিত করা হয় সম্প্রতি৷ অনেকে থাকে মুম্বই বা বিদেশে আরব দেশগুলিতে৷ পুলিশের তদন্তে দু'টো এমন দু-চারটে ‘কেস' উঠে এসেছে, যারা আরব বাসিন্দা হলেও গরির৷ ভিক্ষা করে মসজিদের সামনে৷ বিয়ের পর বৌকেও তারা ঐ কাজে নামায়৷
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কৈলাশ সত্যার্থীর বচপন বাঁচাও আন্দোলন-এর মুখপাত্র ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে বললেন, ‘‘পাচারকারীদের কবল থেকে বাচ্চাদের উদ্ধার করার ওপরই আমরা বেশি জোর দেই৷ পাচারকারীরা টাকার লোভ দেখিয়ে মেয়েদের নিয়ে আসে৷ তারপর হাতবদল হয়, পাচার হয়৷ গরিব ঘরে মেয়ে বলে পুলিশও তেমন গা করে না৷ বড়সড় কেউ হলে আলাদা কথা৷ পাচার করা মেয়েদের একটা অংশকে পাঠানো হয় মধ্যপ্রাচ্যে শেখদের যৌনদাসী হিসেবে৷ আর একটা অংশকে বিক্রি করা হয় ভারতের রেডলাইট এলাকায়৷ নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর পেলে আমরা ঠিকানা এবং কোঠি নম্বর জেনে পুলিশের সাহায্যে তাদের উদ্ধার করি৷
হাজার হাজার নাবালিকার বিয়ে দেওয়া হয় বয়সের আগে, হাজার হাজার শিশু হারিয়ে যায় প্রতি বছর৷ অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানা রাজ্যের দুর্নাম সেক্ষেত্রে সবথেকে বেশি৷ কিশোর-কিশোরীদের পাচার সমাজে একটা উদ্বেগজনক স্তরে পৌঁছেছে, সংবাদমাধ্যমকে বললেন নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী কৈলাশ সত্যার্থী৷ ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, ২০১৫ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানায় প্রায় ৩ লক্ষ ২০ হাজার মেয়ে এবং ৩ লক্ষ ২১ হাজার ছেলের বিয়ে হয় বিয়ের বয়স হবার আগেই৷ হারিয়ে যায় বছরে ১৮ হাজারের মতো বাচ্চা৷ নাবালিকাদের ওপর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে পথে নামছেন কৈলাশ সত্যার্থী৷ আগামী ১১ই সেপ্টেমবর থেকে তাঁর ভারত যাত্রা শুরু হচ্ছে দক্ষিণী রাজ্য তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী থেকে৷ শেষ হবে দিল্লিতে ১৬ই অক্টোবর৷
প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো জানান আমাদের, লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷