বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের বিরেধিতার যত কারণ
১১ মে ২০১৭একই সঙ্গে এই আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তো বটেই, আইনটি নিজেই নিজের বিরোধী৷ বাংলাদেশ বাল্য বিবাহের উচ্চহারের দিক দিয়ে বিশ্বের অষ্টম অবস্থানে আছে৷ বাল্যবিবাহ কমে আসছে দাবি করা হলেও এর মূল শিকার যে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সি মেয়েরা, তাদের পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই৷
আইনের ১৯ ধারাই আপত্তির মূল কারণ৷ এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং পিতা-মাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হইলে, উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না৷''
এই আইনে নারীদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৮ এবং পুরষের ২১৷ কিন্তু ওই বিশেষ বিধানের কারণে অপ্রাপ্তবয়স্ক, অর্থাৎ যাদের বয়স ১৮ বছরের নীচে, তাদের বিয়ে বিশেষ বিবেচনায় বৈধতা দেয়া হয়েছে৷
এই আইনের ৫ , ৬ ,৭, ৯ , ১০ এবং ১১ ধারায় বাল্যবিবাহের দায়ে শাস্তির বিধান আছে৷ আর এসব বিধানে বাল্যবিবাহ করা, বিবাহ দেয়া, পরিচালনা করা, তথ্য গোপন করা প্রভৃতি অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে৷ আছে বিবাহ রেজিস্ট্রির লাইসেন্স বাতিলের বিধান৷ আইনের ৮ ধারায় বাল্যবিবাহ-সংশ্লিষ্ট পিতা-মাতাসহ অন্যান্য ব্যক্তির শাস্তির কথা বলা আছে৷ আর ৭ ধারায় বাল্যবিবাহ করলে কী শাস্তি হবে, তা-ও বলা আছে৷ কিন্তু বিশেষ বিধানের কারণে এই শাস্তি দেয়াও শর্তসাপেক্ষ হয়ে পড়েছে৷ কারণ, বিশেষ বিধানের আওতায় বাল্যবিবাহ হলে তা বৈধ হবে এবং শাস্তির আওতায় আসবে না৷ এটা একই সঙ্গে বাংলাদেশের পেনাল কোড বিরোধী৷ সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদও এই আইনের বিশেষ বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷
সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না৷'' এখানে নারী ও শিশুদের উন্নয়নে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷
গত ১০ এপ্রিল জাতীয় আইনজীবী সমিতি ও নারী পক্ষের রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি জে বি এম হাসানের বেঞ্চ প্রাথমিক শুনানির পর চার সপ্তাহের রুল দেন৷ রুলে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের বিশেষ বিধান কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে৷ চার সপ্তাহের মধ্যে ওই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে সরকারকে৷
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান ফাওজিয়া করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি৷ এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শুনানির কথা রয়েছে৷ তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো শো কজের কোনো জবাব দেয়া হয়নি৷''
তিনি বলেন, ‘‘এই আইনটি পাশের সময় সংসদে আলোচনা হয়নি৷ এমনকি খসড়া আইনে সাধারণ মানুষের মতামতেরও সুযোগ ছিল না৷ শুনানির সময় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে স্বাধীন মতামতের জন্য অ্যামিকাস কিউরি গঠন করা হবে, যারা আইনটি নিয়ে তাদের মতাতমত দেবেন৷''
ফাওজিয়া করিম মনে করেন, ‘‘এই আইনটি সংবিধান, পেনালকোড বিরোধী এবং আইনটি নিজেও সাংঘর্ষিক৷ নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য , শিক্ষা এবং ক্ষতায়নও বাধাগ্রস্ত করবে এই আইন৷''
ডয়চে ভেলেকে টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘‘পেনাল কোডে বলা আছে ১২বছর বা তার কম বয়সি কোনো মেয়ের সঙ্গে সেক্সুয়াল রিলেশন করলে, তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে৷ তাহলে বাল্যবিবাহ বৈধ হলে ওই আইনের কী হবে৷ ইন্দোনেশিয়ার নারী ইমামরা বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছেন৷ আমাদের দেশে ১৯২৯ সালের যে আইন প্রচলিত ছিল, তাতেও বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ এবং বেআইনি ছিল৷ কিন্তু ২০১৭ সালের আইনে তা বৈধ করে দেয়া হলো৷ কী অবাক করা ব্যাপার!''
বাংলাদেশ শিশু-নারী অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সদনগুলোর স্বাক্ষরকারী৷ চলতি বছরে সিডও সনদে বাংলাদেশকে বাল্যবিবাহ রোধে সব ধরণের পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে এবং বাংলাদেশও পদক্ষেপ নেয়ার অঙ্গীকার করেছে৷ কিন্তু বিশেষ বিধান অঙ্গীকারের বিরুদ্ধে যায়৷ ফাওজিয়া করিম বলেন, ‘‘সিডও সনদে বাংলাদেশ বাল্যবিবাহ দূর করার অঙ্গীকার করে আসার পর বাল্যবিবাহের পক্ষে আইন করেছে৷''
অন্যদিকে মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ভয়ঙ্কর দিক হলো বিশেষ বিধানের সুযোগ নিতে পারে ধর্ষকরা৷ তারা ধর্ষণের পর রেহাই পেতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে বিয়ে করতে পারে৷ আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় তা সহজেই সম্ভব৷ এরপর বিপদ কেটে গেলে সেই মেয়েকে ডিভোর্স দিতে পারে৷ কারণ, ডিভোর্স দেয়া তো আর বেআইনি নয়৷ তাই কোনোভাবেই বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের বিশেষ বিধান গ্রহণযোগ্য নয়৷''
নূর খান মনে করেন, ‘‘এখানে ধর্ষণের এক ধরণের বিচারিক অনুমোদনের অশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে৷''
প্রসঙ্গত, ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিচার্স ইন্সটিউট(আইএফপিআরআই)-এর মার্চের এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে গত দুই দশকে বাল্যবিবাহের হার শতকরা ৬২.৩ ভাগ থেকে কমে ৪৩ ভাগ হয়েছে৷ কিন্তু এর মধ্যে অন্য একটি ফাঁক আছে৷
আইএফপিআরআই-এর গবেষণায় দেখা যায় ১৯৯৬ থেকে থেকে ২০০৫ সালে বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ের হার ছিল শতকরা ১৫.৯ ভাগ, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের বিয়ের হার ছিল ৪৬.৫ ভাগ৷ সব মিলিয়ে বাল্য বিবাহের হার ছিল শতকরা ৬২.৩ ভাগ৷
আর ২০০৬ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ের হার শতকরা ৫.৪ ভাগ, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের বিয়ের হার ৩৭.৮ ভাগ৷ সব মিলিয়ে বাল্য বিবাহের হার শতকরা ৪৩.২ ভাগ৷
দৃশ্যত বাল্যবিয়ের হার কমলেও তাতে আত্মতৃপ্তির তেমন কোনো কারণ নেই৷ কারণ, গত দুই দশকে ১৫ বছরের কম বয়সিদের বিবাহের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমলেও মধ্যবর্তী ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের বিয়ের হার তেমন কমেনি৷ মাত্র ১০ ভাগের মত কমেছে৷
ফাওজিয়া করিম বলেন, ‘‘আমরা যদি এসডিজি অর্জন করতে চাই, তাহলে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে৷ কিন্তু নতুন আইন বাল্যবিবাহকে উৎসাহিত করবে৷'' আর নূর খান বলেন, ‘‘এই আইনটি আমাদের পেছনের দিকে নিয়ে যাবে৷''
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ চলতি বছরের ১১ মার্চ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে৷ এর মানে হলো, ওই দিন থেকেই আইনটি কার্যকর হয়ে গেছে৷ গেজেটে বলা হয়েছে, ‘‘১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইনটিকে নতুন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে৷''
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷