ইরানের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে চায় ইইউ
৮ আগস্ট ২০১৮ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোঘেরিনি এবং ইইউভুক্ত তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাজ্যের জেরেমি হান্ট, ফ্রান্সের জন-ইভ ল্য দ্রিয়ঁ ও জার্মানির হাইকো মাস যৌথভাবে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার নিন্দা জানিয়েছেন৷ একইসঙ্গে দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা৷
যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করলেও ইইউ, চীন ও রাশিয়ার এই চুক্তি মেনে চলার অঙ্গীকার রয়েছে৷ সে জায়গা থেকেই ইইউ এখন যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছে৷ তবে বিদ্যমান ব্যবস্থায় ইরানের সঙ্গে লেনদেনকারী ইইউ কোম্পানিগুলোর ওপর ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের৷ ইউরোপীয় কমিশন ইইউ কোম্পানিগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞাকে' অবৈধ বিবেচনা করে৷
অ্যামেরিকা চাইছে ইউরোপীয় গাড়ি নির্মাতা, ব্যাংক ও জ্বালানি কোম্পানিগুলো যেন ইরানের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য না করতে পারে৷ তারা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সম্পদ জব্দ করা হতে পারে৷ এমনকি ইরানের সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনাকারী ইইউ কোম্পানির সঙ্গে লেনদেনের জন্য অ্যামেরিকান কোম্পানিকেও শাস্তি পেতে হবে৷
এ কারণে অ্যামেরিকান নিষেধাজ্ঞার প্রভাব থেকে সুরক্ষার জন্য কথিত ‘ব্লকিং স্ট্যাচুট' গ্রহণ করেছে ইইউ৷ সংশোধিত এই আইন ৭ আগস্ট কার্যকর হচ্ছে৷
ব্রাসেলসে ইইউ-র একজন কর্মকর্তা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া উচিত৷ তবে কোম্পানিগুলো কী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেবে সেটা তাদের বিষয়৷ এখানে আমরা কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না৷ কোনো কোম্পানিকে ইরানে বিনিয়োগের জন্য জোর করা হবে না৷''
নতুন আইনের আওতায় ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা চ্যালেঞ্জ করে ইউরোপীয় আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবে এবং এ জন্য তারা অ্যামেরিকান সরকার ও দেশটির কোম্পানির কাছে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবে৷
তবে বাস্তবে এটা খুব ঝামেলাপূর্ণ ও ব্যয়বহুল৷ এ ধরনের মামলার নজির নেই বলে কমিশনের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন৷
ইরান ও কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে প্রথম ইউরোপীয় কোম্পানি ‘ব্লকিং স্ট্যাচুট'-এর দ্বারস্থ হলেও কখনও এর প্রয়োগ ঘটেনি৷ তখন থেকে সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞা আরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিরত রাখতে এই বিধি হুমকি হিসেবে কাজে লেগে আসছে৷
ইরান নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে জুলাইয়ের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় দেওয়ার বিষয়টি নাকচ করে৷
এরপর গত মঙ্গলবার প্রথম দফা নিষেধাজ্ঞার আওতায় ইরানের আর্থিক কাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করে যুক্তরাষ্ট্র৷ এতে ইরান সরকার মার্কিন ডলার কেনা, সোনা কেনাবেচা ও সরকারি বন্ড বিক্রির ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়বে৷
আগামী তিন মাসের মধ্যে ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপরেও নিষেধাজ্ঞা চাপাতে পারে ওয়াশিংটন৷ এছাড়া গাড়ি শিল্প, বেসামরিক বিমান পরিবহণ, গালিচা ও খাদ্য রপ্তানি, কিছু ধাতু আমদানির ক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়বে ইরান৷
এর কারণে অ্যামেরিকান সেকেন্ডারি নিষেধাজ্ঞার আওতায় ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো কী ক্ষতির মুখে পড়বে তা এখনও নিরূপণ করতে পারেনি ইইউ কমিশন৷ তবে অনেক কোম্পানি ও ব্যাংক এরইমধ্যে ইরান থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে৷ বিশেষত যেসব কোম্পানির অ্যামেরিকায় কর্পোরেট অ্যাসেট ও রিয়েল এস্টেট রয়েছে, যেগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকছে, সেই সব কোম্পানিই তড়িঘড়ি করে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে৷
যুক্তরাষ্ট্র সরকার চাইছে ইরানকে বৈশ্বিক মুদ্রাবাজার থেকে পুরোপুরি বের করে দিতে এবং তাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস জ্বালানি রপ্তানি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে৷ আগামী নভেম্বরে ইরানের জ্বালানি খাতের ওপরেও নিষেধাজ্ঞা দিতে চায় ট্রাম্প প্রশাসন৷ তার আগেই ইরান থেকে পেট্রোলিয়াম আমদানি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে বিভিন্ন দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে ওয়াশিংটন৷
এই প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন দেখছে সদস্য দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন চালিয়ে যেতে পারবে কিনা৷
ডয়চে ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংকই ইরান থেকে সরে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করতে পারে৷ কারণ তাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাবাজারে অবাধে কার্যক্রম পরিচালনা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ এমনকি ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকও (ইআইবি) এ বিষয়ে খুব সাবধানী৷
ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ভেরনের হয়ের গত জুলাইয়ে বলেন, ইআইবি আর ইরানের সঙ্গে লেনদেন চালিয়ে যেতে পারবে না৷
‘‘আমরা সেখানে আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্সিংয়ে আর ভূমিকা রাখতে পারব না৷''
তবে ইইউ কমিশন এখন ব্যাংকটিকে ইরানে এ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করছে এবং সেজন্য তাদের আইনি কর্তৃত্বও দেওয়া হয়েছে৷
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে ফরাসি ও ইটালিয়ান কোম্পানিগুলোর ওপরে৷ ফরাসি জ্বালানি কোম্পানি টোটাল এখন আর ইরানে ৫ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প নিয়ে এগোতে চাইছে না৷ ইটালিয়ান কোম্পানিগুলোও বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাতিল করেছে৷ জার্মানির সিমেন্সের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে৷
ফ্রেঞ্চ গাড়ি নির্মাতা পিএসএ ইরানে তাদের ব্যবসা কমাতে চাইছে৷ তবে আপাতত থাকছে রেনঁ৷ ইউরোপীয় উড়োজাহাজ নির্মাতা এয়ারবাসের কাছে ১০০ উড়োজাহাজের অর্ডার রয়েছে ইরানিয়ান এয়ারলাইন্সের৷ এই কোম্পানির অ্যামেরিকায়ও কার্যক্রম থাকায় তারা আসলে কতটি উড়োজাহাজ ইরানকে দিতে পারবে তা এখনও স্পষ্ট নয়৷
এএইচ/ডিজি