ঈদ এখনো আছে, তবে সেই আনন্দটা আর নেই। মানতেই হবে, ঈদের আনন্দটা শিশু-কিশোরদের কাছেই বেশি। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের অনুভূতিটাও কমে আসে। পেশাগত কারণে গত অনেকবছর ধরেই ঈদের দিনটি কাটাতে হয় অফিসে। তবে আমার ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনা-ব্যস্ততা দিয়ে তো আর ঈদের আনন্দ মাপা যাবে না। চারপাশে বরং উৎসবের ফোয়ারা দেখি। চারদিকে উৎসব, রঙ আর উৎকট বাণিজ্যের ছড়াছড়ি। আমাদের ছেলেবেলার ঈদের সাথে এখনকার ঈদকে মেলানো কঠিন। আমাদের ছেলেবেলায় আনন্দটাই ছিল মুখ্য, বাণিজ্যের অমন উৎকট ছড়াছড়ি ছিল না। স্কুলমাস্টার বাবা ৬ সন্তানের আবদার মেটাতে হিমশিম খেতেন। ঈদে চাই নতুন জামা। সবার নতুন জামা কেনা চাট্টিখানি কথা নয়। তখন তো এখনকার মতো রেডিমেড পোশাকের চল ছিল না। থাকলেও তা পোষাতো না। কাপড় কিনে দর্জির কাছে সেলাই করিয়ে নিতে হতো। শেষ সময়ে দর্জির দোকানে লাইন লেগে যেতো। ঈদের আগে জামাটি উদ্ধার করা যেন যুদ্ধ জয়ের মতো। তারচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল ঈদের জামাটি ঈদের সকাল পর্যন্ত গোপন রাখা। বালিশের নীচে ঈদের জামা লুকিয়ে রেখে ঘুমাতাম, যাতে কেউ দেখে না ফেলে। সব ঈদে সবকিছু পাওয়া যেতো না। শার্ট পেলে প্যান্ট পেতাম না, প্যান্ট পেলে বেল্ট মিলতো না, নতুন জুতা মিলতো কালেভদ্রে। ঈদের আগের রাতে জুতা বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা, মাঝে মধ্যে নতুন জুতার গন্ধ নেয়ার আনন্দই আলাদা। অত স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও ছেলেবেলার মতো সেই টানাটানিটা আর নেই এখন। চাইলেই ইচ্ছামতো জামা-জুতো কিনতে পারি বা কিনে দিতে পারি। কিন্তু ছেলেবেলার সেই রোমাঞ্চ, সেই শিহরণটা আর পাই না।
রমজান আসতো সংযমের বারতা নিয়ে। সারাদিন রোজা শেষে ইফতারের জন্য অপেক্ষটা বড় কষ্টের, বড় মধুর ছিল। তখন তো আর টেলিভিশন ছিল না। আমাদের গ্রামের বাড়ির উল্টোদিকে একটা ওয়ারলেস অফিস ছিল, সেখানে একটা উঁচু টাওয়ার ছিল। টাওয়ারের মাথায় একটা আলো জ্বলতো। সেটা ছিল আমাদের ইফতারের সঙ্কেত। অন্তত ১০ মাইল দূর থেকেও সেই আলো দেখা যেতো। ইফতারের সময় হলে আমি উঠানে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ওয়ারলেস টাওয়ারের আলো জ্বললেই আনন্দে চিৎকার করে উঠতাম। তৃষ্ণায় কাতর আমার মনে হতো পুরো এক জগ পানি খেয়ে ফেলবো। শেষ পর্যন্ত এক গ্লাসেই মিটে যেতো তৃষ্ণা। তখন তো ফ্রিজ ছিল না। অনেকবার চাপলে টিউবওয়েল থেকে একটা আরামদায়ক শীতল পানি আসতো। সেটাই আমরা রাখতাম ইফতারের জন্য। তবে ইফতারের চেয়ে বেশি মজা হতো সেহরিতে। মধ্যরাতেই জেগে উঠতো গোটা গ্রাম। ফ্রিজ ছিল না বলে খাবার সংরক্ষণেরও উপায় ছিল না। মা-চাচীরা মধ্যরাতে উঠেই রান্না-বান্না শুরুতে করতেন। আমরা রাতের বেলা এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম, কোথায় কী রান্না হচ্ছে দেখতে। ঘুম ঘুম চোখে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সাথে গরম গরম তরকারি- পিকনিক পিকনিক লাগতো। একবার শবেকদরের রাতে পরিকল্পনা ছিল সারারাত নামাজ পড়ে একেবারে সেহেরি খেয়ে ঘুমাবো। নামাজ পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি। মায়া করে কেউ আমাকে ডাকেওনি। সকালে উঠে আমার সে কি কান্না! এখনও ভাবলে হাসি পায়।
ঈদ যত ঘনিয়ে আসতো, বাসায় ছড়িয়ে পড়তো উৎসবের গন্ধ। বিশ্বাস করুন, উৎসবের একটা দারুণ গন্ধ আছে। শিশুরাই সেটা টের পায় সবার আগে। শবে কদর মানেই ঈদ চলে এসেছে। ঈদের আগের সন্ধ্যায় শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখাটাও ছিল উৎসবের বড় অনুষঙ্গ। মাগরিব নামাজ শেষেই সবাই ঈদগাহে জড়ো হতাম। কেউ মসজিদের ছাদে, কেউ মিনারের চূড়ায়, কেউ গাছের মগডালে চড়ে বসতাম। আকাশের যত কাছে যাওয়া যাবে, চাঁদ তত স্পষ্ট দেখা যাবে, এটাই ছিল ধারণা। বড়রা কীভাবে যেন আগে চাঁদ দেখে ফেলতেন। তারপর আমাদের দেখাতেন, ঐ যে দেখা যায়। এক ফালি চাঁদ, অল্প সময়ের জন্য থাকে। তখন এখনকার মতো চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্তের জন্য বসে থাকতাম না। নিজের চোখে চাঁদ দেখার আনন্দই আলাদা। এখন সবাই চাঁদ দেখেন কমিটির চোখে, নিজের চোখে চাঁদ দেখা মানুষ এখন বিরল। চাঁদ দেখা গেলেই আটকে থাকা আনন্দের বাধ ভেঙে যেতো। ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ…' গাইতে গাইতে আমরা যেন পলকে স্বাধীন হয়ে যেতাম। চানরাইতের আড্ডা যেন ফুরোতেই চাইতো না। মা-চাচীরা বসে বসে যেতেন ঈদের রান্নার প্রস্তুতিতে। বোনেরা বসে যেতেন মেহেদী লাগাতে। মেহেদী মানে কিন্তু টিউবের কৃত্রিম মেহেদী নয়, গাছের টাটকা পাতা বেঁটে মেহেদী লাগানো হতো। যত বেশি সময় রাখা যায়, মেহেদীর রঙ তত গাঢ় হয়। ঈদের সকালে তাড়াতাড়ি গোসল করে, দাদার কবর জেয়ারত করে, নতুন জামা পরে ঈদগাহ। সবার সাথে কোলাকুলি করে সেমাই খেয়ে সালামি কালেকশন অভিযান। চার আনা, আট আনা, এক টাকা, দুই টাকাই ছিল আমাদের কাছে অনেক। সেই টাকায় দিনভর ফূর্তি। ইচ্ছামতো চকলেট, চুইঙ্গাম, আইসক্রিম, খেলনা কেনা। চারদিকে উৎসবের ফোয়ারা বইতো যেন।
আমরা উৎসবপ্রিয় জাতি। বারো মাসে তেরো পার্বণ। তেরোতেও খুশি নই আমরা। পারলে সবকিছুকেই উৎসব বানিয়ে ফেলি। ধর্মীয় আচারেও লাগাই উৎসবের রঙ। দুই ঈদ তো আছেই; শবে বরাত, শবে কদর, শবে মেরাজকেও আমরা উৎসব বানিয়ে ফেলতাম। রাতভর ইচ্ছামতো দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতার চেয়ে বড় আনন্দ আর কী আছে? দূর্গা পূজা, স্বরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা, বড়দিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা- সব উৎসবই সবার। আনন্দটাই নিংড়ে নিতাম। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার' ছেলেবেলায় এই স্লোগানটা শুনিনি। কিন্তু এটাই পালন করেছি। তখন স্লোগান লাগতো না। কারণ, উৎসব নিয়ে কারো কোনো ভিন্নমত ছিল না।
পহেলা বৈশাখ হলো সার্বজনীন উৎসব- বাঙালির প্রাণের উৎসব। পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস, থার্টি ফার্স্ট, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, এমনকি শোকের দিন একুশে ফেব্রুয়ারিও আমরা পালন করি উৎসবমুখরতায়। পহেলা বৈশাখ যতটা শহরে, তারচেয়ে বেশি উদযাপিত হয় গ্রামে। মেলা বসে গ্রামে গ্রামে। তাতে হরেক খাবার, হরেক খেলনা, হরেক পোশাক। সাথে আছে হালখাতা। পুরোনো হিসাব চুকিয়ে নতুন করে শুরু করার আকাঙ্খা। হালখাতার দোকানে আমরা যেতাম রসগোল্লা, নিমকি বা নিদেনপক্ষে বাতাস খাওয়ার লোভে। ঢাকায় বর্ষবরণের নানা আয়োজন থাকে। তবে মূল আয়োজন রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা শুধু বাঙালির নয়, এখন বিশ্ব ঐতিহ্যেরও অংশ।
বাংলাদেশে উৎসবের সংখ্যা বেড়েছে, পরিধি বেড়েছে, রঙ লেগেছে, বাণিজ্য এসেছে। ঈদ, পূজা, ফাল্গুনে কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এবার অবশ্য ঈদ আর পহেলা বৈশাখের ব্যবসা মিলে মিশে গেছে। এই যে এখন অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে নানান কথা হয়। ঈদের আগে ঢাকার শপিং মলগুলোতে ঢুঁ মারলে আপনার এই ধারণা বদলে যেতে বাধ্য। মধ্যরাতেও কোনো মার্কেটে ঢোকার উপায় ছিল না।
উৎসব বেড়েছে বটে। কিন্তু সেই আনন্দটা আর কোথাও খুজেঁ পাই না। ধর্ম থেকে উৎসবকে আলাদা করা একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে অনেকদিন ধরেই। ধর্মে ধর্মে বিভেদ তো আছেই। এমনকি ইসলাম ধর্মেও আছে নানা মত। ছেলেবেলা থেকে জেনে আসা রমজান, সেহেরি, নামাজ বদলে গেছে রামাদান, সাহুর, সালাতে। শবে বরাত ছিল আমাদের অন্যরকম উৎসব। রাতে গোসল করে কবরস্থান জেয়ারত করে সারারাত নফল নামাজ পড়া, হালুয়া-রুটিসহ উন্নতমানের খাবার খাওয়া এবং বিলি করা৷ আলোকসজ্জার এই উৎসব এখন শুনি বেদাত। শবে বরাতে যা যা করা হয়, তার কোনোটাই খারাপ নয়, ধর্মবিরোধীও নয়।
গোসল করা, কবর জেয়ারত করা, ভালো রান্না করা, নফল নামাজ পড়া কীভাবে বেদাত হয় আমার মাথায় ঢোকে না। টেরও পাইনি কীভাবে আমরা বদলে যাচ্ছি।
ধর্ম থেকে উৎসব আলাদা করে ধর্মকে কঠিন করে তোলার চেষ্টা তো আছেই, সাথে আছে নানান উৎসবে ধর্মীয় ট্যাগ লাগানো। পহেলা বৈশাখ বাঙালির সার্বজনীন উৎসব। কিন্তু ইদানীং পহেলা বৈশাখ উদযাপনকে ‘হিন্দুয়ানি' সংস্কৃতি বলে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এমনকি ছায়ানটের বর্ষবরণে একবার হামলার ঘটনাও ঘটেছে। জঙ্গীরা হামলা করেছে তাজিয়া মিছিলেও। আমাদের সব উৎসবে তাই এখন বিধিনিষেধের দেয়াল। তাজিয়া মিছিল এমনভাবে পুলিশ ঘেরাও করে রাখে যে, মিছিলই দেখা যায় না। প্রতিটি উৎসবের আগেই পুলিশকে সতর্ক থাকতে হয়। কথা বলতে হয়, জঙ্গী হামলার আশঙ্কা নিয়ে। ঈদের জামাতে জায়নামাজ ছাড়া আর কিছু নিয়ে যাওয়া যায় না। বৈশাখের সব আয়োজন সন্ধ্যা ৬টার মথ্যে শেষ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অবশ্য সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাত ৯টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান করার ঘোষণা দিয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের একটি সাংস্কৃতিক অর্জন। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়ে যাওয়া এই শোভাযাত্রা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। শুরুতে শোভাযাত্রা চারুকলা থেকে শুরু হয়ে টিএসসি, দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট, মৎস্য ভবন, শিশুপার্ক, শাহবাগ হয়ে চারুকলায় এসে শেষ হতো। ছোট হতে হতে মঙ্গল শোভাযাত্রা এবার চারুকলা থেকে শিশুপার্ক হয়ে চারুকলায় শেষ হবে। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়ে যাওয়ায় চক্ষুলজ্জার কারণে বন্ধ করা যাচ্ছে না যেন। শোভাযাত্রাকে যেভাবে চারপাশে পুলিশ ঘেরাও করে রাখে, দেখলে লজ্জাই লাগে।
উৎসব হবে অবারিত। তাতে থাকবে প্রাণের ছোঁয়া। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে আর যা-ই হোক উৎসব হয় না। উৎসবের সংখ্যা বেড়েছে, তাতে রঙ লেগেছে, বাণিজ্য লেগেছে; খালি হারিয়ে গেছে প্রাণ। প্রাণ না থাকলে সেটা আর উৎসব হবে কীভাবে?