নিরাপত্তা পরিষদে জার্মানির এক বছর
৮ জানুয়ারি ২০১২বিগত বছরে নিরাপত্তা পরিষদের কাজের কোনো কমতি ছিল না৷ আরব বসন্তের উথাল-পাতালে জাতিসংঘের এই সর্বোচ্চ অঙ্গসংস্থাটিকে বারংবার অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে৷ সেক্ষেত্রে জার্মানিকে যে ভূমিকা নিতে হয়েছে, তা অস্থায়ী সদস্য হিসেবে জার্মানির উচ্চাশাকে বহুমাত্রায় অতিক্রম করে গেছে৷ জাতিসংঘে জার্মানির রাষ্ট্রদূত পেটার ভিটিশ বলেন: ‘‘নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়গুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা যাদের কাজ, তাদের মধ্যে আমরা ছিলাম৷ কোনো বিষয়কে পরিষদের এজেন্ডাতে আনতেই অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়৷ তা'তে আমাদের একটা বড় অবদান ছিল৷''
বিশেষ করে দুটি বিষয়ে জার্মানি ছোট হলেও স্থায়ী সাফল্য আনতে পেরেছে: প্রথমত, সশস্ত্র সংঘাতে শিশুদের পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় করে তোলা; দ্বিতীয়ত, জলবায়ুর পরিবর্তন থেকে যে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপদ সৃষ্টি হতে পারে, রাষ্ট্র ও সমাজকে সে বিষয়ে সচেতন করে তোলা৷ নিরাপত্তা পরিষদ যা'তে ইয়েমেন'এর সঙ্কটজনক পরিস্থিতি, এবং বিশেষ করে সিরিয়ায় প্রতিবাদ আন্দোলনের উপর সরকারের রক্তাক্ত দমননীতি সম্পর্ক সিদ্ধান্তে আসে, সেজন্যও জার্মান কূটনীতিকরা সচেষ্ট৷ কিন্তু যেহেতু পাঁচ স্থায়ী সদস্য সদয় না হলে কিছুই করার উপায় নেই, সেহেতু যাবতীয় জার্মান প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নিরাপত্তা পরিষদকে আসাদ প্রশাসনের বর্বরতার নীরব দর্শক হয়েই থাকতে হয়েছে৷ ভিটিশ বলেন: ‘‘যারা এ'যাবৎ সব প্রচেষ্টা রুখে এসেছে, সেটা তাদের পক্ষেও খুব গর্বের কথা নয়৷ আমি শুধু দু'টি ভেটো-শক্তির নাম করব, যারা প্রস্তাবকে সফল হতে দেয়নি৷''
অর্থাৎ রাশিয়া এবং চীন, যাদের দৃষ্টিতে সিরিয়াকে অস্ত্রবিক্রয়ের লোভনীয় মুনাফা দৃশ্যত মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ তবে জার্মানি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় একটি প্রস্তাব পাশ করাতে সক্ষম হয়৷ সেই প্রস্তাবে কড়া ভাষায় দামেস্ক সরকারের নিন্দা করা হয়েছে৷ তা সে রাজনৈতিক বিচারে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের তুলনায় যতো কম ওজনেরই হোক না কেন৷
জার্মানি যে বিশেষ করে মানবিক বিষয়গুলি নিয়ে সচেষ্ট, জাতিসংঘের অপরাপর সদস্যদেশ তার সপ্রশংস স্বীকৃতি দিয়েছে৷ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে জার্মানির ভূমিকা সম্পর্কে অন্যদের মন্তব্য: জার্মানি হল দক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ, আস্থাভাজন, কিন্তু আত্মকেন্দ্রিক নয়৷
কাজেই জার্মানি যখন লিবিয়া নিয়ে ১৯৭৩ নম্বর প্রস্তাবটির উপর ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে, তখন তা যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে, তা আজও পুরোপুরি মেটেনি৷ ঐ প্রস্তাবে নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ার আকাশে উড়াল নিষিদ্ধ এলাকা সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই পন্থায় বিদ্রোহীদের পরোক্ষভাবে সাহায্য করে৷ এক্ষেত্রে বার্লিন যে প্রকাশ্যভাবে তার ইইউ-সহযোগী এবং ন্যাটো-মিত্রদের থেকে দূরে থেকেছে, সেটা নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের মুখ্য কার্যালয়ে কোনো বিষয় হয়ে ওঠেনি, বলেন ভিটিশ: ‘‘আমরা এখানে কোনোরকম বৈষম্যমূলক ব্যবহার পাইনি, কিংবা আমাদের একঘরে করা হয়নি৷ কোনো কলঙ্ক আরোপ করা হয়নি৷ লিবিয়া প্রস্তাবে জার্মানির অবস্থানকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় দেশের ভোট বলেই গ্রহণ করা হয়েছে৷''
অপর একটি বিষয় নিয়ে জার্মান কূটনীতিকরা নেহাৎ প্রশ্ন করা না হলে মুখ খোলেন না৷ সেটা হল নিরাপত্তা পরিষদে বার্লিনের একটি স্থায়ী আসন পাওয়ার দাবি৷ অস্থায়ী সদস্য হিসেবে জার্মানির কর্মকাণ্ডকে অনেকেই ঐ উচ্চতর ভূমিকার আবেদনপত্র হিসেবে দেখছেন৷ জাতিসংঘে আর্থিক অনুদানের বিচারে জার্মানি বিশ্বে তৃতীয়, এবং জাতিসংঘে জার্মানির মান ও স্বীকৃতি, দু'টির কোনোটিরই অভাব নেই৷ তবুও, নিরাপত্তা পরিষদে জার্মানির স্থায়ী আসন পাওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে জাতিসংঘের কূটনীতিক মহলে বিশেষ আশাবাদী মনোভাব নেই৷ রাষ্ট্রদূত ভিটিশও বলেন, কাজটা খুব সহজ নয়৷ জাতিসংঘের কাঠামোগত সংস্কার শুধুমাত্র পাঁচ স্থায়ী সদস্যের সম্মতি নিয়েই সম্ভব৷ এবং যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও চীন এযাবৎ সব ধরনের প্রচেষ্টাকে সফলভাবে রুখে এসেছে৷
প্রতিবেদন: থমাস স্মিট / অরুণ শঙ্কর চৌধুরী
সম্পাদনা: আবদুল্লাহ আল-ফারূক