নিঝুম দ্বীপের পরিযায়ী পাখিরা
২২ জানুয়ারি ২০১৯আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলকে তিনভাগে ভাগ করা যায় – দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল৷ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে পড়েছে সুন্দরবন, পূর্বে কক্সবাজার, আর দক্ষিণে আছে নিঝুম দ্বীপ৷ শীতকালে, বিশেষত অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত আমাদের উপকূলে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখির আনাগোনা থাকে৷
উপকূলের উর্বর কাদাচরের প্রাণীরাই এদের মূল আকর্ষণ এবং প্রধানতম খাবার৷ জোয়ার-ভাটার নিয়ত আবর্তনে কাদাচর ডুবে আবার ভাসে৷ জোয়ারে সমস্ত কাদাচর পানিতে ডুবে গেলে জেগে থাকা বালুচর, ঘাস ও বনে এরা আশ্রয় ও বিশ্রাম নেয়৷ ভাটায় যখন পানি নেমে যায় আর কাদাচর উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, তখন এরা খাবার সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷
পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার সংগ্রহের বিষয়টি এদের জীবন সংগ্রামের অংশ এবং বেঁচে থাকার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ৷ হাজার মাইল উড়াল দিয়ে পরিযায়ী পাখিরা বাংলাদেশের উপকূলে আসে, তারপর আবার প্রজনন ক্ষেত্রে ফিরে যায়৷ আর এই উড়ালের শক্তি জোগায় শরীরের চর্বি৷ তাই উড়ালের আগে এদের পর্যাপ্ত পরিমাণ চর্বি জমাতে হয়৷
বছর জুড়ে বাংলাদেশে ২৩৪ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে৷ এদের মধ্যে ২০৮ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি শীতকালে ও ১২ প্রজাতির গ্রীষ্মকালে দেখা মেলে৷ এছাড়া আরো ১৪ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি তাদের গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন আবাসস্থলে আসা- যাওয়ার পথে বাংলাদেশকে স্বল্প সময়ের জন্য ব্যবহার করে৷ পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলে মূলত সৈকত পাখি (কাদাখোঁচা জাতীয় পাখি), সামুদ্রিক বা পেলাজিক পাখি (গাঙচিল জাতীয় পাখি) এবং হাঁসের দেখা মেলে৷
আমি ২০১৫ সাল থেকে নিঝুম দ্বীপ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় বংলাদেশের উপকূলের পরিযায়ী পাখিদের উপর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি৷ আমার গবেষণার বিষয়বস্তু পরিযায়ী পাখিদের পরিযায়ন, শীতকালীন আবাসস্থলের ব্যবহার, খাবার ও খাবারের প্রাচুর্য, বিপদ এবং সংখ্যা নিরূপণ৷ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূলের মধ্য থেকে নিঝুম দ্বীপ ও তৎসংলগ্ন এলাকা পরিযায়ী পাখির জন্য গুরুত্বপূর্ণ৷
গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর পানি এই অঞ্চল হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে৷ এই তিন নদীর পানি সাথে করে নিয়ে আসে উর্বর পলি৷ তাই এলাকায় প্রায়শই নতুন চরের সন্ধান মেলে এবং পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ হওয়ায় অসংখ্য জীববৈচিত্রের দেখা মেলে৷ পরিযায়ী পাখিরা উপকূলীয় বাস্তুসংস্থানের খাদ্যশৃঙ্খলসহ প্রাণ ও মাটির রাসায়নিক চক্রে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ এই এলাকার গুরুত্ব বিবেচনা করে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল ইতোমধ্যে এই এলাকাকে গুরুত্বপুর্ণ পাখি এবং জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে৷
বাংলাদেশের উপকূলে পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বিরল ও বিপন্ন কিছু প্রজাতির পাখিও দেখা যায়৷ বিশ্বব্যাপী অতি বিরল ও মহাবিপন্ন চামচঠুঁটো বাটান এদের মধ্যে অন্যতম৷ এই অতি বিরল পাখিটি আমাদের উপকূলের সোনাদিয়া, গাঙ্গুইরার চর, নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন দমার চর ও বিরবিরার চরে প্রায়শই দেখা যায়৷ পাখি বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীব্যাপী এই পাখির সংখ্যা মাত্র ২৫০ থেকে ৪৫৬৷ মহাবিপন্ন এই পাখির প্রজনন ক্ষেত্র রাশিয়ায় আর বংলাদেশ, মায়ানমার ও থাইল্যান্ড হচ্ছে এর প্রধান শীতকালীন আবাসস্থল৷
বিশ্বব্যাপী বিপন্ন বড় নট ও নর্ডম্যানের সবুজ পা পাখিও আমাদের উপকূলে পাওয়া যায়৷ বড় নট উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়া থেকে আমাদের দেশে আসে৷ এদের মূল শীতকালীন আবাস অস্ট্রেলিয়া হলেও বাংলাদেশের সোনাদিয়া ও নিঝুম দ্বীপে এদের দেখতে পাওয়া যায়৷ আর নর্ডম্যানের সবুজ পা পুর্ব রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে আসে৷ এদের খুঁজে পাওয়া ও চিহ্নিত করা বেশ কঠিন কাজ৷ বিশ্বব্যাপী এদের শীতকালীন আবাস সম্পর্কেও পরিষ্কার ধারণা নেই৷ তবে পাতি সবুজ পা থেকে আলাদা করা কঠিন বলে এদের উপস্থিতি ও সংখ্যা সম্ভবত বাংলাদেশ থেকে কম রিপোর্ট করা হয়েছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা৷
সংকটাপন্ন দেশি গাংচষা বেশ বড় ঝাঁকে দেখতে পাওয়া যায় নিঝুম দ্বীপ ও তৎসংলগ্ন এলাকায়৷ শুধুমাত্র বাংলাদেশের উপকূলে একসময় দেশি গাংচষার পাঁচ হাজারের ঝাঁক দেখতে পাওয়া গেলেও সম্প্রতি হাজারের অধিক ঝাঁক দেখা যায় না৷ দেশি গাংচষার টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশের উপকূল খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এরা মূলত ভারতে প্রজনন করে এবং বাংলাদেশের উপকূলে শীত কাটায়৷ সম্প্রতি চাঁপাইনবাবগঞ্জে এদের প্রজনন ক্ষেত্রের সন্ধান মিলেছে৷
পৃথিবীব্যাপী প্রায় সংকটাপন্ন পাখি কালো লেজ জৌরালি, দাগি লেজ জৌরালি, এশীয় ডাউইচার, ইউরেশীয় গুলিন্দা, গুলিন্দা বাটান, লাল নট, লাল ঘাড় চা পাখি , রাঙ্গা মানিকজোড়, কালো মাথা কাস্তেচরা, ফুলুরি হাঁসও ভালো সংখ্যায় দেখতে পাওয়া যায়৷ এদের মধ্যে দাগি লেজ জৌরালির পরিযায়ন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য৷
দাগি লেজ জৌরালি আলাস্কা থেকে নিউজিল্যান্ড প্রায় ১১০০০ কিলোমিটার পথ বিরামহীনভাবে পরিযায়ন করে৷ এ পরিযায়নে তারা ৮ দিন সময় নেয় এবং এই সময়ে তারা কোনো খাবার গ্রহণ করে না৷ পাখি বিজ্ঞানীদের কাছে এই পরিযায়ন খুবই বিস্ময়কর ও কৌতূহলোদ্দীপক, কেননা, মানুষের তৈরি সবচেয়ে চমৎকার এয়ারক্রাফট ও বিরতিহীনভাবে ৮২ ঘণ্টার বেশি চলতে পারে না৷ আলাস্কা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কোন পথ ব্যবহার করে দাগি লেজ জৌরালি বাংলাদেশে আসে তা আমাদের অজানা হলেও নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন এলাকায় দাগি লেজ জৌরালির দেখা মিলে৷
বিপন্ন পরিযায়ী পাখি প্রজাতি ছাড়াও বংলাদেশে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে৷ বাংলাদেশে সর্বমোট ২৩ প্রজাতির পরিযায়ী হাঁস, ৪৬ প্রজাতির পরিযায়ী সৈকত পাখি ও ১৩ প্রজাতির সামুদ্রিক পাখি দেখা যায়৷ এদের মাঝে উল্লেখযোগ্য চখাচখি, ইউরেশীয় সিঁথিহাঁস, পিয়াং হাঁস, দাগি রাজহাঁস, ধূলি জিরিয়া, প্রশান্ত সোনাজিরিয়া, নাটা গুলিন্দা, পাকড়া উল্টোঠুঁটি, পালাসের গাংচিল, বাদামি মাথা গাংচিল বেশ ভালো সংখ্যায় দেখা যায়৷ এদের মধ্যে দাগি রাজহাঁস হিমালয় পর্বত অতিক্রম করে বাংলাদেশ ও তৎসলগ্ন এলাকায় শীতের আবাস গড়ে৷ খুব কম প্রজাতির পাখিই হিমালয়ের এত উচ্চতা (প্রায় ৩৩৩৮২ ফুট) অতিক্রম করে পরিযায়ন করতে পারে৷
পৃথিবীব্যাপী সমস্ত পরিযায়ী পাখি সর্বমোট ৮ টি উড়াল পথ ধরে যাতায়াত করে থাকে৷ বাংলাদেশ পূর্ব এশীয়-অষ্ট্রালেশীয় ও মধ্য এশীয় এই দুইটি উড়াল পথের মধ্যে পড়েছে এবং এই দুইটি উড়াল পথের পাখিরাই বাংলাদেশে আসে৷ বিবর্তনের ধারায় লক্ষ বছরে পরিযায়ী পাখিরা দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণের নানান কৌশল রপ্ত করেছে৷ যেমন দাগী লেজ জৌরালির মতন কেউ এক্সপ্রেস সার্ভিসের মতো বিরামহীনভাবে ১১০০০ কিলোমিটার উড়ে যায়, দাগি রাজহাঁসের মতন কেউ হিমালয় অতিক্রম করে, চামচ ঠুঁটো বাটানের মতো কেউ মাঝপথে বিশ্রাম নেয় আবার কেউ লোকাল সার্ভিসের মতো ছোট ছোট দূরত্ব অতিক্রম করে তার প্রজনন ক্ষেত্র থেকে শীতকালীন ক্ষেত্রে পৌঁছায়৷ পরিযায়ী পাখিরা যেহেতু দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণ করে, সেহেতু এদের নানান বাধা বিপত্তির সন্মুখীন হতে হয়৷ উড়াল পথের সম্মিলিত আবাসস্থলের পরিবর্তন ও ধ্বংস, জলবায়ুর পরিবর্তন ও শিকারের কারণে পরিযায়ী পাখিরা অধিকাংশই হুমকির সন্মুখীন৷ লক্ষ বছর ধরে এরা পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকলেও আজ বেশিরভাগ পরিযায়ী পাখিই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে৷
পরিযায়ী পাখিদের সংরক্ষণে পৃথিবীব্যাপী সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন, কেননা, এরা টিকে থাকার স্বার্থে বছরজুড়ে পৃথিবী পরিভ্রমণ করে ও বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে নানান দেশে বসবাস করে৷ তাই পরিযায়ী পাখিদের উড়াল পথের সমস্ত জায়গায় নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ জরুরি৷ দীর্ঘ পরিযায়ন শেষে বাংলাদেশের উপকূলে পৌঁছানো হাজার হাজার পরিযায়ী পাখির খাবার, বিশ্রাম ও নিরাপত্তা অতি গুরুত্বপুর্ণ৷ প্রজনন ক্ষেত্রে তীব্র শীত ও খাবার সংকট এড়াতে এরা আমাদের উপকূলে আসে৷
কিন্তু এখানে এসে এরা নানান উপদ্রবের মুখোমুখি হয়৷ তাই আমাদের উপকূলে যে সমস্ত এলাকায় পরিযায়ী পাখি শীতকালীন সময়ে আবাস করে, সে সমস্ত এলাকায় উপকূলের মানুষের উপদ্রব কমানো ও গতিবিধি সংরক্ষিত করা প্রয়োজন৷ এছাড়া পরিযায়ী পাখিশিকারীদের রোধে সম্যক সচেতনতা ও আইনি ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন৷ পরিযায়ী পাখিরা হারিয়ে গেলে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে৷ এর ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষেরা প্রকৃতির কাছ থেকে প্রাপ্ত অনেক সেবা থেকে বঞ্চিত হবে৷
পরিযায়ী পাখিরা আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ ও প্রতিবেশে যে ভূমিকা রাখছে, তার সুনির্দিষ্ট গবেষণা প্রয়োজন৷ উপকূলীয় বাস্তুসংস্থানে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে আমাদের সুনির্দিষ্ট গবেষণার অভাব রয়েছে৷ এদের সংরক্ষণে তাই আমাদের সচেতন হতে হবে ও সকলের এগিয়ে আসতে হবে৷
দিলীপ দাশ বিসর্গ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
পাঠক, দিলীপ দাশ বিসর্গের লেখাটি কেমন লাগলো জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷