কমছে পাখি, বাড়ছে দালানকোঠা
২২ জানুয়ারি ২০১৯ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে কত প্রজাতির পাখি আছে?
ইনাম আল-হক: বাংলাদেশে ৭০০ প্রজাতির পাখি আছে৷
এর মধ্যে দেশি পাখির সংখ্যা কেমন?
দেশি-বিদেশি নয়, যে পাখি একদিন এদেশে দেখা যায়, সেটাও এদেশের পাখি৷ কিছু পাখি এ দেশে সারা বছর থাকে, কিছু থাকে না৷ পাখি এরকমই হয়৷ পাখির খাবার সারা বছর এক মহাদেশেও হয় না৷ কিছু পাখি আছে গ্রীষ্মে বা শীতে খাবারের জন্য একেক জায়গায় থাকে৷ আবার প্রজননের জন্য আলাদা জায়গায় থাকে৷ তাহলে কোন পাখি কোন দেশের? সারা বিশ্ব যেটি মেনে নেয়, সেটি হলো, পাখিরা একদিনের জন্য যে দেশকে নিয়মিত ব্যবহার করে, পাখিরা সেই দেশের৷ এক পাখি বহু দেশের হতে পারে৷ যেমন ধরেন, সুমচাও নামের পাখি গ্রীষ্মে বাংলাদেশে জন্মায়, শীতে তাদের কিন্তু খাবার নেই, তাই তারা দক্ষিণে, যেমন মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় চলে যায়৷ আবার তারা গ্রীষ্মে এই দেশে ফিরে আসে৷ এই পাখি তাহলে কোন দেশের? এটা বাংলাদেশেরও, মালয়েশিয়ারও৷ আবার অনেক পাখি আছে যারা শীতে বাংলাদেশে আসে৷ এরপর প্রজননের জন্য হিমালয়ে চলে যায়, তিব্বতে চলে যায় বা তুন্দ্রা অঞ্চলে চলে যায়৷ তারা কি তাহলে বাংলাদেশের পাখি নয়? অবশ্যই বাংলাদেশের পাখি৷ ওরা সাইবেরিয়ারও পাখি৷ এই হিসেবে আমাদের যে ৭০০ প্রজাতির পাখি আছে, এর মধ্যে সাড়ে ৩শ' প্রজাতির পাখি সারা বছর বাংলাদেশে থাকে না৷
শীতের মৌসুমে তো অনেক পাখি বাংলাদেশে আসে৷ এই ধরনের কত প্রজাতি আছে যারা একটা নির্দিষ্ট মৌসুমে বাংলাদেশে আসে?
প্রায় সাড়ে ৩শ' প্রজাতির পাখি শীতে বাংলাদেশে থাকে, কিন্তু প্রজনন করে না৷ প্রজননের সময় হলো উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্ম৷ তখন তারা উত্তরে চলে যায়৷ হিমালয়, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া বা আরো উত্তরে সাইবেরিয়ায় চলে যায়৷ আর ১০ থেকে ১২ প্রজাতির পাখি আছে, যারা গ্রীষ্মেই শুধু বাংলাদেশে থাকে, শীতে এখানে থাকে না, দক্ষিনে চলে যায়, যেখানে শীতেও কিছুটা আর্দ্র৷
বিশেষ সময়ে বাংলাদেশে আসা পাখির সংখ্যা কমছে, নাকি বাড়ছে?
কমে যাচ্ছে, কারণ, সারা বিশ্বেই পাখির সংখ্যা কমছে৷ তবে এক বছরের চেয়ে আরেক বছর বেশি হতে পারে৷ আমরা এবার যে গণনা করেছি, তাতে দেখা যাচ্ছে গত বছরের চেয়ে এবার পাখির সংখ্যা বেশি হবে৷ কিন্তু আমরা যদি গত ৩০ বছরের হিসাব করি, তাহলে ট্রেন্ডটা কমতির দিকেই৷
কেন কমে যাচ্ছে?
বাংলাদেশে কমে যাচ্ছে, কারণ, সারা বিশ্বেই কমে যাচ্ছে৷ গত ৩০ বছরের হিসাব অনুযায়ী সারা বিশ্বেই পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে৷ আর আমরা এশিয়া মহাদেশে হিসাব করে দেখেছি, এ অঞ্চল অনেক বেশি উন্নত হচ্ছে৷ উন্নত বলতে আমরা বুঝছি, এখানে রাস্তাঘাট হচ্ছে, দালানকোঠা হচ্ছে৷ ফলে পাখির বসবাসের জায়গা কমে যাচ্ছে৷ আমাদের যেমন বসবাসের জায়গা লাগে, তেমনি পাখিরও বসবাসের জায়গা লাগে৷ পাশাপাশি আমরা যে পরিবেশ দূষণ করছি, তার কারণে অনেক পাখি মারা যাচ্ছে৷ মোট কথা, সবাই ধরে নেয়, পাখি কমে যাচ্ছে তাদের জায়গা কমে যাচ্ছে৷ তাদের তো প্রজননের জায়গা লাগে, থাকার জায়গা লাগে৷
বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে পাখি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়?
যেখানে মানুষের বসতি কম, সেখানেই পাখির বসবাস বেশি৷ যেমন ধরেন, উপকূলে মানুষের বসতি কম, কারণ, সেখানে মানুষ বসবাস করতে পারে না৷ সেখানে পাখির বসতি বেশি৷ আবার সিলেটের বিস্তীর্ন হাওরঞ্চালে মানুষের পক্ষে বসবাস করা কঠিন, সেখানেও পাখির বেশি বসবাস৷ অর্থাৎ, যেখানে মানুষের বসবাস বা চলাফেরা কম সেখানেই পাখির বসবাস বেশি৷
পাখির অভয়ারণ্যের জন্য সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে?
বাংলাদেশের সরকার কিছু শক্তিশালী পদক্ষেপ নিয়েছে বলেই এখনো কিছু পাখি টিকে আছে৷ এ ব্যাপারে সরকারের প্রশংসা না করলেই নয়৷ কিছু এলাকায় সরকার মানুষের যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত করেছে৷ হাওরাঞ্চলের কিছু এলাকা সংরক্ষিত করেছে৷ কিছু বন সরকার সংরক্ষিত করেছে৷ ফলে সেখানে কিছু পাখি বসবাস করতে পারছে৷ সুন্দরবনকে সরকার সংরক্ষিত করেছে৷ আমি প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় গিয়ে দেখেছি, তারা কিভাবে তাদের ম্যানগ্রোভ ফরেস্টকে নষ্ট করে সেখানে লবণ চাষ করছে৷ কিন্তু আমাদের সরকার সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে৷ আমরা কিন্তু আমাদের সুন্দরবনকে নষ্ট করিনি৷ কিছু কিছু যে নষ্ট হয়নি, তা নয়৷ মানুষ সেখানে ঢুকছে৷ কিন্তু সরকারের তরফ থেকে আমরা দেখছি, গত ৪০ বছরে সরকার এটিকে রক্ষা করারই চেষ্টা করছে৷ আপনি যদি পশ্চিমবঙ্গেও যান, সেখানে দেখবেন সুন্দরবনের মধ্যেও মানুষের বসতি আছে৷ কিন্তু আমাদের দেশে এত মানুষের বাস, তারপরও সুন্দরবনের মধ্যে সরকার কাউকে বসতি গড়তে দেয়নি৷ খালি সমালোচনা করলেই হবে না, ভালো দিকগুলোও বলতে হবে৷ যদিও হয়ত যথেষ্ট করা হচ্ছে না, আমরা হয়ত আরো বেশি চাই, তারপরও সরকার যেটা করছে, সেটা অনেক৷
বাংলাদেশে কি পাখির অভয়ারণ্য আছে?
সরাসরি অভয়ারণ্য নাম দিয়ে হয়ত নেই৷ তবে ৪০টি সংরক্ষিত বন আমাদের আছে৷ সেখানে কেউ চাইলেও বাড়ি করতে পারে না৷ কেউ পাখি, পশু পাখি মারতে পারে না৷ রক্ষিত এলাকা হলে সেখানে সব পশুই রক্ষিত৷ সেখানে সবাই নিরাপদ৷ যেমন, সুন্দরবন সংরক্ষিত৷ সেখানে বাঘ মারা যাবে না৷ তার মানে কি পাখি মারা যাবে? কেউ আপনাকে কিছু বলবে না? আসলে তা নয়, যেখানে সংরক্ষিত, সেটা সবার জন্য রক্ষিত৷ বাঘও যেমন রক্ষিত, সেখানে পাখিও রক্ষিত৷
এই রক্ষিত জায়গায়গুলোতে পাখির থাকা বা প্রজননের ভালো বন্দোবস্ত আছে?
দেখেন পাখি তো একটা বন্য প্রাণী৷ যদি ভালো পরিবেশ থাকে, তাহলে সবকিছুই সে নিজে করবে৷ তার খাবার আপনাকে দিতে হবে না, তার থাকার ব্যবস্থা আপনাকে করতে হবে না, সে নিজেই করে নেবে৷ কোনো বন্য প্রাণীর জন্যই তা করে দিতে হয় না৷
পাখির প্রতি সাধারণ মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত?
আগে আমাদের আচরণ খুবই খারাপ ছিল৷ এটা আমাদের ঐতিহাসিক কারণ৷ আমাদের থেকে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী যাঁরা, তাঁরা কিন্তু পাখির প্রতি বা যে কোনো প্রাণীর প্রতি একটু সহানুভূতিশীল ছিল৷ কিন্তু আমরা মনে করতাম, এটা প্রকৃতি দিয়েছে আমাদের খাবারের জন্য৷ একশ' বছর আগেই এখানকার মানুষ ওভাবে চিন্তা করত না৷ গত ৫০ বছরে এই ধারণার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে৷ এখন অনেকেরই পাখির প্রতি মমতা বা ভালোবাসা তৈরি হয়েছে৷ এখন কিন্তু বন্য পাখি ধরে আপনি কোথাও বিক্রি করতে পারবেন না৷ এটা কিন্তু প্রশাসন বন্ধ করেনি৷ সাধারণ মানুষই বন্ধ করে দিয়েছে৷ ঢাকায় আগে খাঁচার মধ্যে পাখি বিক্রি হতো৷ এখন কিন্তু সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে৷ শিক্ষিত মানুষ সচেতন হয়েছেন৷ আমাদের দু'টো জিনিস ভালো হয়েছে, একটা মানুষ সজাগ হয়েছে আর দ্বিতীয়টা হলো সরকারি পদক্ষেপগুলো ভালো হয়েছে৷
সাক্ষাৎকারটি কেমন লাগলো জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷