নিজের পছন্দমতো ভোট দেয়া কি অপরাধ?
৬ জানুয়ারি ২০১৯বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি এক দিক দিয়ে বেশ ভোটারকেন্দ্রিক৷ সর্বশেষ নির্বাচনের কথাই ধরুন৷ ভোটগ্রহণের আগে-পরে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ কিংবা খুবই মন্থর গতির করা হয়েছিল৷ কিন্তু যখনই মোবাইল ইন্টারনেট চালু হলো, অসংখ্য ভোটার নিজেদের ভোট দিতে না পারার কথা তুলে ধরলেন৷ কেউ বলছেন, ভোটকেন্দ্রে যেতে দেয়া হয়নি, কেউ বলছেন কেন্দ্রে গিয়ে দেখি আমার ভোট অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছেন, কেউবা বাধ্য হয়েছেন নির্দিষ্ট একটি প্রতীকে ভোট দিতে৷ ডয়চে ভেলের ফেসবুক পাতায় অসংখ্য ভোটার এমন অভিযোগ করেছেন৷ কেউ কেউ অবশ্য ঠিকভাবে ভোট দিতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন, তবে সেই সংখ্যাটা বেশ সীমিত৷
আবার ভোটগ্রহণের আগের রাতে প্রশাসনের সহায়তায় অনেক কেন্দ্রে ‘ত্রিশ থেকে ষাট শতাংশ' জাল ভোট দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিরোধী জোট ঐক্যফ্রন্ট৷ এরকম ‘ভোট ডাকাতির' কিছু তথ্যপ্রমাণ ফেসবুকেও রয়েছে৷ আর একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তো দিব্যি এক ভোটকেন্দ্রে ভোট শুরুর আগেই ব্যালটবক্স ভর্তি করা হয়েছে - এমন ভিডিও প্রকাশ করেছে৷ ডয়চে ভেলের প্রকাশিত এক ভিডিওতে খুলনার একটি আসনে মোট ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট প্রাপ্তির ঘোষণা দিতে দেখা গেছে৷পরে তা সংশোধন করা হলেও ভোটারের চেয়ে বেশি ভোট প্রাপ্তির ঘোষণার খবর প্রকাশ করায় এক সাংবাদিককে গ্রেপ্তারও করা হয়৷এখন তিনি জামিনে মুক্ত৷
ভোটের চিত্র যখন এমন, তখনও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট এমন ‘বিপুল ভোটে জয়' জনগণই নিশ্চিত করেছে বলে দাবি করেছে৷ তাদের বক্তব্য হচ্ছে, জনগণের ভোটে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছেন তারা৷ যদিও সেই জনগণের মধ্যে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন, তাদের এক বড় অংশেরই বক্তব্য ভিন্ন৷
আবার ঐক্যফ্রন্টের কথাই ধরুন৷ তারা নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে জনগণের ভোটের অধিকার ফেরাতে আন্দোলনের কথা বলছেন৷ কেননা, তারা মনে করেন, প্রকৃত ভোটাররা আসলে ভোট দেয়ার সুযোগ পাননি৷ সুযোগ পেলে নির্বাচনের ফলাফল এতটা একপেশে হতো না৷
এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে, ক্ষমতাসীন জোট বা বিরোধী জোট - উভয়েই অন্তত মৌখিক বিবেচনায় জনগণকে তাদের শক্তির উৎস ভাবেন৷ তবে বাস্তবে সেটা হয়ত ভিন্ন৷ আওয়ামী লীগ দল হিসেবে যতই ভালো কাজ করুক, এবার যে তারা জনগণের উপর ঠিক ভরসা করতে পারেনি, সেটা নানা অভিযোগ থেকে বোঝা যায়৷ অন্যদিকে বিরোধী জোট জনগণের উপর যতটা ভরসা করেছিল, বাস্তবে আসলে তেমন একটা প্রতিদান পায়নি৷ অনেকে ভোট দিতে না পারার অভিযোগ করলেও তার প্রতিবাদে কোনো কিছু করেনি৷
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সর্বশেষ নির্বাচনের সুদূর প্রসারী প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা এখনই বলা দুষ্কর৷ তবে, জনগণের স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার অধিকার যে এবার নানাভাবে খর্বিত হয়েছে সেটা পরিষ্কার এবং উদ্বেগের বিষয়৷ গত প্রায় তিন দশকে আয়োজিত অধিকাংশ জাতীয় নির্বাচনে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত হয়েছিল৷ সেই বিবেচনায় এবারের নির্বাচনে সেই অধিকারের দিক থেকে বাংলাদেশ অনেকটা পিছিয়ে গেল৷
রাজশাহীর কালমা গ্রামের কথা চিন্তা করুন৷ সেই গ্রামে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট পড়েছিল বেশি৷ এজন্য পুরো গ্রামকে নির্বাচনের পর থেকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে বলে দাবি করেছেন সেই গ্রামের বাসিন্দারা৷ যদিও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বক্তব্য ভিন্ন, তা সত্ত্বেও গ্রামটি যে অবরুদ্ধ হয়ে আছে, সেটা সেই গ্রাম পরিদর্শন করে আসা সাংবাদিকদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷
আবার শুধু যে ধানের শীষে ভোট দেয়া ‘অপরাধ' হয়েছে এমন না৷ ফরিদপুরের ভাঙায় নৌকা প্রতীকে ভোট দেয়ায় সংখ্যালঘুসহ বেশ কয়েকটি পরিবার হামলার শিকার হয়েছেন৷ এক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ বিএনপি বা জামায়াত নয়৷ হামলাকারীরা সেখানকার এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক বলেই গণমাধ্যমে উঠে এসেছে৷ সেই হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে কয়েকজনকে আটকের কথা জানিয়েছে পুলিশ৷ তবে সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক ঢুকে গেছে৷ সেই আতঙ্কে অনেকেই এখন বাড়িছাড়া৷
অনেকেই বর্তমানের সঙ্গে অতীতের তুলনা করে বর্তমানের অপরাধের গুরুত্ব কমানোর চেষ্টা করেন৷ কিংবা বোঝাতে চান, আগের চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে৷ সেটা অনেকক্ষেত্রে হয়েছে বৈ কি৷ তবে অতীতের সেসব ঘটনার প্রতিবাদ হয়েছে বলেই বর্তমানটা আগের চেয়ে ভালো৷ আর এই বর্তমানের অনিয়মের প্রতিবাদ ভবিষ্যৎটা আরো সুন্দর করতে পারে৷
সেই বিবেচনায় নোয়াখালীতে ধানের শীষে ভোট দেয়ায় গণধর্ষণের শিকার নারীর কথা বলা যেতে পারে৷ যে পাশবিক নির্যাতনের শিকার তিনি হয়েছেন, সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়৷ তবে, আশার কথা হচ্ছে, ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে সন্দিহানদের গ্রেপ্তারে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে পুলিশ৷ মূল অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, তিনি ক্ষমতাসীন দলের কর্মী হওয়া সত্ত্বেও রেহাই পাননি৷ এখন দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হলে তা বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিপরীতে এক চমৎকার উদাহরণ হবে৷
আমি মনে করি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা জরুরী৷ ভোট দেয়া কোনো অপরাধ হতে পারে না৷ বরং এই অধিকার যদি হরণ হয়, সেটা গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে৷ আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর তাই উচিত হবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে বা ক্ষমতায় যেতে জনগণকে সন্তুষ্ট করে তাদের ভোট আদায়ে সচেষ্ট হওয়া৷ নতুবা সরকার দেশের উন্নতি যতই করুক, ক্রমশ সেটি স্বৈরতন্ত্র হিসেবে পরিচিতি পাবে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷